আর্জেন্টিনা, ব্রাজিল, ফ্রান্সের মানুষের রক্তে যেমন মিশে আছে ফুটবল, তেমনি বাংলাদেশের মানুষের রক্তে যেন মিশে আছে ক্রিকেট। গ্রাম গঞ্জে , শহরের অলিগলিতে সারাক্ষণ চলে ক্রিকেট উন্মাদনা।

সাকিব, তামিম, মাশরাফিরা যখন ক্রিকেট মাঠে লড়াই করে, বাংলার দর্শকদের চোখ থাকে তখন টিভির পর্দায়,স্টেডিয়ামে। ক্রিকেট পাগল দেশ বলা যেতে পারে বাংলাদেশকে।

বর্তমান ক্রিকেট বিশ্বে   আইসিসির ওয়ানডে র‌্যাংকিংয়ে ৭ নম্বরে অবস্থান করছে। তবে একটা সময় ছিল যখন ক্রিকেট বিশ্ব জানতো না বাংলাদেশকে।

ক্রিকেট বিশ্বের এই অজানা দেশকে  অনন্য শিখরে পৌঁছে দিতে কয়েকজন ক্রিকেটার অনবদ্য ভূমিকা রেখেছেন, যাদের নাম বাংলার ক্রিকেট ইতিহাসে সোনার অক্ষরে মোড়ানো থাকবে। এমনই দশজন ক্রিকেটার নিয়ে আমাদের আজকের আলোচনা। চলুন জেনে নিই বাংলাদেশের সেরা ১০জন ক্রিকেটারের পরিচিতি।

১০. খালেদ মাসুদ

খালেদ মাসুদ ছিলেন একবিংশ শতাব্দীর শুরুতে বাংলাদেশের সেরা উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান। খালেদ মাসুদ শুধু একজন নির্ভরযোগ্য উইকেটকিপারই ছিলেন না, একজন নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান ও ছিলেন। সাধারণত তিনি সাত নম্বরে ব্যাট করতেন।

উইকেটের পেছনে খালেদ মাসুদ;

দক্ষিণ আফ্রিকার সাথে বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট ক্রিকেট ম্যাচে খালেদ মাসুদ টানা ৩ ঘন্টা উইকেটে থেকে ৩৩ রান সংগ্রহ করেন। টেস্ট ক্রিকেটে তাঁর একমাত্র সেঞ্চুরি আসে ২০০৪ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে। সে ম্যাচে তিনি দীর্ঘ ৬ ঘন্টা ব্যাট করে অপরাজিত থেকে ১০৩ রান সংগ্রহ করেন। এক দিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট ফরম্যাটে অপরাজিত  ৭১ রান তার সর্বোচ্চ। যেটি তিনি ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে করেন। খালেদ মাসুদ তার ক্যারিয়ারে মোট ৪৪ টি টেস্ট ম্যাচ এবং ১২৬ টি ওডিআই ম্যাচ খেলে প্রায় ৩ হাজার রান  করেন।

৯. মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ

বাংলাদেশের মিডল অর্ডারের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ব্যাটসম্যান হলেন অলরাউন্ডার মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ। বর্তমান সময়ে ফিনিশার রোলে চমৎকার পারফরম্যান্স তার। শেষ ৫ ওভারে মাহমুদুল্লাহর রান তোলার গড় স্ট্রাইক রেট ২১৪.২৯।

মাহমুদুল্লাহ রিয়াদ;

দলের প্রয়োজনে কখনও বল হাতে, আবার কখনও ব্যাট হাতে জ্বলে ওঠেন তিনি। মাহমুদুল্লাহর কাঁধে ভর করে বাংলাদেশের ম্যাচ জেতার অহরহ দৃষ্টান্ত রয়েছে। ২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে নিজের অভিষেক টেস্ট ম্যাচেই ৮ টি উইকেট তুলে নেন তিনি।

