গাজনার বিল প্রকল্পকলিট তালুকদার, পাবনা প্রতিনিধি :: ৪১৯ কোটি টাকা ব্যয়ে পাবনার গাজনার বিল প্রকল্পের কাজ দীর্ঘ সাত বছরেও বাস্তবায়িত হয়নি। জেলার ৫টি দপ্তরের অধিনে এ প্রকল্পের কাজ চলছে। এদিকে মূল প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই শেষ হয়ে গেছে মৎস, পশু সম্পদ, এলজিইডি এবং বন বিভাগের কাজ। অপর দিকে বারবার মেয়াদ বাড়িয়ে এবং প্রকল্প ব্যয় অর্ধশত কোটি টাকা বাড়ানোর পরেও খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে পানি উন্নয়ন বোর্ডের কাজ।

পাবনা-২নির্বাচনী এলাকার (সুজানগর-বেড়া) সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক পরিকল্পনা মন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খোন্দকারের চেষ্টায় গাজনার বিল উন্নয়ন প্রকল্পটি গ্রহণ করা হয়। দেশের উত্তরবঙ্গের অন্যতম বৃহৎ বিল পাবনার সুজানগর উপজেলার গাজনার বিল প্রকল্পের কাজ শুরু হয় ২০১০-১১ অর্থ বছরে। প্রকল্পটি বাস্তবায়নের মেয়াদ ছিল তিন বছর।

কাজের মূল লক্ষ্য ছিল পানি নিস্কাষনের মাধ্যমে বিলের জলাবদ্ধতা এবং বন্যামুক্ত করে এক ফসলী জমিকে তিন ফসলী জমিতে রূপান্তর, সেচ সুবিধা সম্প্রসারণ করে বর্ধিত ফসল উৎপাদন এবং দেশীয় প্রজাতির মাছের বংশ বৃদ্ধি করে বনভূমি তৈরি করা। অথচ সাত বছর অতিবাহিত হলেও প্রকল্পটি বাস্তবায়ন না হওয়ায় বিল এলাকার অধিবাসীদের স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়নি। তবে প্রকল্পের মূল উদ্দেশ্য বাস্তবায়ন না হলেও প্রকল্পটির কাজ করে ইঞ্জিনিয়ার ও ঠিকাদাররা বেশ লাভবান হয়েছেন।

সরেজমিন প্রকল্প এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, পানি উন্নয়ন বোর্ড ৬৮ কিলোমিটার খাল খনন করেছে অথচ সে খাল দিয়ে পানি নিস্কাষণ হয় না। তিন ফসল তো দূরের কথা এক ফসল আবাদ করাই এখন বিলবাসীর জন্য দূরুহ হয়ে পড়েছে। সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতায় ফসল বিনষ্ট হয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকরা। বিলের মধ্যে দিয়ে আত্রাই নদী প্রবাহিত হয়েছে। ভাটশালা গ্রামের উপর দিয়ে প্রবাহিত এই নদীর একপাশে স’পাকারে মাটি রাখা হয়েছে।

এলাকাবাসীর অভিযোগ নদী খননের নামে এভাবে মাটি রেখে প্রবাহমান নদীটির গতি রোধ করা হয়েছে, তাতে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে কৃষকেরা। তবে পাবনা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকেশলী আব্দুল হামিদ বলেছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে সুফল পাবে কৃষকেরা। তিনি কাজ বিলম্বের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ এবং নকশা সংক্রান্ত জটিলতাকেই দায়ী কলেছেন।

এদিকে গাজনার বিলের চর দুলাই-পোতাজিয়া বিল অংশে ১১ লাখ ২৫ হাজার টাকা ব্যয়ে মাছের অভয়ারণ্য করেছে মৎস বিভাগ। সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেল, ডাঙায় একটি সাইন বোর্ড রয়েছে। সাইন বোর্ডের পেছনে মাঠ এবং তার পাশে ছোট্ট একটি জলাশয় রয়েছে। মৎসজীবীরা জানায়, উল্লেখিত স্থানে এখন আর মাছের অভয়াশ্রমের অস্তিতই নেই। শুধু এখানেই নয় অধিকাংশ অভয়াশ্রমের একই দশা। যদিও প্রকল্প এলাকায় এসব অভয়াশ্রম করার আসল উদ্দেশ্য ছিল মাছের পোনা অবমুক্ত করে এবং বাইরের নদী থেকে পোনা বিলে প্রবেশের মাধ্যমে দেশীয় মাছের বংশ বৃদ্ধি করা। এই অভয়াশ্রমের জন্য মৎস বিভাগের জন্য বরাদ্দ ছিল ৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা।

