স্যানিটারী ন্যাপকিন গ্রামে উৎপাদন করে গ্রামেই সরবরাহআ হ ম ফয়সল :: মানুষ জন্ম নেবার পর থেকে শিশুকাল, শৈশব, কৈশোর পার হয়ে যৌবন বয়সে পা রাখে। এক এক স্তরে মানব শরীরের এক একটা পরিবর্তন আসে, দেহের ও মনের উভয়ই। দেহের সবচেয়ে বড় পরিবর্তন ঘটে কৈশোর পার হয়ে যৌবনে পা রাখার সময়। সে রকমই মেয়েদের ৯-১২ বছরের সময় প্রকৃতির নিয়মেই দেহের একটা বড় পরিবর্তন ঘটে, যা তাকে মেয়ে থেকে নারী হওয়ার দ্বারে পৌছে দেয়। এই পরিবর্তনটাই ঋতুস্রাব/মাসিক/রজ:স্রাব নামে আমাদের নিকট পরিচিত। প্রকৃতির নিয়মে ছেলেদেরও এ রকম পরিবর্তন হয়।

কিন্তু মেয়েদের পরিবর্তনটা একটু ভিন্ন। শারীরিক পরিবর্তনে মাসের নির্দিষ্ট কয়টি দিন সে স্বাভাবিক থাকেনা। তাদের শরীর থেকে রক্ত ঝরে। যেহেতু মাসের নির্দিষ্ট কয়টি দিন হয় সেহেতু এটা মাসিক নামেই বেশী পরিচিত। এই সময়টাতে মেয়েদের বেশী পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা প্রয়োজন। পরিস্কার পরিচ্ছন্ন না থাকার ফলে মেয়েদের অনেক ধরনের রোগ হয়, যা তাকে পরবর্তীতে অনেক শারীরিক সমস্যার সম্মুখীন করে।

এভাবে যদি কারও বার বার ইনফেকশন হয় তবে অনেক ক্ষেত্রে মেয়েদের সন্তান উৎপাদন ক্ষমতা লোপ পেতে পারে। যে জন্য মাসিক সময়ে সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন পরিস্কার পরিচ্ছন্ন থাকা। বয়:সন্ধিকালীন এ সময়টাতে মেয়েরা সাধারণত এ ব্যাপারে একবারেই অজ্ঞ থাকে। মাসিকের এই সময়টাতে কি করা উচিৎ এ ব্যাপারে মা, বোন, চাচী, ফুফু, দাদী, নানী, সহপাঠী, বান্ধবী এদের কাছ থেকেই এ সময়টাতে কি করনীয় এ শিক্ষা পায়।

কিন্তু এটাকে গোপনীয়, লজ্জার বিষয় ভেবে অনেকে কাউকে কিছু বলেনা। অনেক পরিবারও এটাকে গুরুত্বের সাথে দেখে না। অনেক মেয়েরাই মাসের এ তিনটি দিন স্কুল বা বাইরে কাজে যাওয়া থেকে বিরত থাকে। ফলে দেখা যায় মেয়েদের স্কুলে অনুপস্থিতির হার বেড়ে যায়। তাদের লেখা পড়ায় বিঘ্ন ঘটে। এ সমস্যা সমাধানে মেয়েদের এই সময়ে স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহার করা উচিৎ। স্কুলেও স্যানিটারী ন্যাপকিন সরবরাহের ব্যবস্থা থাকা ও পানি স্যানিটেশনের সু-ব্যবস্থা থাকা। বাবা ও মা’কে এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। পরিবারের আয়ের একটা অংশ যদি মেয়ের মাসিক ব্যবস্থাপনায় ব্যয় হয় তবে মেয়েটির প্রজনন স্বাস্থ্য ভালো থাকবে এবং ভবিষৎ প্রজন্ম সুস্থ থাকবে।

গ্রাম শহর ধনী দরিদ্র কোন শ্রেণীর মানুষই মাসিকের বিষয়টি স্বাভাবিক ভাবে প্রকাশ করেনা। এটা একটা গোপনীয় বিষয়, এটা প্রকাশ করা যাবেনা এমন ধারণাই সবার মনে। কিন্তু মাসিক কোন লজ্জার বিষয় নয় বরং এটা মেয়েদের অহংকারের বিষয়। মাসিক ব্যবস্থাপনার বিষয়টি নারী পুরুষ উভয়েরই জানা দরকার। সঠিক মাসিক ব্যবস্থাপনা না জানার ফলে একজন নারীর শারীরিক ক্ষতি হচ্ছে এটা নারী পুরুষ সবাইকে বুঝতে হবে। মেয়ের মাসিক সঠিক ব্যবস্থাপনার জন্য মা বাবার সমানভাবে অংশগ্রহন জরুরী।

