উপুড় হয়ে থাকা মাঝবয়সী মানুষটার মুখের একাংশ উড়ে গিয়েছে গুলিতে। শরীর জুড়ে আঘাতের চিহ্ন। গুলির দাগ। ডান হাতের ফাঁকে গলানো একে-৪৭ ‘কক্’ করা অবস্থায়। পাশে আরও একটা একে-৪৭, জলের জ্যারিকেন, বিছানার অংশ, সাইডব্যাগ, হিয়ারিং এড। বাঁ-হাতের কব্জিতে উল্টে পরা ঘড়ি। নীল জামা। তার উপরে জ্যাকেট। গাঢ় রঙের প্যান্ট। কোমরে সবুজ গামছা। আর পায়ের কাছে সেই পরিচিত লাল গামছা। প্রাণহীন কিষেণজিকে চিনতে ভুল হল না জঙ্গলের ডেরায় একাধিক বার সাক্ষাৎকার নিতে যাওয়া সাংবাদিক-আলোকচিত্রীর।
প্রায় সাড়ে পাঁচ ঘণ্টা জঙ্গলের ধারে সেচ খালের পাশে কার্যত প্রাণ হাতে করে অপেক্ষা করার পর রাত ১১টা ৩৫-এ ডাক পড়ল আমাদের। সংবাদমাধ্যমের লোকজনকে নিয়ে বুড়িশোলের জঙ্গলের ভিতরে রওনা হলেন আইজি (পশ্চিমাঞ্চল) গঙ্গেশ্বর সিংহ। সঙ্গে ঝাড়গ্রামের মহকুমা শাসক বাসব বন্দ্যোপাধ্যায়। মিনিট পনেরো হাঁটার পরে দেখা মিলল ‘কিষেণজি’র।
বড়জোর কুড়ি মিনিট কাটালাম শাল জঙ্গলের সেই ‘যুদ্ধক্ষেত্রে’। তার পরেই নির্দেশ এল ফিরে যাওয়ার। কারণ, ‘যুদ্ধ’ এখনও শেষ হয়নি। কিষেণজির পাশে পড়ে থাকা অন্য একে-৪৭টি তাঁর সঙ্গী সুচিত্রা মাহাতোর বলেই সন্দেহ পুলিশের। ১৪-১৫ জন মাওবাদীর একটি দলের সঙ্গে তিনি আরও গভীর জঙ্গলে আত্মগোপন করে রয়েছেন বলেও তাদের অনুমান। সেই দলের খোঁজে গভীর রাতেও চলছে তল্লাশি। বস্তুত, কিষেণজির মৃত্যুর বেশ কয়েক ঘণ্টা পরেও মাওবাদীদের সঙ্গে দফায় দফায় সংঘর্ষ হয়েছে যৌথ বাহিনীর।
মঙ্গলবার রাত থেকেই খবরটা ভাসছিল। বিনপুর ও জামবনির সীমানায় জঙ্গল এলাকায় কিষেণজি, সুচিত্রা মাহাতো-সহ মাওবাদীদের একটা দল রয়েছে বলে খবর পেয়েছিল যৌথ বাহিনী। ঝাড়গ্রাম শহরের অদূরে কুশবনির জঙ্গলে সেই খবরের ভিত্তিতেই প্রায় ১০ কোম্পানি জওয়ান এলাকা ঘিরে তল্লাশি চালায়। বুধবার কাকভোর থেকে দফায় দফায় মাওবাদী-বাহিনী গুলি বিনিময়ও হয়।
বুধবার সারা রাত ধরে তল্লাশি চলেছে। বৃহস্পতিবার সকাল থেকেও তাতে দাঁড়ি পড়েনি। সিআরপি, কোবরা, জেলা পুলিশের বিশাল বাহিনী মিলে বুড়িশোল, বাগুয়াশোল, গোঁসাইবাঁধ, শঙ্খহার, কপাতকাটা-সহ জামবনি ও বিনপুর থানা এলাকার বড় এলাকা জুড়ে শুরু করে ‘সার্চ অপারেশন’ শুরু করে। পেশাদার সাংবাদিকের খোঁজখবর বলছিল, বাহিনীর কাছে নির্দিষ্ট তথ্য আছে। কিছু একটা হতে পারে। এই ‘হতে পারে’-র ভরসায় সকাল থেকেই লেগে পড়তে হয়েছিল যৌথ বাহিনীর সঙ্গে। জওয়ানদের ধমকানি বা চোখ রাঙানি সত্ত্বেও তাঁদের পিছু ছাড়া যাচ্ছিল না। কখন কী হয়ে যায়!
