ঢাকা : বিদায় নিয়েছে ২০১৩ সাল। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে সদ্যবিদায় নেওয়া বছরটি ছিল বিভিন্ন কারণে আলোচিত। রাজনৈতিক দলগুলোর পাল্টাপাল্টি কর্মসূচিতে উত্তপ্ত ছিল বছরজুড়ে।
ছিল সংঘাত, সংঘর্ষ, সহিংসতা আর নাশকতা। হারতাল, অবরোধে ও বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকান্ড ও পুলিশের গুলিতে অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কয়েক হাজার। দলীয় কর্মীরা ছাড়াও রাজনৈতিক কর্মসূচির কারণে জীবন দিয়েছে সাধারণ মানুষ।

দেশব্যাপী ১৮ দলের বিক্ষোভ: ২০১৩ সালের সর্বশেষ দিনটি ছিল বিএনপি-জামায়াতের নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের ডাকা দেশব্যাপী বিক্ষোভ কর্মসূচি। ২৯ ও ৩০ ডিসেম্বর ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়াকে বাসা থেকে বের হতে না দেওয়া এবং ১৮ দলীয় জোট নেতাকর্মীদের “মার্চ ফর ডেমোক্রেসি” পালনে সরকার বাধা দেওয়ার প্রতিবাদে এ কর্মসূচি পালন করে ১৮ দলীয় জোট। রাজধানী ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব জেলা, উপজেলা, সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডগুলোতে ৩১ ডিসেম্বর এ বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।

মার্চ ফর ডেমোক্রেসি: এ বছরের আলোচিত রাজনৈতিক কর্মসূচির মধ্যে ছিল বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট কর্তৃক ঘোষিত “মার্চ ফর ডেমোক্রেসি” নামে রাজধানীতে গণজমায়েত। ২৪ ডিসেম্বর বিএনপির চেয়ারপারসন ও ১৮ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সন্ধ্যা পৌনে ৬টা এক সংবাদ সম্মেলনে বিরোধীদলহীন একতরফা নির্বাচনের প্রতিবাদে রাজধানীর নয়াপল্টনস্থ দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে দলের নেতাকমীদেরসহ দেশবাসীকে সমবেত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি রাজধানীমুখী এ কর্মসূচি নাম দিয়েছিলেন “মার্চ ফর ডেমোক্রেসি” বা গণতন্ত্রের অভিযাত্রা। কর্মসূচি পালনের বিরোধী দল সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করলে সরকারের বাধায় তা সফল হয়নি।

১৮ দলকে কর্মসূচি পালনে অনুমতি দেয়নি পুলিশ। তাছাড়া ২৭ ডিসেম্বর শুক্রবার ও ২৮ ডিসেম্বর শনিবার সরকারি সমর্থনে সারা দেশের সঙ্গে সড়ক, নৌপথ ও রেলপথ বন্ধ রাখা হয়। ফলে ঢাকামুখী জনস্রতের পথে পথে বাধার সম্মুখিন হয়।

২৯ ডিসেম্বর কর্মসূচি পালন করতে না পেরে বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া দ্বিতীয় দিন অর্থাৎ ৩০ ডিসেম্বর “মার্চ ফর ডেমোক্রেসি” কর্মসূচি বাড়িয়েছিলেন। কিন্তু ওই দিনও বের হতে পারেননি বিএনপির চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও ১৮ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা।

দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা : বিএনপি-জামায়াত নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ও সরকার এবং বিরোধী জোটের বাইরে থাকা একাধিক রাজনৈতিক দলের আপত্তির মুখে ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদের তফসিল ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তফসিল অনুযায়ী আগামী ৫ জানুয়ারি নির্বাচন হওয়ার কথা রয়েছে।

লাগাতার অবরোধ: ২৫ নভেম্বর দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট বিভিন্ন মেয়াদে টানা অবরোধ পালন করে। অবরোধ কর্মসূচি থেকে বাদ পড়েনি শনিবারও। সরকার বিরোধী জোট ঘোষিত পঞ্চম দফা অবরোধ পালিত হওয়ার পর ২৪ ডিসেম্বর মঙ্গলবার সন্ধ্যায় সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন বেগম খালেদা জিয়া।

আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর: বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকরও ছিল এ বছরের অন্যতম আলোচিত বিষয়। বছরের শুরুর দিকে একাত্তরে মানবাতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে আর্ন্তজাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আবদুল কাদের মোল্লার যাবজ্জীবন কারাদন্ড দেয়। রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চ আবদুল কাদের মোল্লার শাস্তি বাড়িয়ে মৃত্যুদ- দেওয়ার দাবি করে। এর পর সরকার আইন সংশোধন করে যুদ্ধাপরাধ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের সুযোগ সৃষ্টি করে। রাষ্ট্রপক্ষের আপিলে জামায়াত নেতা আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসির আদেশ হয়। যেটি এ বছরের ১২ ডিসেম্বর কার্যকর করা হয়। আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি স্থগিত করা জন্য পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের সরকার প্রধানরা বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ করেছিল।