স্যানিটারী ন্যাপকিন গ্রামে উৎপাদন করে গ্রামেই সরবরাহএ লক্ষ্যকে সামনে রেখে প্রত্যন্ত গ্রামের মেয়েদের ও মায়েদের মাসিক ব্যবস্থাপনা ও প্রজনন স্বাস্থ্য উন্নত করার প্রয়াসে বেসরকারী সংস্থা ‘ডর্‌প’ স্যানিটারী ন্যাপকিন উৎপাদন ও বিতরণ কার্যক্রম শুরু করেছে। ডর্‌প তাদের কর্ম এলাকায় স্কুলে মেয়েদের নিয়ে মাসিক ব্যবস্থাপনা, স্যানিটেশন ও হাইজিন বিষয় নিয়ে প্রতি মাসে আলোচনার আয়োজন করে সচেতন করে যাচ্ছে। স্কুলে মেয়েদের স্যানিটেশন সুব্যবস্থার পাশাপাশি স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহার বৃদ্ধি করা যাতে স্কুলে উপস্থিতির হার কমে না যায়।

পাশাপাশি গ্রামের মায়েরাও পুরনো কাপড় ব্যবহার না করে স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহারে অভ্যস্ত হয়। শুধু তাই নয়, ডর্‌প গ্রামের নারীদের স্যানিটারী ন্যাপকিন বানানোর প্রশিক্ষণ দিয়ে ‘উচ্ছাস’ ন্যাপকিন উৎপাদন করে গ্রামের নারী ও স্কুল কলেজের ছাত্রীদের মধ্যে স্বল্পমূল্যে বিতরণ করছে। এর ফলে এলাকাগুলোতে মেয়েদের স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহারের হার দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে।

এ বিষয়ে ডর্‌প এর গবেষণা প্রধান মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান জানান, ‘জাতীয় স্বাস্থ্য পরিচর্যা’ বিষয়ক প্রাথমিক জরিপে দেখা গেছে দেশের ৮৫ ভাগ নারী ও কিশোরী মাসিক চলাকালীন পুরাতন কাপড় ব্যবহার করেন এবং গ্রামাঞ্চলে তুলনামূলকভাগে এটি বেশী দৃশ্যমান। মেয়েদের বিদ্যালয়গুলোতে মাসিককালীন পরিচর্যা ও ব্যবস্থাপনার চিত্রটি আরও ভয়াবহ। এই সকল সমস্যার প্রধান কারণ হলো স্বল্প মূল্যের স্যানিটারী ন্যাপকিনের সহজলব্যতা, অপ্রতুলতা, সচেতনতার অভাব এবং সামাজিক কুসংস্কার।

এ ছাড়া লক্ষ্মীপুরের রামগতি উপজেলার প্রত্যন্ত চর এলাকায় অবস্থিত বালুরচর উচ্চ বিদ্যালয়ে জরিপের মাধ্যমে জানা যায়, মাসিক চলাকালীন সময়ে মাত্র ৫ ভাগ ছাত্রী স্যানেটারী ন্যাপকিন ব্যবহার করে এবং বেশীর ভাগ ছাত্রী বিদ্যালয়ে অনপুস্থিত থাকে। এর ফলে তারা পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করতে পারেনা। প্রতি মাসে নগদ টাকা খরচ করা প্রত্যন্ত অঞ্চলের মেয়ে ও মহিলাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে পুরুষের ভূমিকা অত্যন্ত জোড়ালো হওয়া প্রয়োজন বলে জনাব হাসান মনে করেন। আমাদের দেশের পুরুষরা মূল আয় করে এবং সে ক্ষেত্রে মেয়ে ও মহিলাদের নিজস্ব ব্যবহারের উন্নয়ন হিসেবে প্রতিমাসে ৩০-৪০ টাকা এ খাতে পারিবারিক বরাদ্দ রাখার সিদ্বান্ত থাকা প্রয়োজন।

