হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির অনন্য এক দৃষ্টান্তমো. আলী আশরাফ খান :: আসলে ‘ঘরের আলো চোখে পড়ে না’। এই কথাটির প্রমাণ আজ আবারও পেলাম, দাউদকান্দি উপজেলার ভাগলপুর গ্রামে গিয়ে। একটি অনাকাংখিত ঘটনার সূত্র ধরেই আমাদের ওই গ্রামে যাওয়া। যদিও ১৫ মার্চ বুধবার গিয়েছিলাম ওই গ্রামে। এরপরেও আবার ১৬ মার্চ বৃহস্পতিবার (১৬ মার্চ) সকালে কয়েকজন সাংবাদিক ও সমাজকর্মী বন্ধুদের নিয়ে পৌঁছে যাই উপজেলার শহীদনগরের ভাগলপুর গ্রামে। সাংবাদিক মলিনা আক্তার মিলি, মোঃ জসিম উদিন জয়, শহিদুল্লাহ সাদা, আব্দুস সালাম সরকার ও সমাজকর্মী সাইফুল ইসলাম স্বপন, মোঃ মনির হোসেন, রাজিব হোসেন জয় প্রমুখসহ আমরা পৌঁছি ওই গ্রামে।

ওইখানে গিয়ে আমরা প্রথমে যা দেখলাম, তা বিরল ঘটনা-অনন্য এক দৃষ্টান্তই বলা যায়। একপাশে মুসলিম ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান-মাদরাসা, অন্যদিকে এর ৩০/৩৫ ফুট দূরে ‘শ্রী শ্রী মহামায়া মন্দির’ হিন্দু ধর্মের উপাসনালয়! (প্রতিষ্ঠাকাল: ১০ অক্টোবর ২০১৩ খ্রি:) এই যে, দুই ধর্মের এক মহাসম্প্রীতির মিলনমেলা-এটি নিঃসন্দেহে গবেষনার বিষয়ই বৈকি। আমরা দেখলাম, ওইখানে ‘ভাগলপুর ফকির আব্দুল হাকিম ফরিদুনেছা মাইজভান্ডারী ফোরকানিয়া মাদরাসা’, প্রতিষ্ঠাতাঃ এডভোকেট শফিউল বশর ভান্ডারী (যার প্রতিষ্ঠাকালঃ ৫ জানুয়ারি ২০১১ খ্রি:), ‘ভাগলপুর বঙ্গবন্ধু পাঠাগার’ ও ‘ভাগলপুর জোহরা অরফুল প্রাথমিক বিদ্যালয়’, এই দু’টি প্রতিষ্ঠানেরও প্রতিষ্ঠাতা একই ব্যক্তি এবং প্রতিষ্ঠাকাল একই সময়ে। এখানে ভাবনার বিষয় হলো, এডভোকেট শফিউল বশর ভান্ডারী সাহেবের এ তিনটি প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার পরেই ১০ অক্টোবর ২০১৩ খ্রিস্টাব্দে স্বর্গীয় অবনী মোহন সূত্রধর ও স্বর্গীয় সুরবালা বানী সূত্রধর ‘শ্রী শ্রী মহামায়া মন্দির’(ভাগলপুর সার্বজনিন যুগোৎসব) হিন্দু ধর্মের এ উপাসনালয়টি প্রতিষ্ঠা করেন।

উল্লেখ করার মত যে, এসব প্রতিষ্ঠানে যার যার মত করেই ধর্মকর্ম তথা নিজেদের কার্যক্রম পরিচালিত হয় এখানে। কারো কোন রকম অনুযোগ-অভিযোগ নেই। ধর্মচর্চা ছাড়াও আনন্দ-উৎসবে একে অপরের সম্পুরক তথা সৌহার্দতা লক্ষ করা যায় এসব প্রতিষ্ঠানে।

কিন্তু এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই সম্প্রীতি-সৌহার্দতাকে বিনষ্ট করতে এখানে কে বা কাহারা এমন একটি ঘটনা ঘটালো-যা কিনা দুই ধর্মের মানুষজনের মধ্যে ফাঁটল সৃষ্টি হতে পারে! ধর্মীয় উস্কানী সৃষ্টি হয়ে ঘটতে পারে লঙ্কাকা-। আমরা নিঃসন্দেহে বলতে পারি, এখানে এমন একটি দুষ্কৃতিকারী গোষ্ঠী দুর্ভিসন্ধিমূলক, ন্যক্কারজনক ও জঘন্য কর্ম সাধন করতে চেয়েছিল, যাতে কিনা আমাদের মধ্যে ধর্মীয় উস্কানী সৃষ্টি হয় এবং একটি অরাজক পরিস্থিতি তৈরি হয়। আর ্এতে করে ওই ধর্মান্ধ-মুর্খরা স্বার্থ হাসিল করার সুযোগ পায়।

