সাদ কান্ধলভিস্টাফ রিপোর্টার :: সম্প্রতি কিছু বক্তব্যের কারণে বিতর্কিত তবলিগ জামাতের মুরব্বি ভারতের সাদ কান্ধলভির ইজতেমায় আসা কেন্দ্র করে বুধবার অচল হয়ে পড়ে পুরো রাজধানী। ইজতেমায় তার যোগদানের বিপক্ষে বিক্ষোভ-অবরোধ আর সমাবেশে এদিন উত্তাল ছিল বিমানবন্দর ও কাকরাইল এলাকা। বিক্ষিপ্ত বিক্ষোভ হয়েছে রাজধানীর আরও অনেক স্থানে। এতে করে তিনি বিমানবন্দরেই অবস্থান করতে বাধ্য হন। একপর্যায়ে পুলিশ পাহারায় তাকে বিমানবন্দর থেকে কাকরাইল মসজিদে নিয়ে আসা হয়।
তবলিগ জামাতের একাংশ ও কওমিপন্থি আলেমরা বলছেন, সাদ দিল্লি ফিরে না গেলে টঙ্গী ও কাকরাইল মসজিদে তারা অবস্থান কর্মসূচি চালিয়ে যাবেন। তারা বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করা থেকে সাদকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যথায় টানা অবরোধ ডাকা হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন সাদবিরোধীরা।

প্রসঙ্গত চলতি বছরের ১২-১৪ জানুয়ারি এবং ১৯-২১ জানুয়ারি দুই দফায় তিন দিনব্যাপ্তির বিশ্ব ইজতেমা অনুষ্ঠিত হবে। প্রথম দফায় ১৪ জানুয়ারি এবং দ্বিতীয় দফায় ২১ জানুয়ারি আখেরি মোনাজাত।

উল্লেখ্য, দিল্লির নিজামুদ্দিন মসজিদ থেকে মাওলানা ইলিয়াছ শাহ (র) তবলিগের কাজ শুরু করেন প্রায় শতবছর আগে। এর পর তার ছেলে মাওলানা হারুন তবলিগ জামাতের মুরব্বি হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তারই ছেলে মাওলানা সাদ কান্ধলভি বর্তমানে তবলিগ জামাতের মুরব্বি। বিশ্বের তবলিগ জামাতের অনুসারীরা ঐতিহ্যগতভাবেই এ পরিবারকে তবলিগের মুরব্বি হিসেবে সম্মান করে থাকেন।
তবে সাম্প্রতিক সময়ে মাওলানা সাদের বেশ কিছু বক্তব্য কেন্দ্র করে মতানৈক্য সৃষ্টি হয় আলেমদের মধ্যে। বিভিন্ন দেশের আলেমদের একটি অংশ বলছেন, সাদের বক্তব্য অনৈসলামিক। তাই তাকে বিশ্ব ইজতেমায় অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। অন্য অংশটি সাদের পক্ষ নিয়েছেন।
ইতোমধ্যে পক্ষ-বিপক্ষের এই উত্তাপ ছড়িয়ে পড়েছে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের তবলিগ জামাত অনুসারীদের মধ্যে।তবলিগ জামাত সদস্যদের মধ্যে সাদ কান্ধলভির বিশ্ব ইজতেমায় আগমন নিয়ে শুরু হয় গ্রুপিং। তবে তবলিগের মুরব্বিরা কিছু দিন আগে বিষয়টির ফয়সালা করে দিয়েছিলেন।
গত ৭ জানুয়ারি তবলিগ জামাতের মুরব্বি ও কওমি আলেমদের সমন্বয়ে গঠিত একটি কমিটি সাদের ঢাকা সফরের প্রতি নিষেধাজ্ঞার সুপারিশ করেন। ওই বৈঠকে ২১ জনের মধ্যে ১৩ জন এবারের ইজতেমায় মাওলানা সাদ কান্ধলভির না আসার পক্ষে মত দেন। তারা দিল্লির নিজামুদ্দিন মারকাজের মুরব্বি মাওলানা মুহাম্মাদ সাদ ও মাওলানা মুহাম্মাদ ইউসুফ এবং নিজামুদ্দিনের বাইরের মাওলানা ইবরাহীম দেওলা ও মাওলানা আহমাদ লাটকে ইজতেমায় না এসে তাদের প্রতিনিধি পাঠানোর সুপারিশ করেন।এর পর লিখিতভাবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাকিস্তানের সাথীদের আসার প্রতিও নিষেধাজ্ঞা জানিয়ে চিঠি দেওয়া হয়।
