kalerkantho-asd-roundtable-photo

সাজ্জাদুল আলম তনয় :: একজন গৃহকর্মী প্রতি ঘন্টায় মাত্র ৩ টাকা আয় করছেন। এ সময়ে মধ্যে তাকে বিভিন্ন ঝুঁকিপূর্ণ কাজসহ শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হতে হচ্ছে। বাদ যাচ্ছে না গৃহকর্তার যৌন হয়রানিও। এমন নির্যাতনে গত পাঁচ বছরে ১৮৩ জন গৃহকর্মী মারা যায় এবং আরো ১৪৩ জন আহত হয়। সামান্য অর্থের বিনিময়ে অমানুষিক পরিশ্রম করা এসব গৃহকর্মীর জন্য সরকার গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি-২০১৫ প্রণয়ন করেছে। গৃহকর্মীদের সুরক্ষার জন্য বিদ্যমান নীতিমালাকে আইনে পরিণত করার দাবি জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

আজ শনিবার সকালে (২৬ নভেম্বর) রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় কালের কণ্ঠ‘র কনফারেন্স কক্ষে আয়োজিত ‘গৃহকর্মীর সুরক্ষা ও বর্তমান অবস্থা’ শীর্ষক গোলটেবিল আলোচনায় এই তথ্য জানানো হয়। বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন ফর সোস্যাল ডেভেলপমেন্ট (এএসডি) ও কালের কণ্ঠ যৌথভাবে গোলটেবিল আলোচনার আয়োজন করে।

সেমিনারে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন এএসডির ডিসিএইচআর প্রজেক্টের প্রকল্প ব্যবস্থাপক ইউকেএম ফারহানা সুলতানা। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে চার লাখ ২১ হাজার গৃহকর্মী রয়েছে। যাদের মধ্যে সোয়া লাখ হচ্ছে শিশু গৃহকর্মী। যাদের ৮০ ভাগই মেয়ে। এসব শিশু গৃহকর্মীর ৬৬ ভাগ মানসিক ও ৭ ভাগ যৌন নির্যাতনের শিকার। এসব গৃহকর্মীরা প্রতিদিন ১৪-১৮ ঘন্টা কাজ করছেন। বিনিময়ে মাসিক গড়ে পারিশ্রমিক হচ্ছে এক হাজার ২৬৬ টাকা পাচ্ছে। সে হিসেবে প্রতি ঘন্টায় পারিশ্রমিক হচ্ছে মাত্র ৩ টাকা’ বিলসের এক গবেণার তথ্য তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘গৃহকর্মীদের ৫০ শতাংশ গৃহকর্তার দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। আর যৌন নির্যাতনের শিকার এসব গৃহকর্মীদের ৫০ ভাগই শিশু।’

প্রতিবেদনে বলা হয়, শিশু গৃহকর্মীদের অধিকার প্রতিষ্ঠায় এএসডি ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে। গত তিন বছরে গৃহকর্মী নির্যাতন প্রতিরোধে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে আলোচনা করা হয়েছে। গণমাধ্যম ক্যাম্পেইনসহ বিভিন্ন সভা সেমিনারের আয়োজন করা হয়েছে। এর ফলাফলও পাওয়া গেছে বলে প্রতিবেদনের উল্লেখ করা হয়। প্রতিবেদনের আরো বলা হয়, এএসডি গৃহকর্তার সঙ্গে কথা বলে ১৩ জন শিশুকে বিদ্যালয়ে পাঠাতে সক্ষম হয়েছে। ৪৫ জন গৃহকর্মীকে কারিগর প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে গড়ে তোলা হয়েছে। এর পাশাপাশি ভাষা ও আচরণগত পরিবর্তন করে গৃহকর্মে তাদের সম্মান বৃদ্ধিতে সহায়তা করছে।

