সাবেক পূর্ব জার্মানিতে খেলোয়াড়দের নিষিদ্ধ মাদক দেওয়াটা কোনো নৈতিক প্রশ্নের মধ্যে পড়তো না৷ কিন্তু এ ব্যাপারে জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলও যে বিশেষ এগিয়ে ছিল না – তার প্রমাণ পাওয়া গেল এবার৷

‘ডোপিং’ মানেই বিতর্ক! লঘু পাপে গুরু দণ্ড – নাকি গুরু পাপে লঘু দণ্ড? মজার বিষয়, ১৯৮৯ সালে কম্যিউনিস্ট পূর্ব জার্মানির পতনের পর, তাদের ‘ডোপিং সিস্টেম’ সংক্রান্ত নানা তথ্য উদ্ঘাটন করেন বিশেষজ্ঞরা৷ দেখা যায়, খেলোয়াড়দের শরীরে শক্তিবর্ধক নিষিদ্ধ ড্রাগ ‘ইনজেক্ট’ করার মতো একটা কাজকে ‘পাপ’ বলে ধরাই হতো না সেখানে৷ দণ্ড দেওয়া তো দূরের কথা! তবে এই ইতিহাসিক সত্যটা নতুন কিছু নয়৷ সে আমলে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় সাধারণের চেয়ে অনেক বেশি উন্নতমানের ফলের আশায় যে ক্রীড়াবিদ, বিশেষ করে নারীদের নিষিদ্ধ ওষুধ দেওয়ার একটা চল ছিল – সেটা অনেকেরই জানা৷

এমনকি সে সময় জার্মানির ‘পূর্ব’ দিক বা জিডিআর-এর মানুষদের এই নেতিবাচক দিকটা নিয়ে পশ্চিমের মানুষরা একরকম হাসি-ঠাট্টাই করতো৷ কিন্তু, সম্প্রতি জার্মানির দু-দু’টি বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিকরা গবেষণা করে দেখিয়ে দিয়েছেন যে, নৈতিকতার বিচারে তৎকালীন পশ্চিম জার্মানিতেও সবাই ‘সত্যবাদী যুধিষ্ঠির’ ছিল বলা যায় না৷

জার্মানির উত্তরে অবস্থিত ম্যুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয় এবং রাজধানী বার্লিনের বিখ্যাত হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা জানান, একটা সময় ছিল, মূলত দুই জার্মানির পুনরএকত্রিকরণের আগে – যখন, দুই জার্মানিতেই খেলোয়াড়দের নিষিদ্ধ মাদক দেওয়াটা রীতিমত প্রচলিত একটা ব্যাপার ছিল৷

পঞ্চাশ এবং ষাটের দশকের নথিপত্র ঘেঁটে সেরকম কোনো প্রমাণ পাওয়া না গেলেও, ১৯৭২ সালে মিউনিখ অলিম্পিক্স গেমস-এর সময় ‘ডোপিং’-এর ঘটনা অত্যন্ত প্রকট আকার ধারণ করে৷ আশ্চর্যের বিষয়, নিষিদ্ধ মাদক যে খেলোয়াড়দের শরীরে প্রয়োগ করা হচ্ছে – সে সম্পর্কে ক্রীড়া বিষয়ক কর্মকর্তা তো বটেই, ক্রীড়াবিদ, তাঁদের ডাক্তার, এমনকি রাজনীতিকরাও ওয়াকিবহাল ছিলেন৷ আর ঐ নিষিদ্ধ ‘ড্রাগ’-এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি প্রচলন ছিল শক্তি বৃদ্ধিকারী ‘অ্যানাবোলিক’ ওষুধের৷

হুমবোল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের গিজেলহের স্পিটসার বলেন, ‘‘আমাদের গবেষণায় আমরা এটাই দেখাতে চেষ্টা করেছি, সে সময়কার মানুষ আসলেই কতোটা ঐ ড্রাগগুলো সম্পর্কে জানতেন৷ আমাদের বিশ্বাস সে সময় ‘ডোপিং’-এর পুরো ঘটনাই ঘটতো একেবারে জেনে বুঝে৷ আমরা তৎকালীন ডাক্তার, ফিজিওথ্যারাপিস্ট, খেলোয়াড় – অনেকের সঙ্গেই কথা বলেছি৷ তাতে এ ব্যাপারটা একেবারে স্পষ্ট হয়ে গেছে৷ তাছাড়া, নিয়মিত ‘ডোপিং’-এর ফলে তখনকার বহু ক্রীড়াবিদেরই স্বাস্থ্যের ভয়ানক ক্ষতি হয়েছিল বলেও জানতে পেরেছি আমরা৷”

দুঃখের বিষয়, খেলোয়াড়দের স্বাস্থ্য নিয়ে একেবারেই চিন্তিত ছিলেন না পূর্ব জার্মানির কর্মকর্তারা৷ আর সেই খেলোয়াড় ও ক্রীড়াবিদদের তালিকায় নারী এবং অপ্রাপ্তবয়স্করাও ছিলেন, জানান অধ্যাপক স্পিটসার৷ ম্যুনস্টার বিশ্ববিদ্যালয়ের মিশায়েল ক্রুগার অবশ্য স্পিটসার’এর সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে একমত নন৷ তাঁর কথায়, ‘‘জার্মানির পশ্চিমাঞ্চলের সর্বত্র একেবারে নিয়ম করে ডোপিং করা হতো, এই মত আমরা মানতে রাজি নই৷ রাজনৈতিক ব্যবস্থাটা ছিল ভিন্ন৷ পশ্চিমে অ্যাথলেটদের মাদক দিতে চিকিৎসকদের বাধ্য করার কোন রাষ্ট্রীয় নির্দেশনামা ছিলনা কখনও৷ তবে পুব আর পশ্চিমের মধ্যে অবশ্যই প্রতিযোগিতার এক পরিবেশ ছিল, যার ফলে জার্মানির পশ্চিমের অন্তত কোন কোন অংশে ডোপিং ঘটেছিল৷”

বর্তমানে অবশ্য সবকটি দেশই আন্তর্জাতিক অলিম্পিক কমিটি বা আইওসি-র ‘অ্যান্টি ডোপিং’ আইন মেনে চলে৷ এতোদিন পর্যন্ত ‘ডোপিং’-এর অভিযোগে কোনো অ্যাথলেট’এর ওপর যদি ৬ মাসের বেশি সময় ধরে নিষেধাজ্ঞা থাকতো, তাহলে তিনি পর পর দুটি অলিম্পিকে অংশ নিতে পারতেন না৷ সম্প্রতি সে আইনের বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে ক্রীড়া আদালত৷ বলাই বাহুল্য, এ রায়ে খুশি নন আইওসি-এর প্রেসিডেন্ট জাক রগে৷ তিনি বরাবরই ‘ডোপিং’-এর মোকাবিলায় কড়া নিয়মের পক্ষে সওয়াল করেছেন৷ তাই শোনা যাচ্ছে, ২০১৩ সালে ডোপিং সংক্রান্ত নতুন নিয়মাবলি কার্যকর হওয়ার আগে তার মধ্যেও কড়া নিয়ম ঢোকানোর উদ্যোগ নিতে চান তিনি৷

আসলে নিজের ক্ষমতা ও দক্ষতার ওপর নির্ভর না করে, ওষুধ ও মাদক জাতীয় নানা শক্তিবর্ধকের সাহায্যে সাফল্য পেতে অনেক খেলোয়াড় ও কর্মকর্তাই ‘ডোপিং’-এর আশ্রয় নিতেন, এখনও নেন৷

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/ডেস্ক রিপোর্ট

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here