ঢাকা : গ্রামীণ ব্যাংক আইন-২০১৩ এর প্রতিবাদে সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করবে ব্যাংকটির ৮৪ লক্ষ সদস্যের (মালিক) নির্বাচিত প্রতিনিধিরা। বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টায় গ্রামীণ ব্যাংক প্রধান কার্যালয়ে এ সংবাদ সম্মেলন করা হবে।

গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনা পর্ষদের নির্বাচিত সদস্য তাহসিনা খাতুনের স্বাক্ষরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে এ তথ্য জানানো হয়।

‘গ্রামীণ ব্যাংক বিল-২০১৩’ গত ৩ অক্টোবর মন্ত্রিসভায় অনুমোদন হয়। এরপর গত রবিবার বিলটি সংসদে উত্থাপন করেন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত। বিলটি পরীক্ষা করে সাত দিনের মধ্যে সংসদে প্রতিবেদন দিতে অর্থ মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটিতে পাঠানো হয়েছে। প্রস্তাবিত আইনে সরকার সরাসরি অথবা গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা ব্যাংক কোম্পানি আইনসহ ব্যাংক কোম্পানি সংক্রান্ত অন্যান্য আইনের সুনির্দিষ্ট বিধানগুলো গ্রামীণ ব্যাংকের ওপর প্রয়োগ করতে পারবে এবং এ ব্যাংকের জন্য বিধি প্রণয়ন করতে পারবে মর্মে বিধানও রাখা হয়েছে। এছাড়াও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে আর্থিক হিসাব দেয়ার বাধ্যবাধকতা, অনুমোদিত ও পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধি, ব্যাংকে সরকারের শেয়ার শতকরা ২৫ ভাগ নির্ধারণ, সরকার কর্তৃক তিনজন পরিচালক নিয়োগ প্রদান, সদস্যদের মেয়াদকাল নির্ধারণ, বোর্ড সভার কোরাম পূরণের শর্ত তিনজন করাসহ বেশ কিছু নতুন বিধান ও সংশোধনী আনা হয়েছে এতে। মূলত ‘গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ-১৯৮৩’ রহিত করে ব্যাংকের ওপর সরকারের অনেকটা নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার বিধান করে বিলটি আনা হলো।

আইনটির বিধান অনুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংককে তার সব কার্যক্রমের জন্য বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। বার্ষিক আর্থিক নিরীক্ষা প্রতিবেদনও জমা দিতে হবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে।

আইনের ধারা ৩(২)-এ বলা হয়েছে, ‘সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন দ্বারা, ব্যাংক কোম্পানি আইন-১৯৯১ এবং ব্যাংক কোম্পানি সংক্রান্ত আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনের সুনির্দিষ্ট বিধানসমূহ এ  ব্যাংকের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য করতে পারবে।’

ধারা ৪(১)-এ বলা হয়েছে, ‘গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ ১৯৮৩-এর অধীনে প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক এমনভাবে বহাল থাকিবে যেন উহা এ আইনের অধীন প্রতিষ্ঠিত হইয়াছে।’

আইনের ৬ ধারায় অনুমোদিত মূলধন ১ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণ করার পাশাপাশি বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক ইহার অনুমোদিত মূলধন সরকারের পূর্বানুমতিক্রমে সময় সময় বৃদ্ধি করতে পারবে।’

ধারা ৭-এ পরিশোধিত মূলধন ৩০০ কোটি টাকায় বৃদ্ধি করে সরকারের জন্য শতকরা ২৫ ভাগ এবং ৭৫ ভাগ শেয়ারহোল্ডারদের (ঋণগ্রহীতা) জন্য নির্ধারণ করা হয়েছে।

ধারা ৮(২)-এ বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক উহার কার্যাদি সম্পাদনে জনস্বার্থের প্রতি যথাযথ গুরু প্রধান করিয়া সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে; তবে শর্ত থাকে যে, সরকারের সহিত পরামর্শক্রমে ব্যাংক সকল নীতিগত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিবে।’

