পার্বত্য রাঙামাটির ভারত সীমান্তবর্তী দুর্গম সাজেকের প্রতিটি শ্যামল পাহাড়ে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে এখন ঝুলছে ফিকে হলুদ রঙের কমলা। অষ্ট মধুর টসটসে রস আর মনমাতানো গন্ধের কারণে সকল বয়সী মানুষের কাছেই কমলা একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় ফল। একসময় শুধু আমদানি নির্ভর এ ফলটির চাষ শুরু হয় দেশের সিলেট অঞ্চল থেকে। শখের বসে বাঘাইছড়ির দুয়েক জায়গায় এই চাষ শুরু করে চাষীরা ভালো পেয়ে এখন অনেকটা বাণিজ্যিকভাবেই চাষ করছে কমলা। কমলার চাষ ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে পুরো পার্বত্য চট্টগ্রামে। পাহাড়ের পতিত ভূমিসমূহ এখন রসালো কমলার মোক্ষম আবাদস্থল। সাজেকের রসালো কমলার জনপ্রিয়তাও বাড়ছে দিন দিন। উপযোগী মাটিতে উৎপাদিত এসব কমলা খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি রসালো।

বাঘাইছড়ি উপজেলার দুর্গম সাজেক ইউনিয়নের ছয়নালছড়া, শিয়ালদাইলুই ও ব্যাটলিং মৌজার প্রতিটি পাহড়ে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে ঝুলছে টসটসে কমলা। রসালো ও সুস্বাদু কমলার জন্য বিখ্যাত সাজেকের পাহাড়ে এক বার গেলে যেন বার বার যেতে মন চায় কমলা বাগান দেখতে। সাজেক পাহাড়ের রসালো আর মিষ্টি কমলার বাগান সরেজমিনে দেখতে গিয়েছিল এ প্রতিবেদক। সেখানে পাহাড়ের পাদদেশে ঢালু জায়গায় প্রতিটি টিলায় গড়ে উঠেছে কমলার বাগান। এক একটি টিলায় দুই,শ থেকে তিন,শ কমলার গাছ রয়েছে। ব্যক্তি মালিকানাধীন এসব বাগানে এ বছর কমলার ফলন হয়েছে খুব ভালো। চাষিরা যার যার বাগানে কমলার পরিচর্যা করছে; বর্তমানে বাগানে কমলার রং ধরেছে। চাষিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, এ বছর আবহাওয়া অনুকূল থাকায় সাজেক পাহাড়ে কমবেশি প্রতিটি পরিবার কমলা চাষ করেছেন। এখানকার মানুষ একসময় শুধু জুম চাষের ওপর নির্ভলশীল ছিল। বর্তমানে জুম চাষে ফলন ভালো না হওয়ায় সেখানকার অধিকাংশ পরিবার কমলা চাষের দিকে ঝুঁকেছেন। পরম মমতায় এসব বাগান গড়ে তুলেছে তারা।

পাহাড়ি এসব কমলা স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে এখন জেলার বাইরে বাজারজাত হচ্ছে; রপ্তানির সম্ভাবনাও জাগিয়েছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের সব উপজেলাতেই বর্তমানে কমলার চাষ হলেও রাঙামাটি জেলায় বাঘাইছড়ি উপজেলার সাজেক, নিউলংকর, ওল্ডলংকর ও তুইচুই এলাকায় চাষ হচ্ছে বেশ উন্নতমানের কমলা। তবে কাপ্তাই, বরকল, নানিয়ারচরসহ বিভিন্ন উপজেলায়ও বাণিজ্যিকভিত্তিতে কমলার হচ্ছে। তাছাড়া রাঙামাটি সদর, নানিয়ারচর, কাপ্তাই ও বিলাইছড়িতে কমলার চাষ নিয়ে কৃষি বিভাগ ও পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড কাজ করছে। বিশেষ করে কলম পদ্ধতির চারাগাছে এক বছরের মাথায় ফল ধরে বলে এ চারা ক্রয়ের জন্য সাধারণ মানুষের মাঝে আগ্রহ বাড়ছে। কৃষি স¤প্রসারণ বিভাগের একজন সহকারী উদ্যানতত্ত¡বিদ জানিয়েছেন, এ বছর ব­ক ও বসতবাড়ি মিলে ১৭০ একর জমিতে কমলার চাষ হয়েছে। পরিচর্যার জন্য ৩,৯৯০টি পুরাতন কমলা গাছে ওষুধ (ট্যাবলেট) ব্যবহার করা হয়েছে। এবারে ১,৩৫০ জন কৃষককে কমলা চাষের ট্রেনিং দেওয়া হয়েছে।