পাবনা জেলা মৎস্য বিভাগের নির্বাহী কর্মকর্তা গোলাম মওলা জানান, নির্ধারিত সময়ের মধ্যেই প্রকল্পের কাজ শেষ করে চলে গেছেন, প্রকল্প পরিচালক। তবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ এবং খাল খনন কাজ শেষ হওয়ার আগেই বিলে মাছের অভয়শ্রম এবং দেশীয় মাছের বংশ বৃদ্ধির কাজ নিয়ে সংশয় থেকেই যাচ্ছে। গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্প এখনো বাস্তবায়িত না হলেও ৫ বছর আগেই বনায়নের কাজ শেষ হয়েছে।

তবে পাবনা বন বিভাগ কর্তৃক বাস্তবায়িত এই প্রকল্পের গাছের কোন অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। খোদ বন বিভাগের তদন্তেই হরিলুটের চিত্র পাওয়া গেছে। অথচ প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য ছিল বনায়ন। প্রকল্পের পানি নিস্কাষণ এবং সেচ খাল খননের পর এসব খালের দুধারের পাড়ে গাছ লাগানোর দায়িত্ব ছিল বন বিভাগের। এর জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছিল ৮৬ লাখ টাকা। চার বছর আগে সেচ খাল খনন এবং দু’পাড়ের ডাইক নির্মাণ সমাপ্ত না হলেও বন বিভাগ তার সমস্ত টাকা খরচ দেখিয়ে কাজ গুটিয়ে ফেলেছে। যদিও গাছের কোন অস্তিত্বই নেই। বৃক্ষ রোপনকে সামাজিক আন্দোলনে পরিণত করার লক্ষে প্রকল্প এলাকায় যে নার্সারী সমূহ করার কথা ছিল সেগুলো সাইন বোর্ড স্বর্বস্ব। নাই কোন লোকবল এবং নার্সারীতে কোন চারাও নেই।

এ ব্যাপারে পাবনার বিভাগীয় বন কর্মকর্তা কবির হোসেন পাটোয়ারি বলেন, ‘আমি সম্প্রতি এই জেলায় যোগদান করেছি, এই প্রকল্প সর্ম্পর্কে কিছুই অবহিত নই’। তবে এই প্রকল্প নিয়ে অভিযোগ উঠলে বন বিভাগ একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে। সরেজমিন তদন্ত শেষে গত ১০ এপ্রিল একটি তদন্ত রিপোর্ট মেলে। এই রিপার্ট মোতাবেক ২০ হাজার বৃক্ষ রোপনের কথা থাকলেও গাছের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে মাত্র ৮শ ৬০টি। চারটি নার্সারী থেকে কি পরিমান গাছ পাওয়া এবং বিতরণ করা হয়েছে তার কোন পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি।

এছাড়াও নার্সারীর খাতা পত্রে থাকা ২৭ হাজার ৭’শ ৫৪টি চারার কোন হদিস পাওয়া যায়নি। এভাবে তদন্ত কমিটি ১৭ লাখ ৫১ হাাজার ১৯৮ টাকা লোপাটের অভিযোগ দাখিল করেন। ফরেস্ট রেঞ্জারাস ও তদন্ত কর্মকর্তা মির্জা মাহবুবুল আলম জানান, তদন্ত কমিটি প্রকল্প বাস্তবায়নে জড়িত কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশ করেছে।

এদিকে প্রকল্প বাস্তবায়নের আগেই ভেঙে গেছে চলাচলের জন্য গাজনার বিল সাবমারসিবল সড়ক। প্রায় ৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত এই সড়কের কাজের মান খুবই খারাপ। গাজনার বিল প্রকল্পের পর্যবেক্ষক গোলাম রসুল জানান, বর্ষা মৌসুমে বিল এলাকার কৃষকদের উৎপাদিত ফসল পরিবহনের সুবিধার্থে গাজনার বিল বহুমুখী প্রকল্পের আওতায় এই সড়কটি নির্মাণ করা হয় দুই বছর আগে। সড়কটির পার্শ্ব ধ্বসে গেছে, উঠে গেছে সড়কের বিভিন্ন অংশ। এ সড়কটি নির্মানের দায়িত্ব ছিল বিল প্রকল্পের অংশীদার এল জি ই ডি। এই বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী রেজাউল করিম জানান, দুই বছর আগে শেষ হওয়া এই সড়ক সংস্কার করতে হলে আরও দুই বছর অপেক্ষা করতে হবে।