কালের কণ্ঠ‘র সম্পাদক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলনের সঞ্চালনায় সেমিনারে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন শ্রম ও কর্মসংস্থান প্রতিমন্ত্রী মো. মুজিবুল হক চুন্নু। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন বরিশাল-৫ আসনের সংসদ সদস্য বেগম জেবুন্নেছা আফরোজ। গোলটেবিল বৈঠকে আরো বক্তব্য রাখেন পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার (ডিআইজি), নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল  প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন, সমাজসেবা অফিসার কেএম শহিদুজ্জামান, এএসডির নির্বাহী পরিচালক জামিল এইচ চৌধুরী, উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন আরা লেখা, ব্লাস্টের সখি প্রজেক্টের টিম লিডার ব্যারিস্টার নাজরানা ইমান, বিএসএমইউ এর ডা. ইশরাত শর্মী, অভিনেত্রী অঞ্জনা, এএসডির উপ-নির্বাহী পরিচারক মো. মোজাম্মেল হক, এসওএস শিশু পল্লীর প্রকল্প পরিচালক সাইফুল ইসলাম, উন্নয়ন কর্র্মী সাকিলা পারভীন, কবি ও গণমাধ্যম কর্মী তাহমিনা শিল্পী, কোয়ালিশন ফর আরবান পূয়র এর নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবেকা সান-ইয়াত, অপারেজয় বাংলাদেশের সমন্বয়কারী সাফিয়া সামি, ডন ফোরামের চেয়ারপার্সন মো. মাহবুবুল হক প্রমুখ।

শ্রম প্রতিমন্ত্রী মুজিবুল হক বলেন, ‘আমাদের ঘরে টিভি রাখার জন্য জায়গা থাকে। কিন’ যারা আমাদের ঘরে ১২-১৪ ঘন্টা কাজ করে, তাদের থাকার জন্য কোনো জায়গা থাকে না। তারা কখনো ড্রয়িং রুমে, কখনো রান্না ঘরে থাকে।  আমার এসব গৃহকর্র্মীর সুরক্ষার জন্য নীতিমালা করেছি। এবার তা দ্রুত আইনে পরিণত করা হবে বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।’তিনি বলেন, ‘শুধু আইন ও নীতিমালা করলেই হবে না। আমাদর বিবেক যদি জাগ্রত না হয়, আমরা যদি সচেতন না হই, কবে তা কোনো কাজে আসবে না।’

শ্রম প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘গৃহকর্মী সুরক্ষা ও শিশুশ্রম হ্রাসের জন্য জেলা ও উপজেলা পর্যায়ে কমিটি করেছি। আশা করছি, আগামী ২০২৫ সালের  মধ্যে তা সম্পূর্ণরূপে হ্রাস করতে পারবো। এছাড়া সন্তানসম্ভবা গৃহকর্মীর জন্য ২০ হাজার টাকা, তাদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানের জন্য এককালীন তিন লাখ টাকা এবং মারা গেলে দুই লাখ টাকা দেওয়া হবে।’

কালের কণ্ঠ‘র সম্পাদক কথাসাহিত্যিক ইমদাদুল হক মিলন বলেন, ‘এখন অনেক টিভি চ্যানেল থাকলেও তারা মূল কাজ থেকে সরে এসেছে। এসব টিভি, সংবাদমাধ্যম, এবং অনলাইন পত্রিকাগুলোতে শিশু গৃহকর্মীদের নিয়ে অনুষ্ঠান এবং সংবাদ প্রচার করতে মন্ত্রণালয় থেকে নির্দেশ দেওয়া উচিত। শিশুদের নিয়ে সরকার কাজ করলেও এই কাজগুলোর মাঝে কিছু গ্যাপ আছে, যা পূরণ করা উচিত।, তিনি বলেন, ‘যে যার জায়গা থেকে যদি কাজগুলো করি, তবে সমাজের অনেক পরিবর্তন সম্ভব। তবে আমরা সবকিছু মনে রাখি। শুধু সেবার করার জায়গাটা ভুলে গেছি। আর মন্ত্রণালয় থেকে নীতিমালা করে পকেটে নিয়ে ঘুরলে হবে না। তার প্রয়োগের পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর জন্য কাজ করতে হবে।’