মাহমুদুল্লাহ ২০১৫ সালে বিশ্বকাপ ক্রিকেটে ইংল্যান্ড ও নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে পরপর ২ টি সেঞ্চুরির মধ্য দিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়ে ক্রিকেট মঞ্চে আলোচনার ঝড় তোলেন। তিনি তার আন্তর্জাতিক ক্যারিয়ারে সব ফরম্যাট মিলে এখন পর্যন্ত ১২৩ টি উইকেট এবং ৫ হাজারের উপরে রান করেছেন। বর্তমানে বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারদের তালিকায় মাহমুদুল্লাহ রয়েছেন আট নম্বরে।

৮. মোহাম্মদ আশরাফুল

মোহাম্মদ  আশরাফুল বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক এবং অনন্য প্রতিভাধর একজন ব্যাটসম্যান। তিনি বাংলাদেশের ক্রিকেট অধ্যায়ে এক নতুন মাত্রা সৃষ্টি করেন।

মোহাম্মদ আশরাফুল;

তিনি টেস্ট ক্রিকেটে সর্বকনিষ্ঠ ব্যাটসম্যান হিসেবে সেঞ্চুরির রেকর্ডের অধিকারী। আশরাফুল তার ১৭তম জন্মদিনের একদিন পূর্বে ২০০১ সালের ৮ সেপ্টেম্বরে সিংহলিজ স্পোর্টস ক্লাব গ্রাউন্ডে অনুষ্ঠিত এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপে নিজের অভিষেক টেস্টে শ্রীলঙ্কার বিরুদ্ধে ১১৪ রান করে এই রেকর্ড গড়েন। তিনি ২০০৫ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০০ বল মোকাবিলা করে মাত্র ১ রান সংগ্রহ করে ক্রিকেট ইতিহাসে একটি মজাদার অধ্যায়ের সূচনা করেন।

এরপর ২০০৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটে ২০ বলে অর্ধশত রান করার গৌরব অর্জন করেন। যেটি ছিল সে সময়ের টি-টোয়েন্টিতে সবচেয়ে কম বল খেলে অর্ধশত রান করার রেকর্ড। আশরাফুল ব্যাটিংয়ের পাশাপাশি লেগব্রেক বলও করতেন। তিনি টেস্ট ও ওয়ানডে ক্রিকেটে মোট  ৩৯ টি উইকেটের মালিক। মোহাম্মদ আশরাফুল ওয়ানডে ও টেস্ট ক্রিকেট মিলে মোট ২৩৮ টি ম্যাচ খেলে ৬,২০৫ রান সংগ্রহ করেন।

৭. আব্দুর রাজ্জাক

আব্দুর রাজ্জাক হলেন বাংলাদেশি স্পিনারদের পথপ্রদর্শক। তিনি ছিলেন বাঁহাতি লেগব্রেক বলার। লম্বা বোলিং অ্যাকশন, দক্ষতা, বুদ্ধিদিপ্ত বোলিংয়ের মাধ্যমে ব্যাটসম্যানদের বোকা বানিয়ে সাজঘরে পাঠাতে তিনি দ্বিধাবোধ করতেন না। আব্দুর রাজ্জাক ২০০০ থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত উপমহাদেশের অন্যতম সেরা স্পিনার ছিলেন।

আব্দুর রাজ্জাক;

খুলনা বিভাগে জন্ম নেওয়া আব্দুর রাজ্জাকের ক্রিকেটের যাত্রা শুরু হয় ২০০০-২০০১ মৌসুমে খুলনা বিভাগীয় ক্রিকেট দলে খেলার মধ্য দিয়ে। তিনি ২০০২ সালে বাংলাদেশ এ দলের হয়ে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে অভিষেক ম্যাচে মাত্র ১৭ রান দিয়ে ৭ টি  উইকেট তুলে নেন।

আব্দুর রাজ্জাক ২০০৯ সালে জিম্বাবুয়ের তিন ম্যাচের ওয়ানডে সিরিজে ১৫ উইকেট শিকার করে ম্যান অব দ্য সিরিজ হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তিনি মাত্র ১৫৩ টি ওয়ানডে ম্যাচে খেলে ওভার প্রতি মাত্র ৪.৫৬ রান খরচ করে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে ২০০ উইকেটের মালিক হন। বর্তমানে তিনি জাতীয় দলের বাইরে থাকলেও ঘরোয়া লিগে রাজত্ব করছেন।