কৃষি গবেষকগণের মতে, মাটিতে অ¤­তার মাত্রা সাড়েচার থেকে সাড়েপাঁচ পর্যন্ত থাকলে সে জমি কমলা চাষের জন্য উপযোগী। পাহাড়ি মাটির উপর গবেষণায় এ মাত্রা নিশ্চিত হয়েছে কৃষিবিদরা, এখানে বার্ষিক গড় বৃষ্টিপাত আড়াই হাজার থেকে তিন হাজার মিলিমিটারের মধ্যে থাকায় পাহাড়ের জলবায়ু কমলা চাষের জন্য বেশ উপযোগী। তবে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা প্রয়োজনীয় মাত্রায় না থাকায় আগহ থাকা সত্তে¡ও গরীব চাষিরা ব্যপকভাবে এ চাষে আসতে পারছেনা। কৃষি উপকরণ ও ঋণ সহায়তা দিয়ে চাষিদের উৎসাহিত করা গেলে বাণিজ্যিকভিত্তিতে এখান থেকে প্রচুর কমলা উৎপাদন করা সম্ভব। ছয়নালছড়া গ্রামের কুঞ্জমনি চাকমা জানান, আমি সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে সরকারের সহযোগিতা ছাড়াই কমলা বাগান করেছি। এখানো কোনো কৃষি কর্মকর্তার দেখা পাইনি।  তার মতে যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত হলে এবং সরকারি পৃষ্ঠপোষকতা পেলে আমরা আরও লাভবান হতাম।  যোগাযোগ ব্যবস্থার কারণে বাজারজাত করতে না পারায় চাষিরা কমলার ন্যায্যদাম পাচ্ছেনা বলে মনে করেন। এলাকা থেকে বাজারে কমলা বিক্রি করতে আনার জন্য পাঁয়ে হেটে আসতে হয় ২/৩ দিন। বহনযোগ্য কোন বাহন না থাকায় কাঁধে ও পিঠে (ঠুরুং) করে কমলা বহন করতে হয়। এ দীর্ঘ সময়ের পাহাড়ি আঁকা-বাঁকা পথ আর উচুঁ-নিচু পাহাড় বেয়ে বাজারে কমলা আনতে আনতে দুই তৃতীয়াংশ কমলা পঁচে নষ্ট হয়ে যায়। ফলে তাদের কমলার দামতো দূরের কথা, বহন করে আনার কষ্টের দামও উঠেনা। তাই কৃষকরা স্থানীয় ভাবে পানিরদরে তাদের কমলা বিক্রি করে দেয়। এতোকষ্টের পরও তারা থেমে নেই। তবে রাঙামাটি শহরের বাজারে বড় সাইজের প্রতি জোড়া কমলা বিক্রি হচ্ছে ১৫টাকা এবং ছোট সাইজের প্রতি জোড়া ১০টাকা। সাধারণত মে-সেপ্টেবর মাসে কমলা রোপণের ভাল সময় হলেও সারা বছরই চারা লাগানো যায়। নার্সারিতে চারা ২০ টাকা এবং কলম বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকা দরে।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/অলমগীর মানিক/রাঙ্গামাটি

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here