সেই ‘কী হয়ে যায়’টা যে দিনের শেষে এতটা বড় হবে, তা অবশ্য সকালে ভাবিনি। ভাবিনি, এসে পড়ব যুদ্ধক্ষেত্রের মাঝখানে।

সাত-পাঁচ না ভেবেই বাহিনীর পিছু পিছু সকাল ৯টা নাগাদ পৌঁছেছিলাম বিনপুরের গোঁসাইবাঁধ-বাগুয়াশোল গ্রামে। নির্দিষ্ট খবরের ভিত্তিতেই জওয়ানেরা সোজা ঢুকে পড়লেন ধর্মেন্দ্র মাহাতোর বাড়িতে। জামবনির কাপগাড়ি কলেজের এই ছাত্রের সঙ্গে কিষেণজি, সুচিত্রা, বিকাশদের নিয়মিত যোগাযোগ আছে বলে খবর ছিল পুলিশের কাছে। ধর্মেন্দ্রর বাড়িতে যে কিষেণজিরা অনেক রাতই কাটিয়েছেন, খাবারও খেয়েছেন, সে খবরও ছিল। ধর্মেন্দ্র অবশ্য বাহিনী আসার আগেই বাড়ি ছাড়েন। মাটির দোতলার বাড়িটায় প্রত্যেকটা জিনিস উল্টেপাল্টে দেখেছেন জওয়ানেরা। পুলিশের দাবি, এ বছর মার্চে যৌথ বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষে নিহত মাওবাদী শীর্ষ নেতা শশধর মাহাতোর মৃতদেহের ছবি যেমন পাওয়া গিয়েছে, তেমনই উদ্ধার হয়েছে ‘নারী ইজ্জত বাঁচাও কমিটি’ ও ‘সন্ত্রাস বিরোধী আগ্রাসন মঞ্চ’-র পুস্তিকা, লিফলেট। মিলেছে স্বেচ্ছাসেবী লেখা প্রচুর ব্যাজ।
ধর্মেন্দ্রের বাড়িতে ঢুকে এক জওয়ান বললেন, “কিষেণজির খোঁজেই এসেছি। বাড়ি বাড়ি তল্লাশি চালানো হচ্ছে। কোনও ক্ষতি করব না। স্রেফ যাকে চাই, তাকে যে করেই হোক পেতে হবে।” গোঁসাইবাঁধের আগে বুড়িশোল, শঙ্খহার, কপাতকাটা গ্রামেও বাড়ি বাড়ি ঢুকে এ দিন তল্লাশি চালায় পুলিশ। পরে ধর্মেন্দ্রর বাবা, পেশায় চাষি ভূষণ মাহাতো বলেন, “যৌথ বাহিনী পৌঁছেই ছেলের খোঁজ করে। বলল, তোমার ছেলের সঙ্গে মাওবাদীদের যোগাযোগ আছে।”
কিছু ক্ষণ পরেই ঘটনাস্থলে এলেন বিনপুর থানার আইসি। যে খেজুরপাতার চাটাইয়ে বাজেয়াপ্ত জিনিস নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল, কিছু গ্রামবাসী তা ফেরত চাইলেন। আইসি-কে বললেন, “স্যার চাটাইটা দিয়ে যান না! আমাদের বাচ্চারা শোবে।” আইসি কোনও উত্তর না দিয়ে থানায় চলে গেলেন। আমরাও ভাবলাম আজকের মতো ‘অপারেশন’ শেষ। বাড়ি ফেরার পথ ধরলাম সবাই।