৬. হাবিবুল বাশার

হাবিবুল বাশার বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের একজন সাবেক অধিনায়ক ও অলরাউন্ডার। উইকেটে তার ভিত্তি ছিল মজবুত। দলের সব ব্যাটসম্যান যখন একের পর এক আউট হয়ে মাঠ ছাড়তেন, তখন তিনি খুঁটির মতো উইকেটে দাঁড়িয়ে থাকতেন।

ব্যাট করছে হাবিবুল বাশার;

হাবিবুল বাশারকে বাংলাদেশের অন্যতম সফল টেস্ট ব্যাটসম্যান বলা হয়। টেস্ট ক্রিকেটে তিনটি সেঞ্চুরি, ২৪ টি অর্ধশত এবং ওয়ানডেতে ১৪ টি অর্ধশত রান করার জন্য তাকে মিস্টার ফিফটি বলে অভিহিত করা হতো।

হাবিবুল বাশারের অধীনে বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দল প্রথম টেস্ট ম্যাচে জয়লাভ করে এবং অস্ট্রেলিয়া, শ্রীলঙ্কা,ভারত, ও দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে একদিনের আন্তর্জাতিক ম্যাচে জয়লাভ করে। হাবিবুল বাসার ওয়ানডে ক্রিকেটে তিন হাজার পাঁচশত রান এবং টেস্টে ক্রিকেটে দুই হাজারের বেশি রান  করেছেন এবং তার সময়ে তিনি বাংলাদেশের সেরা একজন ব্যাটসম্যান ছিলেন।

৫. মোহাম্মদ রফিক

বাংলাদেশের সাবেক টেস্ট অধিনায়ক মোহাম্মদ রফিক ছিলেন মূলত একজন বাঁহাতি স্পিনার। মাঝে মধ্যে ব্যাট হাতেও জ্বলে উঠতেন।

মোহাম্মদ রফিক;

সাকিব আল হাসান ও মেহেদী হাসান মিরাজের অভিষেকের আগ পর্যন্ত বাংলাদেশের সেরা অফ স্পিনার ছিলেন মোহাম্মদ রফিক। তিনি ২০০৫ সালে জিম্বাবুয়ের সাথে টেস্ট ম্যাচে পাঁচটি উইকেট সংগ্রহ করে দলকে জয়ের পথে এগিয়ে দেন। সেটিই ছিল বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট জয়। মোহাম্মদ রফিক তার পুরো ক্যারিয়ার মিলে ২২৫ টি আন্তর্জাতিক উইকেটের মালিক হন।

৪ . মুশফিকুর রহিম

বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক ক্যাপ্টেন মুশফিকুর রহিম একজন নির্ভরযোগ্য উইকেটরক্ষক ও ব্যাটসম্যান। তিনি বর্তমান সময়ে বাংলাদেশ দলের অন্যতম প্রধান অংশ। দেশের ক্রিকেট ইতিহাসে মুশফিকুর রহিমই সর্বকালের সেরা উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান।

মুশফিকুর রহিম;

মাত্র ১৬ বছর বয়সে তার ওয়ানডে ক্রিকেটে অভিষেক হয়। সাধারনত, তিনি মিডল অর্ডারে ব্যাট করে থাকেন। ওয়ানডে ক্রিকেটে ৩৫.৬৫ হলো ম্যাচ প্রতি তাঁর রান তোলার গড়। মুশফিকুর রহিম  ২০১৪ সালে এশিয়া কাপে ভারতের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে ১০০ রানের একটা ঝড়ো ইনিংস খেলে নিজের প্রথম সেঞ্চুরি করেন। এরপর ২০১৫ সালে পাকিস্তানের সাথে তার ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় সেঞ্চুরি আদায় করে নেন। মুশফিকুর রহিম তার ক্যারিয়ারে ওয়ানডে ফরম্যাটে এখন পর্যন্ত ৪ হাজার এবং টেস্টে ক্রিকেটে ৩ হাজারের বেশি রান করেছেন।

