কাজির দক্ষিণা বাড়িয়ে দিলেই...   শিপু ফরাজী, ভোলা দক্ষিণ প্রতিনিধি :: চরফ্যাসন উপজেলায় বাল্যবিবাহ অপ্রতিরোধ্য হয়ে উঠেছে। বাল্যবিবাহ রোধে প্রশাসনের হাক-ডাক, হুমকী-ধামকী, জেল-জরিমানা  আর নানান নির্দেশনার সব কিছুই অকার্যকর হয়ে গেছে কাজিদের অতিলোভী কৌশলী তৎপরতার কাছে।

ফলে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মেয়ে শিক্ষার্থীরা সংসার ধর্ম বুঝে উঠার আগেই বিয়ের পিড়িতে বসতে বাধ্য হচ্ছে। অভিভাবকরা স্থয় কাজি এবং ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যানগনের সহায়তায় অপ্রাপ্ত বয়স্ক এসব বিয়েকে রেজিষ্ট্রেশন করে নিচ্ছেন। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের দুর্বল তদারকীর কারণে কাজিরা এসব অনিয়ম করে পার পেয়ে যাচ্ছেন।

কখনো কখনো বয়সের প্রমাণপত্র হিসেবে জন্ম নিবন্ধন সনদ ম্যানেজ করতে ব্যর্থ হলে কাবিন ছাড়াই মৌলভী ডেকে বাল্যবিয়ে হচ্ছে।

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ বা পঞ্চম শ্রেণি ছাত্রীরাও জন্ম নিবন্ধনের কল্যাণে প্রাপ্ত বয়স্কের সনদ নিয়ে বিয়ের পিঁড়িতে বসে পড়ছে।

নিম্ন মাধ্যমিক কিংবা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ছাত্রীদের একের পর এক বিয়ের ঘটনায় শিক্ষকরাও উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন।

বুধবার দুপুরে পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের শাহজাহান মিয়ার বাড়িতে সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রীর বাল্যবিয়ের আয়োজন করা হয়। সংবাদ পেয়ে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোখলেছুর রহমান পুলিশ দলসহ বুধবার দুপুর ১টায় বিয়ে বাড়িতে ছুুটে যান। প্রশাসনের লোকজন দেখে কাজি এবং বরসহ বর-কনের আত্মীয়রা বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যান।

পরে কনের বাবা শাহজাহান মিয়াকে উপস্থিত করা হলে ১০০০ হাজার টাকা অর্থদ- এবং প্রাপ্তবয়স্ক না হওয়া পর্যন্ত মেয়েকে বিয়ে দেয়া হবে না এমন মুচলেকায় মুক্তি দেয়া হয়। কিন্তু ওইদিন রাতেই কাজির যোগসাজশে বিয়ে সম্পন্ন হয়ে যায়।

কনে আসমা বেগম স্থানীয় উত্তর মাদ্রাজ ওয়াহেদিয়া দাখিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী এবং বর জাহাঙ্গীর হোসেনের বাড়ি জাহানপুর গ্রামে। পুলিশ ২ নভেম্বর দুপুরে পৌরসভার ২নং ওয়ার্ডের প্রবাসী ছালাউদ্দিনের বাড়িতে হানা দিয়ে বিয়ের অনুষ্ঠান থেকে আলীগাঁওয়ে গফুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী কনে তাছলিমাকে আটক করা হয়।

পুলিশের উপস্থিতি টের পেয়ে বর ইউনূসসহ অন্যরা পালিয়ে যায়। কনেকে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেজাউল করিমের আদালতে সোপন্দ করা হয়। বিয়ে হয়নি এবং বয়স না হওয়া পর্যন্ত আর বিয়ে দেয়া হবে না অভিভাবকদের এমন মুচলেকায় কনেকে মুক্তি দেয়া হয়।

কিন্তু একদিন পর লালমোহন উপজেলার মুগরিয়া গ্রামের আবু তাহেরের বাড়ি থেকে (কনের শ্বশুরবাড়ি) বর ইউনুস এবং কনে তাছলিমাকে লালমোহন থানা পুলিশ গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তারকৃত বর-কনেকে চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী অফিসারের আদালতে সোপন্দ করা হলে ১ হাজার টাকা জরিমানায় বর-কনেকে মুক্তি দেয়া হয়।

কিন্ত আদালতের মুচলেকা ভঙ্গকারী কাজি বা অভিভাবকদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। কাজির সহকারী আবদুস সালাম কনের বাড়িতে উপস্থিত হয়ে বিয়ে পড়ান এবং কাবিননামা লিপিবদ্ধ করেছেন।

৬ অক্টোবর রাতে চর যমুনা গ্রামের চর নুরুল আমীন মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী মালার বিয়ে হয়। বিয়ের আয়োজন চলাকালে উপজেলা নির্বাহী অফিসার রেজাউল করিম কাজি মোহাম্মদ হাফেজকে বিয়ে বন্ধ রাখার নিন্দেশ দেন। কিন্তু বিয়ে বন্ধ হয়নি। কাজি মোহাম্মদ হাফিজ কনের বাবার উপসি’ত থেকে বিয়ে পড়ান এবং কাবিননামা লিপিবদ্ধ করেছেন।

