শিপুফরাজী : উপকূলীয় জেলা ভোলার চরফ্যাশন উপজেলার বহু পুরনো দ্বীপ কুকরী-মুকরী। কেবলমাত্র বিচ্ছিন্নতাই সবুজ বন-বনানী ঘেরা এই দ্বীপকে নানা সংকটের মুখে রেখেছে।

এলাকার মানুষদের পিছিয়ে রেখেছে সবদিক থেকে। নাগরিক সুবিধার কোনোটাই এখানকার মানুষের হাতের নাগালে নেই।

কুকুরীমুকরী ইউনিয়নকে জলোচ্ছ্বাস থেকে রক্ষার জন্য অবশেষে বেড়িবাঁধ হচ্ছে। এ বাঁধ নিয়ে এলাকার মানুষ নিরাপদে বেঁচে থাকার স্বপ্ন ।

বাঁধ নির্মাণের জন্য জলবায়ু ট্রাস্ট ফান্ড থেকে ১৫ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। পানি উন্নয়ন বোডের্র ১৫ বর্গ কিলোমিটার আয়তনের কুকরী ইউনিয়নের চারপাশে বেড়ি নির্মাণে ৫২ কোটি টাকার প্রকল্প । এ প্রকল্পে ১৪ দশমিক ৫৬ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ করা হচ্ছে বর্তমানে।

৭শ’ বছর আগে সাগর কোলে এ চরটি প্রথম জেগে ওঠে। ১৯১২ সালে ফের এর বেশিরভাগ অংশ সাগরে বিলীন হয়। ২০/৩০ বছরের মধ্যে আবার ছোট ছোট দ্বীপ জেগে ওঠে। এদিকে ১৯৭০ সালে প্রলয়ংকরী গোর্কীর আঘাতে এ ইউনিয়নটি সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এখানকার ৯৭ ভাগ মানুষ মারা যায়।

বন্যার পর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কুকরী দ্বীপ সফর করেন। ওই সময়ই তিনি এখানে শান্তির দ্বীপ নির্মাণের প্রতিশ্রুতি দেন। পরবর্তীকালে ৮৫ হাজার হেক্টর (২০ হাজার একর) জমির মধ্যে ১৬ হাজার একর জমিতে বনবিভাগ ম্যানগ্রোভ বনায়ন করে। ৫ হাজার একর জমি চাষাবাদের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। এ দ্বীপটিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে ইতিমধ্যে বনবিভাগ থেকে প্রথম পর্যায়ের কাজ করা হয়। বর্তমানে তৈরি করা হচ্ছে রেস্ট হাউস, গার্ড টাওয়ার প্রভৃতি।

এর পরও কুকরি বাসির আতঙ্কের শেষ নেই কারণ, বর্ষার আগে বাঁধ পুরোপুরি শেষ হবে কিনা তা নিয়ে সন্দেহ এলাকাবাসীর। তাদের আশঙ্কা বর্ষার আগে কাজ শেষ না হলে নতুন বাঁধ ক্ষতির মুখে পড়তে পারে । ভেস্তে যাবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের ৫২ কোটি টাকার প্রকল্প।

দক্ষিণ কুকরী-মুকরীর মনুরা বাজারের গা ঘেঁষে জেগে ওঠা নতুন বেড়িবাঁধ দেখিয়ে এলাকার প্রবীণ শিড়্গক মো বাদশা মিয়া বলেন, প্রায় চারশ বছরের পুরনো এই চরে বাঁধ তৈরি হচ্ছে। এটা আমাদের আশা-আকাঙ্কার প্রতিফলন। বাঁধ জোয়ারের পানি থেকে এলাকার মানুষকে রক্ষা করবে। ফসলি জমি ভরে উঠবে সবুজে সবুজে। কিন্ত, বর্ষার আগে কাজ শেষ না হলে এবারও ভোগানিত্ম পোহাতে হবে।

অন্যদিকে, অনেকদিন বেড়িবাঁধবিহীন এই দ্বীপ ইউনিয়নের মানুষ বর্ষার পানিতে হাবুডুবু খেয়ে জীবন কাটাতেন। লবণ পানির কারণে কোনো ফসল হতো না। জোয়ারের পানি আসা শুরু হলে ছুটি হয়ে যেতো অধিকাংশ বিদ্যালয়েই।

চরের চারদিকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার বেড়িবাঁধ তৈরি হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসা শ্রমিকেরা মাটি কেটে বাঁধ তৈরি করছে। যে স্থানে মাটির সঙ্গে প্রায় মিশে যাওয়া মাটির রাস্তা ছিল, সে স্থানে এখন উঁচু বাঁধ হচ্ছে। এরই মধ্যে কোথাও কোথাও বাঁধ প্রায় সম্পন্ন হয়ে গেছে। আবার কোথাও মাটির কাজ চলছে অত্যনত্ম ধীরগতিতে। কোথাও এখন পর্যনত্ম মাটিই পড়েনি।

