হাইকোর্টেস্টাফ রিপোর্টার :: জাতীয় সংসদে পাস করা বিচারপতি অপসারণ সংক্রান্ত সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে হাইকোর্টের দেওয়া রায় বহাল রেখেছে সর্বোচ্চ আদালত। প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের সাত বিচারপতির বেঞ্চ সোমবার সর্বসম্মতভাবে এ সংক্রান্ত রায় দেয়।

তবে সংক্ষিপ্ত আদেশে আপিল বিভাগ বলেছে, হাইকোর্টের রায়ের কিছু শব্দ, বাক্য এক্সপাঞ্জ (বাদ) করে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হবে। পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশ পেলেই আপিল বিভাগ কি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত জানা যাবে। আপিল বিভাগের এই রায়ের ফলে সংসদের হাতে উচ্চ আদালতের বিচারক অপসারণের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছিলো তা বাতিল হয়ে গেলো।

ষোড়শ সংশোধনী বাতিল হওয়ায় অ্যাটর্নি জেনারেল অ্যাডভোকেট মাহবুবে আলম চরম হতাশা প্রকাশ করে বলেছেন, ’৭২-এর আদি সংবিধানের ৯৬ অনুচ্ছেদ পুনর্বহালে যে আশা ও স্বপ্ন ছিলো তা পূরণ হলো না। আমি এ রায়ে অত্যন্ত দু:খ ও হতাশা প্রকাশ করছি। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক এমপি বলেছেন, আদালত কেন এটাকে সাংঘর্ষিক মনে করছে না, তা বোধগম্য নয়। পূর্ণাঙ্গ রায় পাওয়ার পর এ ব্যাপারে পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা হবে। অন্যদিকে আইনজীবীরা এ রায়কে স্বাগত জানিয়েছেন। তারা বলেছেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সুদৃঢ় করার ক্ষেত্রে এই রায় ঐতিহাসিক ভূমিকা পালন করবে। রিটকারীদের আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, বিচার বিভাগের স্বাধীনতার প্রশ্নে এ রায় ঐতিহাসিক। তবে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের রায় নিয়ে সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছেন।

তিনি বলেছেন, রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি পাওয়ার পরই এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানানো হবে। বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেছেন, সরকার বিচার বিভাগকে নিয়ন্ত্রণ করার যে দূরভিসন্ধি করেছিল, আপিল বিভাগের রায়ে তা নস্যাত হয়েছে। গত বছরের ৫ মে হাইকোর্টের একটি বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। আপিলে সরকার ও রিটকারী পক্ষ ছাড়াও অ্যামিকাস কিউরিদের মতামত নেওয়া হয়।

শুনানি শেষে গত ১ জুন আপিল বিভাগ মামলাটি রায়ের জন্য অপেক্ষমান রাখে। অবকাশের পর গতকাল সোমবার আপিল বিভাগের দৈনন্দিন কার্যতালিকার এক নম্বর ক্রমিকে ‘বাংলাদেশ সরকার বনাম আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী ও অন্যান্য’ মামলাটি রায় ঘোষণার জন্য রাখা হয়। সাধারণত আপিল বিভাগের বিচার কার্যক্রম শুরু হয় সকাল নয়টায়। কিন্তু গতকাল সকাল ১০টা ২৭ মিনিটে প্রধান বিচারপতি নেতৃত্বে আপিল বিভাগের সাত বিচারপতি আপিলের উপর সিদ্ধান্ত দিতে এজলাসে আসেন। এ সময় আদালত কক্ষে ছিলো পিনপতন নিরবতা। ২/৩ মিনিট পর বেঞ্চ অফিসার কার্যতালিকা থেকে ‘আইটেম নং ওয়ান’ ঘোষণার পরই প্রধান বিচারপতি রায় ঘোষণা করেন। ওই ঘোষণায় তিনি বলেন, ‘বাই ইউন্যানিমাস ডিসিশন দি আপিল ইজ ডিসমিসড। উইথ সাম অবজারভেশন অ্যান্ড এক্সপানশন।’