মালা স্কুল ছেড়ে পুলিশ কনস্টেবল স্বামীর হাত ধরে শ্বশুরালয়ে উঠেছেন। ৪ নভেম্বর মাঝের চর ফাজিল মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রী লাইজুর বিয়ের জন্য ভক্তিরহাট বাজার জামে মসজিদে কাজিসহ আত্মীয়স্বজন সমবেত হন।

নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোকলেছুর রহমান বিয়ের আনুষ্ঠানিকতা বন্ধ রাখার জন্য কাজি অধ্যক্ষ লোকমানকে নিন্দেশ দেন। কাজি লোকমান নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটকে আশ্বস্ত করলেও কিন্তু বিয়ে বন্ধ থাকেনি। কাজি অধ্যক্ষ লোকমানের উপসি’তিতেই একই মাদ্রাসার অফিস সহকারী এবং কাজির সহকারী ফারুক হোসেন মাদ্রাসার সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীর বিয়ে পড়ান।

লাইজু ১৫ বছরের বর নীরবের হাত ধরে শ্বশুরালয়ে উঠেছে।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, চরফ্যাশনের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ ও পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রীদের বড় একটি অংশ বিয়ে করে স্কুল ছেড়ে স্বামীর সংসার করছে। স্কুল মাদ্রাসার ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণির ছাত্রীদের বিয়ের হারও কম নয়।

চর মায়া প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চতুর্থ শ্রেণির ছাত্রী সাজেদা, চর মনোহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রুমা, মনোহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রিনা ও রুনিয়া, পশ্চিম চর মনোহর প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী খাদিজার মতো প্রাথমিক ও নিম্ন মাধ্যমিক স্তরের অসংখ্য ছাত্রী বিয়ে করে স্বামীর সংসার করছে।

বাংলা বাজার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক কামাল হোসেন জানান, তার বিদ্যালয়ের ষষ্ঠ শ্রেণির ছাত্র সবুজ, ছাত্রী সীমা, ফাহিমা ও সবুজ এবং অষ্টম শ্রেণির ছাত্রী সারমনি বিয়ে করে শিক্ষাজীবনের ইতি টেনেছেন। এতসব অপ্রাপ্ত বয়স্ক ছাত্রছাত্রীর বিয়ের পরও ইউনিয়নের কাজি আবুল কালাম আজাদ বলছেন, এসব বিয়ের বিষয়ে তিনি আদৌ জানেন না।

রেজিস্ট্রিও করা হয়নি। উপজেলার সর্বত্র প্রকাশ্যে বা গোপনে বাল্যবিয়ের হিড়িক চললেও সংশ্লিষ্ট কাজিরা নিবন্ধনের কথা অস্বীকার করছেন।

তবে বাল্যবিয়ে প্রতিরোধ কার্যক্রমের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট চরফ্যাশন উপজেলার একটি এনজিও কর্তকর্তা জানান, আইনি ঝামেলা এড়াতে কাজিরা বেশকিছু কৌশল নিয়ে থাকেন। প্রত্যেক কাজি কাবিননামার দুটি বালাম সংরক্ষণ করে থাকেন। একটি আসল এবং অপরটি নকল বা বিকল্প।

বাল্যবিয়ের তথ্য কাবিননামার বিকল্প বালামে লিপিবদ্ধ করা হয়। কোনো ঝামেলার আঁচ পেলে বালামটি গায়েব করে দেয়া হয়। কাবিননামার অস্তিত্ব অস্বীকার করা হয়। দ্বিতীয়ত প্রত্যেক কাজি এক বা একাধিক সহকারী রাখেন। সহকারীরা সরেজমিন গিয়ে বিয়ে পড়াতে মৌলভীর কাজ করেন। পাশাপাশি বিকল্প কাবিননামায় তথ্য লিখে আনেন। এমন বিয়ে পড়ানো বা কাবিননামা নিয়ে কোনো সঙ্কট সৃষ্টি হলেও কাজিরা নিরাপদ থেকে যান।

তৃতীয়ত অপ্রাপ্ত ছেলেমেয়ের বিয়ের আগে নানা অজুহাতে অভিভাবকরা ইউনিয়ন পরিষদ থেকে বয়স বাড়িয়ে জন্ম নিবন্ধন সনদ সংগ্রহ করেন। সনদের কল্যাণে যে কোনো বয়সের ছেলেমেয়ের বয়স রাতারাতি ১৯ বছরে উঠে যায়।

চরফ্যাশন উপজেলা নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোখলেছুর রহমান জানান, উপজেলা প্রসাশন সব সময় বাল্যবিয়ে রোধে প্রস্তুত। অনেক বিয়ে বন্ধ করে বর ও তাদের অভিভাকদের জেল-জরিমনা করা হয়েছে। তবে নিকাহ রেজিস্ট্রারের (কাজি) কারসাজিতে গোপনে অনেক বিয়ে হয়ে যায়। এসব নিকাহ রেজিস্ট্রারদের (কাজি) বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here