৩. মাশরাফি বিন মর্তুজা

বাংলাদেশ ওয়ানডে দলের অধিনায়ক, ভালোবাসা ও আস্থার প্রতীক এবং বাংলাদেশের ফাস্ট বোলারদের পথপ্রদর্শক হলেন মাশরাফি বিন মর্তুজা। উইকেট প্রতি ৩৩.৪৫ রান দিয়ে এখন পর্যন্ত তিনি ৩৬০ টি উইকেট সংগ্রহ করেছেন।

মাশরাফি ;

মাশরাফি বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার, যিনি হাঁটুতে সাতবার অস্ত্রোপচার করার পরও তার খেলা চালিয়ে যাচ্ছেন। ২০০৭ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচে তিনি ৪ টি উইকেট নিয়ে ভারতকে বিশ্বকাপ থেকে বিদায় করে দেন। মাশরাফি  ওয়ানডে ক্রিকেটে বাংলাদেশের সফল অধিনায়ক। তার অধীনে ২০১৫ সালে ওয়ানডে বিশ্বকাপে বাংলাদেশ কোয়াটার ফাইনাল খেলার গৌরব অর্জন করে।

২. তামিম ইকবাল

বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে সর্বকালের সেরা ওপেনার হলেন তামিম ইকবাল। প্রথম এবং একমাত্র বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ১০ হাজার রান সংগ্রহ করেছেন।

শত রান করার পর তামিম ;

বাঁহাতি ওপেনিং ব্যাটসম্যান তামিম ইকবালের অভিষেক হয়েছিল প্রায় এক দশক আগে, কিন্তু তার ব্যাট জ্বলে উঠেছে ৪ থেকে ৫ বছর ধরে। সদ্য শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ওয়ানডে ম্যাচে সেঞ্চুরি করে নিজের ১১ তম শতকের মাইলফলক ছুঁয়েছেন তামিম। তিনি ২০১৫ সালে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে ডাবল সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে একমাত্র বাংলাদেশি ক্রিকেটার হিসেবে তামিম ইকবাল  ২০ টি সেঞ্চুরি এবং ৭০ টি অর্ধশত রানের মালিক। বর্তমানে ওয়ানডে ক্রিকেটে তার ব্যক্তিগত রান ৬,৩০৫ এবং টেস্টে ক্রিকেটে ৪,০৪৯ ।

১. সাকিব আল হাসান

সাকিব আল হাসান  শুধু বাংলাদেশের সেরা অলরাউন্ডার নন , সমগ্র ক্রিকেট বিশ্বের  সেরা অলরাউন্ডার। বিশ্বের একমাত্র ক্রিকেটার হিসেবে সাকিব আল হাসান ক্রিকেটের তিন ফরম্যাট ওয়ানডে, টি-টোয়েন্টি ও টেস্টে সেরা অলরাউন্ডার হওয়ার গৌরব অর্জন করেন।

সাকিব আল হাসান;

২০০৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে সাকিব আল হাসান ৮ টি উইকেট এবং ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে অপরাজিত  ৯৬ রান করে বাংলাদেশের জয় এনে দেন। এর আগে ২০০৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিপক্ষে টেস্টে এক ইনিংসে ৭ টি উইকেট তুলে নেন।

এছাড়া ২০১৭ সালে অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্ট ম্যাচে তিনি ১০ টি উইকেট নিয়ে বিশ্ব রেকর্ড গড়েন। সাকিব আল হাসান এখন পর্যন্ত ১৮৮ টি ওয়ানডে ম্যাচ খেলে ২৩৭ টি উইকেট পেয়েছেন এবং ৫,৪৩৩ রান সংগ্রহ করেছেন ।  টেস্ট ক্রিকেটে ৫৩ টি ম্যাচ খেলে ১৯৬ টি উইকেট নেয়ার পাশাপাশি ৩,৬৯২ রান করেছেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here