সংসদ সদস্য জেবুন্নেসা আফরো বলেন, ‘আইন ও নীতিমালা নয়, আগে নিজেকে বদলাতে হবে। গৃহকর্মীদের নিজেদের সস্থান হিসেবে মনে করতে হবে। যারা আমাদের ভালো থাকার জন্য কাজ করছে, তাদের ভালো থাকার জন্য আমাদের কাজ করা উচিত।’

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘আইন করতে গেলে শিশু শ্রমিক নিয়োগ দেওয়া যাবে না। তাহলে এসব শিশুদের কী হবে। তাই এদের গৃহকর্মী নিযুক্তির পাশাপাশি সুরক্ষার বিষয়টিতেও নজর দিতে হবে।’

এএসডির নির্বাহী পরিচালক জামিল এইচ চৌধুরী বলেন, ‘আমরা নারী ও শিশুদের অধিকার নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে কাজ করে আসছি। ঢাকা শহরে বিভিন্ন এলাকায় তাদের নিয়ে কাজ করছি। তাদের বিভিন্ন ভোকেশনাল শিক্ষাসহ প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি। এ পর্যন্ত শতাধিক গৃহকর্মীকে প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের কর্মক্ষেত্র পরিবর্তন করতে সাহায্য করেছি।

উত্তরা ইউনিভার্সিটির উপ-উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইয়াসমিন আরা লেখা বলেন, ‘শিশুদের মানব আপদ নয়, মানবসম্পদ হিসেবে দেখতে হবে। এজন্য সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলা জরুরি। কারণ সরকারের একার পক্ষে সবাইকে সচেতন করা সম্ভব নয়।’

সমাজসেবা অফিসার কেএম শহিদুজ্জামান বলেন, নির্যাতনের ক্‌থা জেনেও গৃহকর্মীদের অভিভাবকরা তাদের শিশুদের উদ্ধার করে না। কেননা, তাহলে তারা টাকা পাবে না। মেয়ে মানেই উপার্জনের উৎস গ্রাম-গঞ্জে এমন দৃষ্টিভঙ্গি রয়েছে। এর পরিবর্তন দরকার।

নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল  প্রোগ্রামের প্রকল্প পরিচালক ড. আবুল হোসেন বলেন, গৃহকর্মী সুরক্ষা নীতিকে বাস্তবায়ন করতে হলে একটি অ্যাকশন প্লান দরকার। এছাড়া একটি মনিটরিং সেল থাকা উচিত। যেখানে সরকারি- বেসরকারি প্রতিনিধিরা থাকবে।

নাজরানা ইমান বলেন, ‘আমরা ১৫টি বস্তিতে কাজ করছি। এখানে সে সব গৃহকর্মী আছে, তাদের সন্তানদের শিক্ষার জন্য সহায়তা দিচ্ছি।’

ডা. ইশরাত শর্মী বলেন, ‘প্রতিটি অ্যাপাটমেন্টে যদি সচেতনতা বাড়ানো যায়, তবে গৃহকর্মী নির্যাতন অনেক কমে আসবে।’

গণমাধ্যমকর্মী তাহমিনা শিল্পী বলেন, শিশুদের অনুষ্ঠানে বিজ্ঞাপনদাতারা স্পন্সর করতে চায় না। এ বিষয়ে সবাইকে এগিয়ে আসা দরকার।

অভিনেত্রী অঞ্জনা বলেন, সবার আগে ফ্যামিলি প্লানিং দরকার। গৃহকর্মী সুরক্ষায় সবার আগে আমাদের মন-মানসিকতা ঠিক করতে হবে। যতদিন পর্যন্ত না এটা ঠিক হবে ততদিন পর্যন্ত সরকার কিছুই করতে পারবে না।

এসওএস শিশু পল্লীর প্রকল্প পরিচালক সাইফুল ইসলাম বলেন, অবহেলাও একটি নির্যাতন যা সবার চোখে পড়ে না। তাই নির্যাতন হিসেবে এটিকেও আনা দরকার।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here