সামপ্রতিক সময়ে পশ্চিম সুন্দরবনের সাতক্ষীরা রেঞ্জে বনদস্যুদের তৎপরতা বহুগুনে বেড়ে গেছে। সুন্দরবন সংলগ্ন নদ-নদীতে মাছ ও কাঁকড়া শিকারে যাওয়া হাজার হাজার জেলে বনদস্যুগ্রুপগুলোর হাতে জিম্মি হয়ে পড়েছে। তাদের অত্যাচার নির্যাতনে অসংখ্য জেলে পরিবার সুন্দরবন সংলগ্ন অংশে মাছ ধরতে যাওয়া ছেড়ে দিয়ে চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিনাতিপাত করছে বলে ভুক্তোভোগী জেলেরা জানিয়েছে। মাঝে মধ্যে অভিযানে দু/এক জন বনদস্যু আটক হলেও কোনক্রমেই তাদের তৎপরতা না কমে বরং অতীতের যেকোন সময়ের চেয়ে বেড়ে গেছে বলে জেলেদের অভিযোগ।
সুন্দরবন থেকে মাছ ধরে ফিরে আসা উপজেলার গাবুরা, পদ্মপুকুর, মুন্সিগঞ্জ ও রমজাননগরসহ আশপাশের এলাকার অসংখ্য জেলের সাথে কথা বলে জানা গেছে বিগত কয়েক মাসে পশ্চিম সুন্দরবনে বনদস্যুদের অত্যাচার ব্যাপকভাবে বেড়ে গেছে। মজনু ও আলিম বাহিনীর তৎপরতায় জেলেরা চরম অসহায়ত্বের মধ্যে দিন কাটাচ্ছে। সশস্ত্র বনদস্যুদের তৎপরতায় হাজার হাজার জেলে এক প্রকার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। বনদস্যুদের নির্মম অত্যাচার আর নির্যাতন সত্ত্বেও অনেকে এখনো সুন্দরবনাঞ্চলে মাছ শিকারে গেলেও অসংখ্য জেলে বাধ্য হয়ে বনে যাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে বলে এসব জেলেদের অভিযোগ।
সুন্দরবনে মাছ শিকারের কাজে জড়িত টেংরাখালীর হাবিবুল ইসলাম  দোলন, মীরগাং গ্রামের সামাদ আলী ও হরিনগরের মতুরাপুর গ্রামের আশুতোষ মন্ডলসহ অন্য জেলেরা জানান, মজনু ও আলিম বাহনীর সদস্যরা গোটা পশ্চিম সুন্দরবন এলাকা নিজেদের জিম্মায় নিয়ে নিয়েছে। মুক্তিপনের দাবিতে প্রায় প্রতিদিনই বনদস্যুরা অসংখ্য জেলেকে অপহরন করছে উল্লেখ করে এসব জেলেরা জানিয়েছে অপহৃত ব্যক্তিকে মেরে ফেলার হুমকি দেয়ার কারনে নীরবে তাদের পরিবারের লোকজন মুক্তিপনের টাকা পরিশোধ করলেও কোনভাবেই আইন-শৃংখলা বাহিনীকে অবহিত করে না।
জেলেরা অভিযোগ করে জানায় নিয়মিত টহল এবং কোষ্টগার্ডসহ পুলিশের সার্বক্ষনিক নজরদারি না থাকার সুযোগে বনদস্যুরা এই সুযোগ পাচ্ছে বলেও তাদের অভিযোগ।
কয়েকজন জেলে জানিয়েছে নদীতে জেলেদের অপহরন করা হলেও ডাঙায় বসে ঐসব জেলেদের মুক্তিপনের টাকা আদায় করা হচ্ছে। শ্যামনগর উপজেলার উপকুলবর্তী প্রতিটি মোকামসহ সাতক্ষীরা কিংবা যশোর এলাকায় বিভিন্ন পয়েন্টে অবস’ান নিয়ে বনদস্যুদের সহযোগীরা মুক্তিপনের টাকা হাতিয়ে নিয়ে প্রাপ্তি স্বীকার করার পর অপহৃতদের জিম্মিদশা থেকে মুক্তি দিচ্ছে বনদস্যুরা।
উল্লেখ্য সমপ্রতি বনদস্যুদের হাতে অপহৃত এক জেলের মুক্তিপনের টাকা পরিশোধের সময় গত ৩ নভেম্বর উপজেলার কলবাড়ি এলাকা থেকে মনিরুজ্জামান মুকুল নামের বনদস্যুদের এক সহযোগীকে পুলিশ আটক করে।
কোন কোন জেলে অভিযোগ করে জানায় উপকুলবর্তী এলাকায় বনদস্যুদের অবস’ানরত সহযোগীদের ব্রবহৃত টেলিখোন নম্বর দিয়ে তাদের কাছে টাকা পৌছে দিতে বলা হচ্ছে জেলে পরিবারগুলোকে। আইন-শৃুংখলা বাহিনীকে এসব ঘটনা জানানো হলেও কখনই কার্যকর কোন পদক্ষেপ নেয়া হয়না বলেও এসব জেলেদের অভিযোগ।