গাজনার বিল উন্নয়ন প্রকল্পের অন্যতম উদ্দেশ্য হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন। সেই লক্ষেই এই সড়কসহ স্লুইস গেট নির্মাণ করা হয়। নানা অজুহাতে বারবার মেয়াদ বাড়ানো এবং প্রকল্প ব্যয় প্রায় অর্ধশত কোটি টাকা বাড়ানোর পরেও তালিমনগর স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ শেষ হয়নি। এই প্রকল্পটির কাজে অনিয়ম এবং দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। ১শ ৭২ কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া হয় এই স্লুইস গেট নির্মানের জন্য। কাজ শুরু হয় ২০১৩ এর জানুয়ারি মাসে। কাজটি শেষ করার সময় নির্ধারণ ছিল ২০১৫ এর ৩০ জুন। পরে কয়েক দফা সময় বাড়িয়ে ২০১৯ এর জানুয়ারি পর্যন্ত করা হয়েছে। ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এই কাজ যথাসময়ে শেষ না করার ব্যাপারে বলেছে, বারংবার নকশা পরিবর্তনের কারনে বিলম্ব হচ্ছে।

ওয়েস্টার্ণ ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড এর প্রকল্প প্রকৌশলী লুৎফর রহমান বলেন, গুরুত্বপূর্ণ এই কাজ বিলম্বের কারনে ব্যয় বেড়ে দাঁড়িয়েছে ২শ ২৬ কোটি টাকা। এই স্লুইস গেট নির্মাণ কাজ শেষ না হওয়ায় মূল প্রকল্পের উদ্দেশ্যই ব্যহত হচ্ছে। নির্বাহী প্রকৌশলী আব্দুল হামিদ বলেন, সুনির্দিষ্ট নকশা ছাড়াই তড়িঘড়ি করে কাজ শুরু করায় সময় ও ব্যয় দুটোই বেড়েছে। সুনির্ধিষ্ট নকশা ছাড়াই কিভাবে গুরুত্বপূর্ণ এই স্লুইস গেট নির্মানের দরপত্র আহ্বান করা হয় এবং কাজ শুরু করা হয়? এমন প্রশ্নের সদুত্তোর তিনি দিতে পারেনিনি।

গাজনার বিল প্রকল্প সংশ্লিষ্টদের দাবি এই পাম্প হাউজের উপরই নির্ভর করছে প্রকল্পের সফলতা। এটি চালু হলে গাজনার বিল এলাকার ২৭ হাজার হেক্টর জমিতে পানি নিস্কাষণ এবং ১৭ হাজার হেক্টর জমি সেচ সুবিধার আওতায় আনা সম্ভব হবে। এক ফসলী এসব জমি তিন ফসলীতে রূপান্তরিত হবে। প্রকল্প এলাকায় বছরে প্রায় পাঁচ’শ কোটি টাকার অতিরিক্ত কৃষিজ পণ্য ও দেশীয় প্রজাতির মাছ উৎপাদন করা সম্ভব হবে। এতে বিল এলাকার আড়াই লাখ মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন বা উন্নতি হবে। যমুনা নদী থেকে পানি পাম্প করে বিলে পানি প্রবেশ করানো হবে এবং বদ্ধ পানি নিস্কাষণ করা হবে এই পাম্প হাউজের মাধ্যমে।

অথচ প্রকল্পটি বাস্তবায়নে আন্ত:দাপ্তরিক সমন্বয়হীনতা, নকশা সংক্রান্ত ত্রুটি, তড়িঘড়ি করে প্রকল্প বাস্তবায়নের চেষ্টাসহ নানা অনিয়ম ও দুর্নীতির জন্য প্রকল্পের মহৎ উদ্ধেশ্য বাস্তবায়ন হওয়া নিয়ে শঙ্কা দেখা দিয়েছে।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here