কমিশন পায় ডায়াগনস্টিক সেন্টারস্টাফ রিপোর্টার :: স্বাস্থ্য খাতে চিকিৎসক ও তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারি নিয়োগের ক্ষেত্রে নিয়মবর্হিভূতভাবে ১-৫ লক্ষ টাকা, বদলির জন্য ১০ হাজার থেকে ১০ লক্ষ টাকা এবং ডিপার্টমেন্টাল প্রমোশন কমিটি (ডিপিসি)’র মাধ্যমে পদোন্নতির ক্ষেত্রে ৫-১০ লক্ষ টাকার ঘুষের আদান-প্রদান হয়।

এসব অনিয়ম ও লেনদেনে দলীয় নেতা, কর্মচারী ইউনিয়ন নেতা, অফিস প্রধান সহকারী, হিসাব রক্ষণ কর্মকর্তা, এবং প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের একাংশের যোগসাজোসের অভিযোগ রয়েছে।

এছাড়া, চিকিৎসকদের সাথে ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কমিশনভিত্তিক অলিখিত চুক্তির মত অনৈতিক কর্মকান্ডেরও অভিযোগ রয়েছে। ডাক্তারদের ক্ষেত্রে এ কমিশনের হার ৩০-৫০% এবং দালালদের ক্ষেত্রে কমিশন ১০-৩০% পর্যন্ত হয়ে থাকে।

স্বাস্থ্যখাতে সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায় শীর্ষক ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের অধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের মোট জনবলের ২০% পদ শূন্য রয়েছে। অন্যদিকে বিদ্যমান জনবলের অনুপাত বিশ্ব মানদন্ড অনুপাতে খুবই কম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মানন্ড অনুযায়ী চিকিৎসক জনসংখ্যা অনুপাত ১ঃ৬০০ হলেও বাংলাদেশে এটি ১ঃ৩২৯৭ যেখানে আন্তর্জাতিকভাবে ডাক্তার ও নার্সের স্বীকৃত অনুপাত ১ঃ৩, বাংলাদেশে এ অনুপাত ১ঃ০.৪।

৬৪টি জেলার মধ্যে ২৬টি জেলায় ডেপুটি সিভিল সার্জন পদ তৈরী করা হলেও ছয়টি জেলায় উক্ত পদে পদায়ন নেই। হাসপাতালের সুষ্ঠু চিকিৎসা সেবা ব্যাহত হওয়ার পেছনে গুরুত্বপূর্ণ কারণ বিভিন্ন ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনায় হাসপাতালের সেবা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হওয়া; হাসপাতালে বিভিন্ন কর্মকান্ডে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ/প্রভাব; হাসপাতাল অভ্যন্তরে দালাল দ্বারা হয়রানির শিকার ইত্যাদি বিষয় উঠে এসেছে।

গবেষণা প্রতিবেদনে স্বাস্থ্যখাতে বেশকিছু উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তনের চিত্র উঠে এসেছে যেমন, দেশব্যাপি কমিউনিটি ক্লিনিক কার্যক্রম সম্প্রসারণের মাধ্যমে জনগণের দোরগোড়ায় প্রাথমিক সেবা পৌঁছে দেয়া; সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার মাধ্যমে ওষুধ শিল্পকে একটি রপ্তানিমুখী শিল্পে পরিণত করা; পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতি প্রচলনে ব্যাপক প্রচারণা, সেবা বৃদ্ধি এবং জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ক্রমান্বয়ে হ্রাস; সকল সরকারি হাসপাতাল ও স্বাস্থ্য কেন্দ্রে লালসবুজের বিশেষ মোড়কে ওষুধ সরবরাহ; মাতৃ ও শিশু স্বাস্থ্য উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি; জাতীয় চক্ষুসেবা কার্যক্রমের আওতায় সাত লক্ষের অধিক রোগীকে বিনামূল্যে অপারেশন এবং লেন্স সরবরাহ; সকল মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বার্ন ইউনিট স্থাপনের উদ্যোগ, এসএমএস এর মাধ্যমে অভিযোগ-পরামর্শ প্রেরণ ইত্যাদি।