ধারা ৯-এ বোর্ড গঠনে পরিচালকের সংখ্যার ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘সরকার কর্তৃক নিযুক্ত তিনজন ব্যক্তি ও বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে ঋণগ্রহীতা-শেয়ারহোল্ডারগণ কর্তৃক নির্বাচিত ৯ জন ব্যক্তির সমন্বয়ে বোর্ড গঠিত হবে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদাধিকার বলে বোর্ডের পরিচালক হবে কিন্তু তার কোন ভোটাধিকার থাকবে না।’

ধারা ৯(১)-এ চেয়ারম্যান নিয়োগের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘বোর্ডের একজন চেয়ারম্যান থাকিবেন, যিনি সরকার নিযুক্ত পরিচালকগণের মধ্য হইতে সরকার কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন।’

ধারা ১১(১)-তে পরিচালকদের মেয়াদের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘নির্বাচিত পরিচালকদের কার্যকাল হইবে প্রতি মেয়াদে সর্বোচ্চ তিন বছর।’

ধারা (২)-এ বলা হয়েছে, ‘সরকার কর্তৃক নিযুক্ত পরিচালকগণ তাদের নিজ নিজ পদে সরকারের সন্তুষ্টি অনুযায়ী প্রতি মেয়াদে সর্বোচ্চ তিন বছর বহাল থাকিবেন। তবে শর্ত থাকে যে, কোন ব্যাংক-কোম্পানির ব্যবস্থাপনা পরিচালক বা প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা যে নামেই অভিহিত হউক না কেন, তিনি ব্যতীত অন্য কোনো পরিচালক একাধিক্রমে দুই মেয়াদের অধিক উক্ত পদে অধিষ্ঠিত থাকিতে পারিবেন না।’

ধারা (৩)-এ বলা হয়েছে, ‘উপধারা (১) অনুসারে কোন পরিচালক একাধিক্রমে ২ মেয়াদে পরিচালক পদে অধিষ্ঠিত থাকিলে দ্বিতীয় মেয়াদ শেষ হইবার তারিখ হইতে পরবর্তী ৩ বতৎসর অতিবাহিত না হওয়া পর্যন্ত উক্ত ব্যাংকের পরিচালক পদে পুনঃনির্বাচিত হইবার যোগ্য হইবেন না।’

ধারা ১৪-এ ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘(১) ব্যাংকের একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক থাকিবেন, যিনি উপধারা (২)(৩)-এর বিধান অনুসারে বাছাইকৃত কমিটির সুপারিশকৃত তিনজন প্রার্থীর প্যানেল হইতে বোর্ড কর্তৃক, বাংলাদেশ ব্যাংকের পূর্বানুমোদনক্রমে নিযুক্ত হইবেন।’

‘(২) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য প্রার্থী বাছাইয়ের উদ্দেশ্যে চেয়ারম্যান বোর্ডের সহিত পরামর্শক্রমে অন্যূন ৩ জন এবং অনধিক ৫ জন সদস্য সমন্বয়ে একটি বাছাই কমিটি গঠন করিবেন।’
‘(৩) ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য বাছাই কমিটি ৩ জন প্রার্থীর একটি প্যানেল সুপারিশ করিবে এবং গ্রামীণ অর্থনীতি, অর্থনীতি বা ক্ষুদ্র অর্থায়নের ক্ষেত্রে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতাসম্পন্ন ব্যক্তিগণকে অগ্রাধিকার প্রদান করা হইবে।’

‘(৪) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংকের সার্বক্ষণিক কর্মকর্তা ও প্রধান নির্বাহী হইবেন এবং তিনি বিধি দ্বারা নির্ধারিত অন্যান্য শর্তাধীনে অনধিক ৬০ বৎসর বয়স পর্যন্ত চাকরিতে বহাল থাকিবেন।’

উপধারা (৫)-এ বলা হয়েছে, ‘ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ শূন্য হইলে নতুন ব্যবস্থাপনা পরিচালক কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদনক্রমে, বোর্ড কর্তৃক মনোনীত ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কোন কর্মকর্তা ব্যবস্থাপনা পরিচালকের দায়িত্ব পালন করিবেন।’