৫ মে শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ : চলতি বছরের অন্যতম আলোচিত ঘটনা ছিল ৫মে হেফাজতে ইসলামে সমাবেশ। রাজধানীর মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের আমীর আল্লামা আহমেদ শফী মতিঝিলের শাপলা চত্ত্বরে হেফাজতে ইসলামের সমাবেশ আহ্বান করলে সরকার প্রথমে এ সমাবেশের অনুমতি দেয়নি। পরে সরকারের অনুমতি নিয়ে সমাবেশ শেষ করে শাপলা চত্ত্বরে অবস্থানের ঘোষণা দেয় সংগঠনিটি।

১৩ দফা দাবি মানা না হলে রাজপথ ছেড়ে যাবেন না বলেও ঘোষণা দিয়ে মতিঝিলে অবস্থান গ্রহণ করেন সংগঠনের লাখ লাখ নেতাকর্মী। ওই দিন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম সন্ধ্যায় এক সংবাদ সম্মেলন করে হেফাজতে ইমলামের নেতকর্মীদের রাজপথ ছেড়ে দেওয়া আহ্বান জানালেও তা আমলে নেয়নি সংগঠনটি। পরে রাতের অন্ধকারে সরকার আইন-শৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা একটি বিশেষ অভিযান পরিচালনা করে শাপলাচত্ত্বর থেকে হটিয়ে দেয় হেফাজত কর্মীদের। এ বিশেষ অভিযান ও এর সমসাময়ীক সময়ে বেশকিছু লোক নিহত হয়। যদিও নিহতের প্রকৃত সংখ্যা নিয়ে বিভ্রান্তি রয়েছে।

৪৮ ঘণ্টার আল্টমেটাম: বর্তমান সরকারকে নিরপেক্ষ নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি মানতে ৪৮ ঘণ্টার আল্টিমেটাম দিয়েছিল ১৮ দলীয় জোট। ২০১৩ সালের ৪ মে রাজধানীর নয়াপল্টনস্থ বিএনপির দলীয় কার্যালয়ের সামনে অনুষ্ঠিত মহাসমাবেশে বিএনপির নেত্রী এ আল্টিমেটাম দেন। কিন্তু বিএনপির দেওয়া আল্টিমেটামে কান দেয়নি সরকার।

২০১৩ সালের প্রথম দিন বিএনপির নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোট ১ মাসব্যাপী কর্মসূচি ঘোষণা দিয়ে বছরটি শুরু করেছিলেন। দলের পক্ষ থেকে ওই কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য তরিকুল ইসলাম।

এরশাদের ডিগবাজির রাজনীতি: সাবেক রাষ্ট্রপতি ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ বছর জুড়েই ডিগবাজির রাজনীতি করেছেন। মহাজোটে আছি, মহাজোটে নেই। নির্বাচনে যাবো, নির্বাচনে যাবে না। এ ধরণের নানান কথা বলে দেশেবাসীকে আকৃষ্ট ও বিরক্ত করেছেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। একতরফা  নির্বাচনে অংশ নেওয়ার ঘোষণা দেওয়া দেশে বিভিন্ন এলাকায় এরশাদের কুশপুত্তলিকাদহ করে বিক্ষুব্ধ জনতা। আবার নির্বাচনে না যাওয়ার ঘোষণা দেওয়ায় সিএমএইচ হাসপাতালে থাকা এরশাদের মুক্তি দাবি করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।

অপরদিকে নির্বাচন থেকে সরে না আসায় এরশাদের দল থেকে বের হয়ে নতুন দল গঠন করেন জাতীয় পার্টির প্রভাবশালী নেতা কাজী জাফর। এরশাদ ও কাজী জাফর একে অপরকে পাল্টাপাল্টি বহিষ্কারও করেন।

সরকারের শক্ত অবস্থান : বছরজুড়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলার মতো একাধিক ইস্যু বিএনপির হাতে থাকলেও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দৃঢ়তা ও রাজনৈতিক দক্ষতার কারণে সরকার সব ইস্যু শক্ত হাতে সামলিয়ে নেয়।

পুলিশ সদস্য সিদ্ধার্থের নিহতের ঘটনায় দেশবাসী যেমন মর্মাহত, তেমনি বিরোধী দলের কর্মসূচি চলাকালীন সময়ে শাহবাগে পেট্রলবোমায় আহত গৃহবধূ গীতা সরকার এর বক্তব্যেও মানুষকে নতুনভাবে ভাবিয়ে তুলেছে।

সংঘর্ষ ও সহিংসতায় আহতদের ২ ডিসেম্বর হাসপাতালে দেখতে যান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। ওই সময় পেট্রলবোমায় আহত গৃহবধূ গীতা সরকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে উদ্দেশ্যে করে বলেছিলেন, আমরা আপনাদের তৈরি করছি, আপনারা আমাদের তৈরি করেন নাই। আমরা আমাদের স্বামীরটা খাই। আপনারা আমাদের নিয়ে ছিনিমিনি খেলছেন। আমরা ভালো সরকার চাই…আমরা অসুস্থ সরকার চাই না।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here