যোবায়ের হাসান আরো জানান, এ অবস্থা থেকে উত্তরণে ডর্‌প ‘স্বাস্থ্যগ্রামঃ ওয়াশ পরিবীক্ষণ প্রেক্ষিত’ কার্যক্রমের আওতায় নবম ও দশম শ্রেণীর ছাত্রীদের সমন্বয়ে স্কুল ছাত্রী ফোরাম গঠন করা হয় প্রতি মাসে ছাত্রীদের নিয়ে একজন পরিবার পরিকল্পনা পরিদর্শিকার উপস্থিতিতে মাসিকস্বাস্থ্য শিক্ষা অধিবেশন পরিচালনা করা হয়। পাশাপাশি ছাত্রীদের মাঝে স্যানেটারী ন্যাপকিন ব্যবহার বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য ন্যাপকিন বিতরন করা হয় এবং স্কুলে একটি নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দেয়া হয়। এর ব্যবহার বিধি ছাত্রীদের হাতে কলমে শিখানো হয়। ন্যাপকিন ব্যবহারের পর তা নির্দিষ্ট স্থানে ফেলার জন্য বিদ্যালয়ে ঢাকনাযুক্ত ঝুড়ি সরবরাহ করা হয়। যাতে ছাত্রীরা সহজে ব্যবহার ও বর্জন করতে পারে। সম্প্রতি শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এক পরিপত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি স্কুলে ন্যাপকিনের ব্যবস্থা রাখতে হবে, যাতে ছাত্রীরা প্রয়োজনে সংগ্রহ করতে পারে।

রামগতির অপর এক স্কুল সুলতানা বালিকা বিদ্যালয়ের সিনিয়র শিক্ষক জান্নাতুল আরা ফেরদাউস বলেন, গ্রামের মেয়েরা অনেক কিছু বলতে পারেনা, তাদের সচেতনতার অভাব, এ ছাড়া তারা দরিদ্র্য এ ক্ষেত্রে স্কুল পর্যায়ে স্যানিটারী ন্যাপকিন পৌছে দেয়ার যে উদ্যোগ ডর্‌প গ্রহণ করেছে এটি সত্যি প্রশংসার দাবী রাখে। তাদের এ কার্যক্রম দেশের সমগ্র স্কুলগুলোতে ছড়িয়ে দিতে পারলে স্বাস্থ্য সচেতনতায় স্যানিটারী ন্যাপকিন ব্যবহারের হাড় বহুলাংশে বেড়ে যাবে।

রামগতিতে স্থাপিত স্যানিটারী ন্যাপকিন উৎপাদন কেন্দ্রের উদ্যোক্তা গুলশান সুলতানা জানান, গত ছয় মাস ধরে এখানে স্যানেটারী ন্যাপকিন উৎপাদন করা হয়। উৎপাদনের সাথে আমিসহ ৬ জন নারী কর্মী জড়িত, যার মাধ্যমে ছোট পরিষরে হলেও কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে। স্বাস্থ্য সচেতনতায় স্যানিটারী ন্যাপকিনের ব্যবহার বাড়াতে ডর্‌প বিভিন্ন প্রচারমূলক কার্যক্রম করে যাচ্ছে, যেমন ৪টি স্যানিটারী ন্যাপকিন খালি মোড়ক জমা দিলে একটিনতুন স্যানিটারী ন্যাপকিন বিনামূল্যে দিচ্ছে। পরিবেশ সচেতনতায় প্লাসটিকের মোড়কগুলো সংগ্রহ করে ডর্‌প পুড়িয়ে ফেলছে।

এ ছাড়া প্রত্যন্ত স্কুলে মেলার আয়োজন করে ছাত্রীদের মাঝে সচেতনতা করে যাচ্ছে। এখানে উৎপাদিন ন্যাপকিন গুলো স্বল্প মূল্যের কারনে গ্রামের অনেক দরিদ্র্য নারীও এটি কিনতে পারছে। ডর্‌প রামগতি ছাড়াও বরগুনা, টাঙ্গাইলে ও সিরাজগঞ্জে স্যানিটারী ন্যাপকিন উৎপাদন করে স্কুলসহ গ্রাম পর্যায়ে পৌছে দিচ্ছে বলে তিনি জানান।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here