তখনও বুঝিনি আবার আসতে হবে। ঘণ্টা পাঁচেক পরেই, বিকেল পাঁচটা নাগাদ খবর পেলাম বুড়িশোলের জঙ্গলে ফের লড়াই শুরু হয়েছে। তড়িঘড়ি গাড়ি নিয়ে ফের রওনা। ঝাড়গ্রাম থেকে জামবনি হয়ে দুবড়া হয়ে বড়শোল। সেখানে আমাদের দাঁড় করিয়ে দেওয়া হল। প্রচুর ফোর্স। কিছু ক্ষণ পরে বলা হল, এগোও। তত ক্ষণে দিনের আলো ফুরিয়েছে। ভরসা গাড়ির হেডলাইট। কিছুটা এগোনোর পরেই জঙ্গল রাস্তা। এ বার নির্দেশ, ‘গাড়ির আলো নিভিয়ে আস্তে আস্তে পরপর চলুন’। কিছু দূর এগোনোর পরেই গাড়ি থামানো হল। রাস্তার দু’পাশে বাহিনী। মোটরবাইকে করে চলছে টহল। সিআরপি-র এক অফিসার ফিসফিস করে বললেন, “একটা জিনিস ভাল করে বুঝে নিন। ওরা আশেপাশেই কোথাও থাকতে পারে। তাই কোনও রকম ঝুঁকি না নিয়ে আলো নিভিয়ে রাখুন। আস্তে আস্তে কথা বলুন। মোবাইলে আলো না জ্বেলে কথা বলার চেষ্টা করবেন।”
এক জওয়ান বললেন, “বহত কুছ হুয়া হ্যায়।” কিন্তু কী সেই ‘বহত কুছ’, কেউই ভেঙে বলছে না। বাতাসে খবর ছিল, গুলিতে নিহত কিষেণজি। আহত হয়েছেন সুচিত্রা মাহাতো-সহ আরও স্কোয়াড সদস্য। তাঁদের ধাওয়া করেছে বাহিনী। জওয়ানের কথায় মুহূর্তে প্রায় নিশ্চিত হয়ে গেলাম, খবরটা পাকা। পাশ থেকে আর এক জওয়ান বললেন, “আমাদের দিক থেকে প্রায় ১০০০ রাউন্ড ফায়ারিং হয়েছে। ওরাও কম যায়নি। আমরা গ্রেনেড আর মর্টারও ছুড়েছি।”
এ দিকে অফিস থেকে বারবার ফোন আসছে, ‘কী হচ্ছে জানাও’। জানাব কী ভাবে? কথা বলতে গেলেই আপত্তি জওয়ানদের। কিছু ক্ষণ পরে ফের এগোনোর অনুমতি মিলল। সিআরপি-র এক দল জওয়ান তত ক্ষণে মোটরবাইক নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছেন। একটা কালভার্ট পড়ল। তার ঠিক আগেই গাড়ি থেকে নেমে পড়তে হল সবাইকে। নির্দেশ এল, এ বার পায়ে হাঁটতে হবে। ক্যানালের ধার ঘেঁষে মোরাম রাস্তা দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম। আশ্রয় জুটল সেচখালের ধারে।
অমাবস্যার আকাশে তারার আলোই ভরসা। এক অদ্ভুত পরিস্থিতি। মোবাইলের আলো জ্বালতে বারণ করা হলেও এগোতে গেলে সেই আলোই ভরসা। ফলে ঝুঁকি নিয়েও আমরা কয়েক জন আলো জ্বাললাম। তাতেও বারবার হোঁচট খেতে খেতে বেশ খানিকটা এগোনোর পরে দেখলাম অ্যাম্বুল্যান্স, বুলেট প্রুফ গাড়ি, মোটরবাইক রয়েছে। দেখে কিছুটা ভরসা পাওয়া গেল।