আলাপকালে দক্ষিণ কুকরী-মুকরীর মনুরা বাজারের মাছ ব্যবসায়ী মো হাসান মাতুব্বর বলেন, বাঁধ আমাদের অনেক উপকার করবে। বাঁধের আশায় তো আমরা চেয়েছিলাম যুগের পর যুগ। কিন্ত মনুরা বাজারের পাশে তেঁতুলিয়া নদীর তীরে প্রায় তিন কিলোমিটার দীর্ঘ ও দেড় কিলোমিটার প্রশস্ত বিশাল এলাকা বাঁধের বাইরে রাখায় এই জমি কৃষি আবাদের বাইরে থাকবে। তাছাড়া বর্ষা মৌসুম আসার আগে বাঁধের কাজ সম্পন্ন না হলে বাঁধ টেকসই করতেও সমস্যা হতে পারে।

বাঁধ নির্মাণ ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাঠকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চর কুকরী-মুকরীর এই বাঁধে মোট চারটি সুইসগেট নির্মাণ করা হবে। কিনত্মু, সে সুইস গেটের কাজ কোনো ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানকে দেওয়া হয়নি।এলাকা ঘুরে দেখা যায়, বহু পুরনো চর হলেও কুকরী-মুকরীতে উন্নয়নের ছোঁয়া খুব একটা লাগেনি। মনুরা বাজার থেকে বাবুগঞ্জ গ্রামে অবস্থিত ইউনিয়ন স্বাস্থ্যকেন্দ্র পর্যনত্ম মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার পাকা রাস্তা আছে এখানে। দুটি টেম্পু চলে এ পথে। কিন্ত, টেম্পু এসে থেমে যায় পাকা রাসত্মার মাথায়। সেখান থেকে বাজার পর্যন্ত পরের রাস্তাটুকুর অবস্থা এতটাই শোচনীয় যে, পায়ে হেঁটে চলাই কষ্টকর।

কুকরী-মুকরী পুরান বাজারের খালের দক্ষিণ পাড় ধরে একটি রাস্তা চলে গেছে খেয়াঘাটের দিকে। ইট বিছানো এ রাসত্মার ইটের অর্ধেকই যেন হারিয়ে গেছে।রাস্তাটির কোথাও ভেঙে খালে চলে গেছে। ইউনিয়ন পরিষদের সামনের ব্রিজ পার হয়ে ডাকাতিয়া ঘাটে যেতে থমকে দাঁড়াতে হয়। ব্রিজের ওপারের রাসত্মাটি ডানদিকে গেছে, নাকি বাম দিকে গেছে, বোঝাই কষ্টকর। কারণ, সেখানে কোনো রাস্তা নেই। বলা যায়, হাঁটার পথ।

ইউনিয়ন পরিষদের সামনে দিয়ে একটা রাস্তা কচ্ছপিয়ার সোজা এ পাড়ে চলে গেছে। এই রাস্তাটি করা হয়েছে, ম্যানগ্রোভ বন কেটে। বনের ভেতর দিয়ে রাস্তায় হেঁটে দেখা যায়, সেখানে বহু গাছ কাটা হয়েছে। তারপরও সেটাকে চলাচলের উপযোগী করা সম্ভব হয়নি।

আরো কয়েকটি এলাকা ঘুরে দেখা গেল, পায়েহাঁটা সরু পথের মতো রাস্তা। বর্ষায় এগুলো পানিতে ডুবে থাকে। ছড়ানো-ছিটানো বহু বাড়ির সঙ্গে সড়ক যোগাযোগের ব্যবস্থা হয়নি। তাইতো, এলাকার মানুষ মাঠের ভেতর দিয়েই চলাচল করে মাইলকে মাইল পাড়ি দেন।

এলাকাবাসীর দাবি, এলাকার উন্নয়নের জন্য এখানে পরিপূর্ণভাবে বাঁধ নির্মাণ সম্পন্ন করতে হবে। পানি নিষ্কাশনের জন্য থাকতে হবে পর্যাপ্ত সস্নুইসগেট। চরফ্যাশনের সঙ্গে কুকরী-মুকরীকে সংযুক্তির করার উদ্যোগ নিতে হবে। সংযোগ দিতে হবে বিদ্যুতের। তা হলেই কুকরী-মুকরী এগুবে। এখানকার মানুষ পাবেন সমৃদ্ধির পথ।

শিপুফরাজী/

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here