কিন্তু সম্প্রতি কাকরাইলের মুরব্বি প্রকৌশলী সৈয়দ ওয়াসিফুল ইসলাম সাদকে বিশ্ব ইজতেমায় আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দিলে দ্বন্দ্ব ক্রমে প্রকাশ্য চলে আসে। এর পর বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে সাদের ইজতেমায় আগমনের পক্ষে-বিপক্ষে অবস্থান জানিয়ে পত্র পাঠানো হয় বাংলাদেশে। এমনকি মালয়েশিয়া থেকেও তার আসার পক্ষে ও বিপক্ষে চিঠি পাঠানো হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের কাছে।
এর মধ্যে মালয়েশিয়ার তবলিগের একদল মুরব্বি বিশ্ব ইজতেমা সে দেশে সরিয়ে নেওয়ারও আহ্বান জানায়।তবে এতসব বিতর্কের মধ্যেই বুধবার বিমানযোগে বাংলাদেশে আসেন মাওলানা সাদ। দুপুর ১২টা ৩০ মিনিটে টিজি-৩২১ ফ্লাইটে ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে এসে পৌঁছেন তিনি। তার আগমনের প্রতিবাদে বিমানবন্দরের আশপাশের এলাকায় সকাল থেকেই বিক্ষোভ করেন তবলিগ জামাতের অনুসারী হেফাজত ও বেফাকের নেতাকর্মীরা।
বিক্ষোভকারীদের নেতারা বলেন, তাদের দাবি মানা না হলে সারা দেশ অচল করে দেওয়া হবে, যা শাপলা চত্বরের সমাবেশকেও ছাড়িয়ে যাবে। তাদের দাবি মানা না হলে আগামী ২০ জানুয়ারি পর্যন্ত লাগাতার অবরোধ চলবে বলেও ঘোষণা দেওয়া হয়।
তবলিগ জামাত সূত্রে জানা গেছে, বুধবার সকালে সমাবেশের আগে বায়তুস সালাম জামে মসজিদে বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশের (বেফাক) কার্যালয়ে জরুরি বৈঠকে বসেন মাওলানা সাদের আগমনের বিরোধী আলেম-ওলামা। এর পরই শুরু হয় বিক্ষোভ। খন্ড- খন্ড মিছিল নিয়ে বিমানবন্দরের সামনের সড়কে জড়ো হতে থাকেন হেফাজত, তবলিগ ও বেফাকের লোকজন। নিকটস্থ দক্ষিণখান, উত্তরখান, গাওয়াইর, উত্তরা, টঙ্গী, গাজীপুরসহ আশপাশ থেকে বিক্ষোভকারীরা এতে অংশ নেন। বিমানবন্দরের আশপাশের সব এলাকায় সাদের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ চলায় বিমানবন্দরের বাইরে বের হতে পারেননি তিনি। তবে বিকাল সাড়ে ৩টায় তাকে পুলিশ পাহারায় বিমানবন্দর থেকে তাকে কাকরাইল মসজিদে নিয়ে আসা হয়।
এদিকে সকাল থেকেই উত্তরা এলাকায় বিক্ষোভ সমাবেশ ও অবরোধের ফলে ওই গুরুত্বপূর্ণ ও ব্যস্ততম সড়কে যান চলাচল প্রায় বন্ধ হয়ে যায়। আর তার প্রভাব পড়ে পুরো রাজধানী। সন্ধ্যা পর্যন্ত এসব সড়ক বিক্ষোভের কারণে স্থবির থাকে। এতে সাধারণ যাত্রী ছাড়াও দেশের বাইরে থেকে আসা যাত্রীদের চরম ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হয়। অনেকে বাধ্য হয়ে হেঁটে গন্তব্যের দিকে রওনা হন।
এ ছাড়া রাজধানীর ডেমরা, মোহাম্মদপুরসহ আরও কয়েকটি স্থানে কওমিপন্থি আলেমরা বিক্ষোভ মিছিল করায় পুরো রাজধানীই পরিণত হয় স্থবির ও যানজটের নগরীতে।বিকাল ৪টার দিকে বিমানবন্দর এলাকা থেকে কর্মসূচি সরিয়ে কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা এলাকায় বিক্ষোভ এবং অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা দেন বেফাকের যুগ্ম মহাসচিব আল্লামা মাহফুজুল হক।