অন্ধকারে কয়েক জন হঠাৎই পথ ভুলে ঢুকে পড়েছিলাম অন্য জায়গায়। কিছুটা গিয়ে চোখে পড়ল, পিছনে কেউ নেই। বুকটা ছ্যাঁত করে উঠল! চিৎকার এল, ‘কওন হ্যায়’। আরও বিপদ। আমাদেরই মাওবাদী ঠাওরে নিল নাকি! চেঁচিয়ে বললাম, আমরা প্রেসের লোক! এক অফিসার এসে মৃদু ধমক দিলেন, “কেন এখানে এসেছেন? কে আসতে বলেছে? কী ভাবে কোন দিক থেকে বিপদ আসে, কে বলতে পারে? কতটা গিয়েছিলেন? কিছু দেখতে পেলেন?” পরের পর প্রশ্ন। কোনও রকমে ফিরে এসে ওই জায়গাতেই দাঁড়িয়ে থাকলাম।
রাত বাড়ছে। চুপচাপ দাঁড়িয়ে। এক টানা ঝিঁঝিঁ-র ডাক কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে। দশটায় হঠাৎই গুলির শব্দ। প্রথমে একটা দু’টো করে। তার পরে নাগাড়ে। চার দিকে জনমানব নেই। জলপাই উর্দির জওয়ানেরা ছাড়া লোক বলতে আমরা কয়েক জন সাংবাদিক ও আলোকচিত্রী। ঝোপঝাড় ভরা মাঠের পাশে একটি সেচখাল। গুলির শব্দ শুনেই জওয়ানদের কেউ ঝোপের আড়ালে। কেউ বা মাটিতে গুঁড়ি মেরে ‘পজিশন’ নিয়ে। প্রাণ বাঁচাতে শুয়ে পড়লাম মাঠে। কাছাকাছি রয়েছে একটা অ্যাম্বুল্যান্স এবং কয়েকটা বুলেটপ্রুফ গাড়ি। গুলি থেকে বাঁচতে চলে এলাম অ্যাম্বুল্যান্সের পিছনে। সেটাই ‘নিরাপদ’ আশ্রয় বলে মনে হচ্ছে।
আদৌ নিরাপদ কি? জানি না। এমন অভিজ্ঞতা আগে হয়নি। আকাশের নীচে রাতের অন্ধকারে গুলির লড়াইয়ের মাঝে দাঁড়িয়ে আছি কিংকতর্ব্যবিমূঢ় হয়ে। গলা শুকিয়ে আসছে। জল শেষ। নেই খাবারও।
ঠিক যেন যুদ্ধ! অবশ্য ‘যেন’ই বা বলব কেন, এতো পুরোদস্তুর যুদ্ধই!
রাত একটাতেও মোটরবাইকে, গাড়িতে, রাস্তায়, ধানজমিতে, গ্রামের ভিতরে, জঙ্গলে শয়ে শয়ে জওয়ান। মুখে কথা নেই। হাতে ইনস্যাস, একে-৪৭, এক্স-৯৫ সাব মেশিনগানের মতো অত্যাধুনিক আগ্নেয়াস্ত্র। ‘ক্যামোফ্লেজ’ পোশাকে প্রত্যেকেই ‘পজিশন’ নিয়ে।
ঝাড়খণ্ডের দিকটাও পুলিশ-আধাসেনা ঘিরে রেখেছে। জামবনির দিকেও বাড়ানো হয়েছে পুলিশ-আধাসেনার সংখ্যা। কাছাকাছি মালাবতীর জঙ্গল থেকে মাওবাদীদের আর একটা দল আতর্কিতে হামলা চালাতে পারে বলে মনে করছে পুলিশ। সে কারণে বাহিনী রয়েছে সে দিকেও।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/আন্তর্জাতিক ডেস্ক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here