গবেষণার পর্যবেক্ষণে বলা হয়, জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ২০১১, দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিক অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (রেগুলেশন) (অর্ডিন্যান্স) ১৯৮২, এবং দি মেডিকেল প্র্যাকটিস অ্যান্ড প্রাইভেট ক্লিনিকস্ অ্যান্ড ল্যাবরেটরিজ (অ্যামেন্ডমেন্ট) অর্ডিন্যান্স ১৯৮৪ বলবৎ থাকলেও এগুলো যুগোপযোগী না হওয়ায় চিকিৎসকের অবহেলার কারণে কোনো রোগীর মৃত্যু বা ক্ষতি হলে তাঁর বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ, বিনানুমতিতে কাজে অনুপস্থিতির ও বিলম্বে উপস্থিতির জন্য শাস্তির বিধান থাকলেও তার প্রয়োগ অত্যন্ত সীমিত। অনেক ক্ষেত্রে আবার শাস্তির পরিমান অত্যন্ত নগণ্য।

প্রতিবেদনে প্রাতিষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতার কথা উল্লেখ করে প্রতিষ্ঠানটির নির্বাহী পরিচালক ড ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “স্বাস্থ্যখাতে সার্বিকভাবে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য ও আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসনীয় ও স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অগ্রগতি অর্জন করেছে। তবে সুশাসন নিশ্চিত করে কার্যকরভাবে দুর্নীতি ও বহুমুখী অনিয়ম নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এ খাতে অর্জন ও অগ্রগতি আরো অনেক ভাল হবার সম্ভাবনা রয়েছে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে অর্জিত অগ্রগতির স্থায়ীত্ব ঝুঁকির সম্মুখীন হবে। অন্যদিকে স্বাস্থ্যখাতের মত মৌলিক অধিকার খাতে আর্থিক বরাদ্দ বিব্রতকরভাবে নিন্মমানের; যার প্রভাবে স্বাস্থ্য অবকাঠামো, জনবল ও গুণগত চিকিৎসা সেবায় প্রত্যাশিত মান অর্জন করা সম্ভব হচ্ছে না। আর্থিক বরাদ্দ উদ্বেগজনকভাবে নিন্ম।

এ অবস্থার পরিবর্তনে সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছা ও সঠিকভাবে জাতীয় প্রাধান্য নির্ধারণ অপরিহার্য।”

গবেষণার ফলাফলের প্রেক্ষিতে বিভিন্ন সমস্যা থেকে উত্তরণে টিআইবি’র পক্ষ থেকে ১৭ দফা সুপারিশ প্রস্তাব করা হয়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো: প্রয়োজন অনুযায়ী নতুন আইন প্রণয়ন ও বিদ্যমান আইনের প্রয়োজনীয় সংস্কার করা; বিভিন্ন শূন্য পদ পূরণে দ্রুত কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ; জনবল নিয়োগে দীর্ঘসূত্রতা দূর করা; পদোন্নতিতে যোগ্য ব্যক্তি নির্বাচনে যোগ্যতার বিভিন্ন সূচকে স্কোরিং ব্যবস্থা চালু করা; পেশাজীবী সংগঠনগুলোর দলীয় হস্তক্ষেপ বন্ধ করা; স্থানীয় পর্যায়ে স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করতে সংসদ সদস্যদের সক্রিয় উদ্যোগে স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনা কমিটিগুলো কার্যকর করা; রোগীর তথ্য প্রাপ্তি নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রতিটি হাসপাতালে তথ্য ও অনুসন্ধান ডেস্ক কার্যক্রম চালু করা; চিকিৎসকের অবহেলা বা ভুল চিকিৎসার ক্ষেত্রে তদন্ত সাপেক্ষে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ; বিএমডিসি’র ওয়েবসাইটে নিবন্ধিত চিকিৎসকদের ডিগ্রি/যোগ্যতাসহ তালিকা প্রকাশ এবং নিয়মিত হালনাগাদ করা; ক্রয়, মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণের ক্ষেত্রে ই-টেন্ডারিং প্রক্রিয়া চালু করা; এবং বেসরকারি চিকিৎসাসেবা প্রতিষ্ঠানের মান নিয়ন্ত্রণে তদারকি কার্যক্রম ব্যবস্থা জোরদার করা।

 

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here