আসলে মোদ্দাকথা হলো, তাদের এই অশুভ চিন্তা কখনও পূরণ হবেনা এবং হবার কথাও নয়। কেনো না, যে কোন সময়ের চেয়ে এখন মানুষ বেশ সচেতন। এছাড়া দাউদকান্দিবাসী জানে, কোন অপশক্তি কিংবা ধর্মীয় উস্কানী সৃষ্টি করা মানে রাজনৈতিক স্বার্থকে চরিতার্থ করার অপপ্রয়াস মাত্র। এখানে হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতি দীর্ঘদিনের। এখানে কোন হিন্দু-মুসলিম কোন দ্বন্দ্ব নেই-নেই কোন রকমের সংঘাত। মানুষ হিসেবে ভাই-ভাই’র মতই আমাদের সহাবস্থান। হিন্দুরা যেমন মুসলমানদেও ধর্মকর্মকে শ্রদ্ধার চোখে দেখেন তেমনি মুসলমানরাও হিন্দুদের ধর্মীয় কর্মকা–উৎসব পালনে একরকম অংশগ্রহণ এবং উৎসাহ প্রদান করতে দেখা যায়।

ওইসব কুচক্রি মহলদের মনে রাখা জরুরি, আমাদের প্রিয় দাউদকান্দি ইতিহাস-ঐতিহ্যে যেমন সমৃদ্ধ তেমনি হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির ক্ষেত্রেও এই উপজেলার রয়েছে বিরল এক অনন্য দৃষ্টান্ত। এখানে  ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে যাতপাতকে পাশ কাটিয়ে সকল ধর্মের মানুষই সহাবস্থান করছে যুগ যুগ ধরে। একে অপরের সুখে-দুঃখে সব সময় পাশে থেকেছেন-থাকছেন দুই ধর্মের মানুষজন। কারো প্রতি কারো নেই কোন অনুযোগ কিংবা অভিযোগ। এলাকার উন্নয়ন থেকে শুরু করে পুরো উপজেলার সমৃদ্ধি তথা উন্নয়নের অংশিদারিত্বে যার যার অবস্থান থেকে সবাই আন্তরিকতার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন-এই দুই ধর্মের লোকজন।

পরিশেষে আমরা বলবো, গত ১৪ মার্চ ’১৭ খ্রি: মঙ্গলবার রাতে উপজেলার শহীদনগর ভাগলপুরের মদরাসায় দুষ্কৃতিকারীরা যে ঘটনা ঘটিয়েছে তা দুর্ভিসন্ধিমূলক একদল মাদকাসক্তদের কাজ। এই ঘটনায় কোন ধর্মের কোন সুস্থ মস্তীস্কের লোকজন জড়িত নয়-থাকতে পারেনা। যারা এই কাজ করেছে তারা মানুষের সংজ্ঞায় পড়ে না। সুতরাং এই বিষয়টি নিযে কোন রকম উস্কানী কিংবা ভ্রান্ত প্রচার-প্রচারণা কোনভাবেই কাম্য নয়। কেউ তা মেনে নেেেব না-মানতে পারে না।

হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির অনন্য এক দৃষ্টান্তআমরা যতটুকু জানতে পেরেছি, এই বর্বর ঘটনার সঙ্গে জড়িত দুষ্কৃতিকারীদের অন্যতম আসামী হাবিবুর রহমান (৩৩) কে গ্রেফতার করেছে দাউদকান্দি মডেল থানা পুলিশ।

ওই দুষ্কৃতিকারী হাবীব একজন পেশাদার মাদক বিক্রেতা ও মাদকাসক্ত। হাবীব বরিশালের গৌরনদী থানার মেধাকুল বেপারী পাড়া গ্রামের শাহ আলীর কুলাঙ্গার পুত্র । ১৬ মার্চ ‘১৭ বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয় তাকে। সে কুমিল্লা বিজ্ঞ সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে পবিত্র কুরআন শরীফ অবমাননার কথা স্বীকার করেছে। এবং একাজে আরো যারা জড়িত তাদেরকে ধরতে চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন পুলিশ।

এছাড়াও আমরা ওই এলাকার প্রায় অর্ধ্বশত হিন্দু-মুসলিম পরিবারের নারী ও পুরষ, স্কুল ও কলেজ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে আলাপ করে জেনেছি যে, তারা সবাই সুখে-শান্তিতে ওই এলাকায় যুগ যুগ ধরে বসবাস করছেন। বিশেষ করে হিন্দু ধর্মালম্বীরা জানান, এই এলাকার মুসলমানরা সব সময় তাদেরকে বিভিন্নভাবে সহযোগিতাসহ আন্তরিকতার সঙ্গে ধর্মীয় উৎসবগুলোয় সাহায্য করে থাকেন। তারা একে অপরের সঙ্গে ভাই ভাইয়ের মতই চলাফেরা করেন।

সুতরাং ঘটে যাওয়া বিষয়টি নিয়ে কোন রকম উস্কানী, ধু¤্রজাল, নাশকতা কিংবা রাজনৈতিক ফায়দা আদায় করার অবকাশ নেই কারো। বিষয়টি ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত হানলেও এটি এখন একান্তই প্রশাসনের বিষয়। আমাদেও বিশ্বাস, প্রশাসন আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং প্রকৃত অপরাধীদের যথাযথ শাস্তি প্রদান করে দৃষ্টান্ত স্থাপন করবেন-–এটাই সকলের কাম্য।

লেখক: কবি, কলামিস্ট ও সমাজকর্মী| গৌরীপুর, দাউদকান্দি, কুমিল্লা। ashraf.k1968@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here