ধারা ১৬(২)-এ বোর্ডের সভার কোরামের সদস্যসংখ্যা আগের ৪ জনের স্থলে তিনজন করা হয়েছে। এই ধারার উপধারা (২)-এ বলা হয়েছে, ‘উপধারা (২) যাহাই থাকুক না কেন, নির্বাচিত পরিচালকদের পদ শূন্য হইলে বিধি দ্বারা নির্ধারিত পদ্ধতিতে পরিচালক নির্বাচন না হওয়া পর্যন্ত চেয়ারম্যান এবং সরকার কর্তৃক নিযুক্ত অপর ২ জন পরিচালকের উপস্থিতিতে সভার কোরাম হইবে।’

ধারা ২২-এ হিসাবের ব্যাপারে বলা হয়েছে, ‘ব্যাংক বার্ষিক আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুত করিবে এবং আর্থিক প্রতিবেদন প্রস্তুতকালে দেশে প্রচলিত বিধিবিধান ও হিসাবমান এবং বাংলাদেশ ব্যাংক কর্তৃক এতদুদ্দেশ্যে নির্দেশিত হিসাবমান পরিপালন করিবে।’

ধারা ২৪-এ রিটার্ন, প্রতিবেদন ও বিবরণী বিষয়ে সরকারের পাশাপাশি বাংলাদেশ ব্যাংকের কাছে পেশ করার বিধান করা হয়েছে।

আইনে মিথ্যা বিবরণ, প্রসপেক্টাস বা বিজ্ঞাপনে ব্যাংকের নাম ব্যবহারের জন্য অর্থদ- ও কারাদ-ের বিধান রাখা হয়েছে।

প্রস্তাবিত আইনের ৩২ ধারায় আয়কর অধ্যাদেশ ১৯৮৪’র অধীনে আয়ের ওপর প্রদেয় আয়কর থেকে সরকার কর্তৃক অব্যাহতির বিধান রাখা হয়েছে।

৩৪ ধারায় সরকারকে বিধি প্রণয়নের ক্ষমতা দিয়ে বলা হয়েছে, সরকার, সরকারি গেজেট প্রজ্ঞাপন দ্বারা এই আইনের উদ্দেশ্য পূরণকল্পে বিধি প্রণয়ন করিতে পারিবে।

আইনের উদ্দেশ্য ও কারণ সংবলিত বিবৃতিতে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, সামরিক শাসন আমলে জারি করা সব অধ্যাদেশ সুপ্রিমকোর্ট কর্তৃক বাতিল ঘোষিত হওয়ায় এবং পরবর্তীতে অনুরূপ বাতিল করা অধ্যাদেশ হালনাগাদকরণপূর্বক বাংলা ভাষায় আইন প্রণয়ন সংক্রান্ত মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্ত অনুসারে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ-১৯৮৩ রহিত করে প্রযোজ্য ক্ষেত্রে সংশোধন ও পরিমার্জনক্রমে যুগোপযোগী করার জন্য বাংলা ভাষায় গ্রামীণ ব্যাংক আইন-২০১৩ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থমন্ত্রী আরও বলেন, গ্রামীণ ভূমিহীন দরিদ্র জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের সেবামূলক কার্যক্রমের মধ্যে ঋণ বিতরণ ও অন্যান্য সহায়তা প্রদানের লক্ষ্যে গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশের অধীনে গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করা হয়। গ্রামাঞ্চলে বসবাসরত ব্যাপক জনগোষ্ঠীর কাছে গ্রামীণ ব্যাংকের সেবামূলক কার্যক্রম সম্প্রসারণ, ওই ব্যাংকে সরকার নিয়ন্ত্রিত সংস্থার মালিকানা বহাল রেখে ঋণগ্রহীতা সদস্যদের শেয়ার মালিকানা অর্জনের সুযোগ বৃদ্ধির লক্ষ্যে এ আইন প্রণয়ন করা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here