(অর্থাত্ সর্বসম্মতভাবে আপিল খারিজ করা হইল; কিছু পর্যবেক্ষণ ও অবলোপন সাপেক্ষে।) রায় ঘোষণার পরই বিচারপতিরা এজলাস ত্যাগ করেন। বেঞ্চের অপর বিচারকরা হলেন বিচারপতি মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মো. ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার।

প্রসঙ্গত ১৯৭২ সালে প্রণীত মূল সংবিধানে উচ্চ আদালতের বিচারপতিদের অপসারণের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের কাছে ছিল। ১৯৭৫ সালের ২৪ জানুয়ারি সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনীর মাধ্যমে এ ক্ষমতা রাষ্ট্রপতির হাতে অর্পণ করা হয়। পরে জিয়াউর রহমানের শাসনামলে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনীর মাধ্যমে বিচারকদের অপসারণের ক্ষমতা দেওয়া হয় সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের কাছে। ২০১৪ সালের ১৭ সেপ্টেম্বর বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা পুনরায় সংসদের কাছে ফিরিয়ে নিতে সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী আনা হয়। বিলটি পাসের পর ওই বছরের ২২ সেপ্টেম্বর তা গেজেট আকারে প্রকাশ পায়।

দেশের শীর্ষ আইনজীবীরা এবং সংসদের বাইরের বিরোধী দলগুলো এ সংশোধনী প্রত্যাখ্যান করে। সংবিধানের এ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ওই বছরের ৫ নভেম্বর সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী হাইকোর্টে এই রিট আবেদন দায়ের করেন। হাইকোর্ট এই সংশোধনী কেন অবৈধ, বাতিল ও সংবিধান পরিপন্থী ঘোষণা করা হবে না এই মর্মে রুল জারি করে। ২০১৫ সালের ২১ মে রুলের উপর চূড়ান্ত শুনানি শুরু হয়। শুনানি শেষে ২০১৬ সালের ৫ মে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরীর নেতৃত্বাধীন হাইকোর্টের বৃহত্তর বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠ মতের ভিত্তিতে এই সংশোধনীকে অবৈধ ও বাতিল ঘোষণা করে রায় দেয়। এই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করে সরকার। আপিলে হাইকোর্টের রায় বাতিল চাওয়া হয়।

 

যারা রিট করেন

সুপ্রিম কোর্টের নয় আইনজীবী ষোড়শ সংশোধনীর বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে হাইকোর্টে রিট করেন। এরা হলেন আইনজীবী আসাদুজ্জামান সিদ্দিকী, এএইচ ইমরুল কাউসার, মামুন আলিম, এখলাসউদ্দিন ভূইয়া, মো. ছারওয়ার আহাদ চৌধুরী, মাহবুবুল ইসলাম, নরুল ইনাম বাবুল, সৈয়দা শাহীন আরা লাইলী ও রিপন বাড়ৈ।

দশ অ্যামিকাস কিউরি মতামত দেন

আপিল শুনানিতে দশজন অ্যামিকাস কিউরির মধ্যে নয়জনই বিচার বিভাগের স্বাধীনতা এবং জনগণের অধিকার রক্ষার প্রশ্নে ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ অভিমত দেন। তারা হলেন সিনিয়র আইনজীবী ড. কামাল হোসেন, অ্যাডভোকেট টি এইচ খান, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, ব্যারিস্টার রোকনউদ্দিন মাহমুদ, অ্যাডভোকেট এ এফ এম হাসান আরিফ, ব্যারিস্টার ফিদা এম কামাল, অ্যাডভোকেট এ জে মোহাম্মদ আলী, অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী, ব্যারিস্টার আজমালুল হোসেন কিউসি ও অ্যাডভোকেট আব্দুল ওয়াদুদ ভূঁইয়া।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here