জেলেরা জানিয়েছে দুর্ধর্ষ্য বনদস্যু বাহিনী প্রধান মোতালেব ও জয়নাল’র মৃত্যুর পর তাদের বাহিনীর অপরাপর সদস্যরা সংঘটিত হয়ে বর্তমানে পশ্চিম সুন্দরবন এলাকা নিয়ন্ত্রন করছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে সুন্দরবন সংলগ্ন গ্রামে বসবাসরত এক ইউপি সদস্য জানিয়েছে আলিম ও মজনু বাহিনীর প্রায় সত্তর জন সদস্য পৃথক দুটি গ্রুপে বিভক্ত হয়ে গোটা পশ্চিম সুন্দরবন এলাকা নিয়ন্ত্রন করছে।
এ দুই বনদস্যু বাহিনীর নিকট ২টি এসএমজিসহ  প্রায় ৬৪টি আগ্নেয়াস্ত্র থাকার কথা জানিয়েছে ঐ জনপ্রতিনিধি জানান তার এলাকাসহ আশপাশের গ্রামগুলোর জেলেরা বনদস্যুদের অত্যাচারে ভিশনভাবে নির্যাতিত।
গাবুরা গ্রামের মইজদ্দি গাজী ও সোরা গ্রামের তরিকুলসহ পানখালী গ্রামের কোমলেশ মন্ডল জানিয়েছে গত কয়েক মাস ধরে এসব জলদস্যুরা নির্যাতনের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়ে সুন্দরবনে মাছ ধরতে যাওয়া প্রতিটি নৌকা থেকে দশ হাজার টাকা করে আদায় করছে। কোন কারনে টাকা কম দিলে নৌকা থেকে জেলেদের উঠিয়ে নিয়ে মুক্তিপন আদায়সহ আটক রাখার সময় ব্যাপকভাবে শাররীক নির্যাতন চালানো হচ্ছে বলেও এসব জেলেরা অভিযোগ করেছে।
“নদীতে নামলি ডাকাতগো টাকা দিতে হবে”  উল্লেখ করে ভেটখালী গ্রামের শহীদুজ্জামান ও কদমতলা গ্রামের সুরেশ মন্ডল জানিয়েছে
লোকালয়ে ফিরে আসা এসব জেলেরা আরো জানিয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বর পর্যন- আল-আমিন ও মজনু বাহিনীর চলতি বছরের টার্গেট এক কোটি টাকা। বিশেষ কয়েকটি সুত্রের সাথে কথা বলে জানা  গেছে এ বনদস্যু গ্রুপ দু’টির পক্ষ থেকে উপজেলার দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা থেকে শুরু করে বুড়িগোয়ালীনি, মুন্সিগঞ্জ, ঈশ্বরীপুর, রমজাননগর, কৈখালী ও পদ্মপুকুর ইউনিয়নের প্রায় ১৬ শতাধিক জেলের তালিকা তৈরী করে প্রত্যেককে নৌকাপিছু ৬ হাজার টাকা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এসব টাকা গ্রহনের সময় হস-ান-র করা বিশেষ টোকেন পরবর্তী সময়ের জন্য টাকা প্রদানের প্রমানপত্র হিসেবে বিবেচিত হবে উল্লেখ করে আল-আমিন ও মজনু বাহিনী ষ্পষ্ট জানিয়েছে টাকা না দিলে তাদের অপহরন করে দ্বি-গুন মুক্তিপণ আদায় করা হবে। নির্ভরযোগ্য অপর একটি সুত্রে জানা গেছে ১৬ শতাধিক জেলের নিকট থেকে নৌকাপিছু ৬ হাজার টাকা হিসেবে সর্বমোট ৯৬ লাখ টাকা আদায়ের পাশাপাশি বিশেষ বিশেষ দিবস যেমন ঈদ-উল আজহা ও রাস মেলাকে ঘিরে স্পেশাল বকশিস আদায়ের অজুহাতে এসব গ্রুপগুলো আরো কয়েক লাখ টাকা আদায়ের পরিকল্পনা এটেছে।
জলদস্যুদের তৎপরতার বিষয়ে এসিএফ মোঃ তৌফিকুল ইসলাম জানান, স্বল্প জনবলের কারনে এতো দুর্গম এলাকায় বনদস্যুদের সাথে কুলিয়ে ওঠা কঠিন। অপহৃতের ক্ষতির আশংকায় কখনো জেলেরা তাদের সহযোগীকে অপহরনের ঘটনা বনবিভাগের কাছে জানায় না উল্লেখ করে তিনি আরো বলেন, বনবিভাগ তার সাধ্যমত টহল কার্যক্রম, চালিয়ে যাচ্ছে।
সমপ্রতি শ্যামনগরে যোগদান করেছেন উল্লেখ করে শ্যামনগর থানার অফিসার ইনচার্জ হাশেম খান জানান, বনদস্যুদের তৎপরতা সম্পর্কে অবহিত হয়ে তাদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস’া গ্রহনের চেষ্টা চালাচ্ছেন।

নাজমুল হক, সাতক্ষীরা

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here