তিনি বলেন, জনগণের দুঃখ-দুর্দশার কথা বিবেচনা করে আমরা বিমানবন্দর এলাকা থেকে কর্মসূচি সরিয়ে নিয়েছি। পাশাপাশি আমরা মাওলানা সাদকে ঠেকাতে কাকরাইল মসজিদ ও টঙ্গীর বিশ্ব ইজতেমা এলাকায় বিক্ষোভ-সমাবেশ ও অবস্থান করব।এ সময় বেফাকের এই নেতা মহাখালী থেকে কাকরাইল পর্যন্ত সব মাদ্রাসার ছাত্রদের বিক্ষোভে শামিল হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি ইজতেমা এলাকায়ও একইভাবে বিক্ষোভের ডাক দেন।
বিমানবন্দর থেকে কাকরাইল অভিমুখে মিছিলের ঘোষণাও দেওয়া হয়।তবলিগ সুরক্ষা কমিটির আহ্বায়ক ও বেফাকের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আল্লামা আশরাফ আলী সমাবেশে বলেন, মাওলানা সাদ কোরআন শরিফের ভুল ব্যাখ্যা করেছেন এবং হযরত মুসা (আ) সম্পর্কে কটূক্তি করেছেন। তিনি বাংলাদেশ ত্যাগ না করা পর্যন্ত বিক্ষোভ ও অবস্থান কর্মসূচি চলবে।
শেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত কাকরাইল মসজিদের সামনে বিপুলসংখ্যক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। সাদের আগমনের বিরোধীরা কাকরাইল মসজিদে জড়ো হওয়ার চেষ্টা করেছেন বেশ কয়েকবার। কিন্তু নিরাপত্তার কারণ দেখিয়ে পুলিশ সদস্যরা তাদের সেখান থেকে অন্যত্র সরিয়ে দিচ্ছেন। তবে রাজধানী ও তার আশপাশের মাদ্রাসাগুলো থেকে দলবেঁধে আন্দোলনকারীরা এসে মসজিদের আশপাশের এলাকায় অবস্থান নিচ্ছেন।
উল্লেখ্য,  কান্ধলভিকে নিয়ে বিতর্কের কারণ মাওলানা সাদ কান্ধলভির সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যে ঘোর আপত্তি জানায় দারুল উলুম দেওবন্দ। মাওলানা সাদ তার বক্তব্যে নিজামুদ্দিন মারকাযকে মক্কা-মদিনার পর ইসলামের সবচেয়ে বড় কর্তৃপক্ষ দাবি করেন। এতে নাখোশ হয় দেওবন্দ।
এ ছাড়া মাওলানা সাদ ক্যামেরাযুক্ত মোবাইল ফোন রাখাও হারাম বলেছেন। তিনি বলেন, কেউ পকেটে ক্যামেরাবিশিষ্ট মোবাইল রেখে নামাজ পড়লে তা শুদ্ধ হবে না। যে ওলামায়ে কেরাম ক্যামেরাওয়ালা মোবাইল রাখেন, তারা ওলামায়ে ছু (নিকৃষ্ট)।
বারবার কসম করে বলেন, তারা হলেন ওলামায়ে ছু। এমন আলেমরা হলেন গাধা। মোবাইলে কোরআন শরিফ পড়া ও শোনা, প্রস্রাবের পাত্র থেকে দুধ পান করার মতো।তিনি আরও বলেছেন, কোরআন শরিফ শিখিয়ে যারা বেতন গ্রহণ করেন, তাদের বেতন বেশ্যার উপার্জনের চেয়েও খারাপ। যেসব ইমাম ও শিক্ষক বেতন গ্রহণ করেন, তাদের আগে বেশ্যারা জান্নাতে প্রবেশ করবেন।
দারুল উলুম দেওবন্দ এক বিবৃতিতে মাওলানা সাদ কান্ধলভিকে লিখিত আকারে তার বক্তব্য থেকে সরে আসার আহ্বান জানায়। বলা হয়, যদি তিনি নিজের অবস্থান থেকে ফিরে না আসেন, তা হলে আকাবিরে ওলামা যে কোনো কঠোর সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হবে।নিজামুদ্দিনে একটি চিঠিও পাঠায় দেওবন্দ।
এ পরিস্থিতিতে মাওলানা সাদ দেওবন্দ মাদ্রাসার প্রধান বা মুহতামিম মাওলানা আবুল কাসেম নোমানিকে একটি জবাবি চিঠি পাঠান।মাওলানা সাদ ২০১৫, ’১৬ ও গত বছর বিশ্ব ইজতেমার আখেরি মোনাজাত করেন। তবে এবার দেওবন্দ এবং নিজামুদ্দিনের মধ্যে ভারতে বিরাজমান উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে বাংলাদেশেও। এর মূল কারণ মাওলানা সাদের দেওয়া বক্তব্য।উল্লেখ্য, বাংলাদেশের বেশিরভাগ মাদ্রাসাই দেওবন্দ আদর্শের।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here