'মিজান ভাই, যে জিনিস দিয়েছি হাজার মানুষ মরবে'ষ্টাফ রিপোর্টার :: ‘মিজান ভাই, সালাম নিবেন। আমি যে জিনিস দিয়েছি দেখতে যদিও সাধারণ, কিন্তু উহা বড়ই ধ্বংসাত্মক। যদি কোনো জনসভায় ছোড়া হয় তাহলে হাজার মানুষ মরবে। যত বড় স্থাপনা/বিল্ডিং এবং ব্রিজ/সেতু হোক, তার জন্য একটাই যথেষ্ট।

বিমান ওঠানামার মুহূর্তে অথবা বিমানবন্দরে নিক্ষেপ করা হলে সবই ধ্বংস হয়ে যাবে।’- উর্দু ভাষায় লেখা এমন চিঠিসহ বিধ্বংসী ক্ষমতাসম্পন্ন বিস্ফোরক ইমপ্রোভাইজড এক্সপ্লোসিভ ডিভাইস (আইইডি) সিলেট সীমান্ত দিয়ে পাঠানো হচ্ছিল বাংলাদেশে।

সম্প্রতি তামাবিল থেকে সিলেটগামী একটি বাস থেকে এ রকম আটটি ডিভাইস জব্দ করেছেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) সদস্যরা। তবে এর সঙ্গে জড়িত কাউকে আটক করা যায়নি। চিঠিটি বাংলায় অনুবাদ করে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে বিজিবি।

এদিকে চট্টগ্রাম নগরীর একটি বাড়ি থেকে বিপুল পরিমাণ বিস্ফোরক, হাতবোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করেছে র‌্যাব। শুক্রবার রাত থেকে গতকাল শনিবার সকাল পর্যন্ত নগরীর হালিশহরের একটি আবাসিক এলাকার ওই বাসায় অভিযান চালিয়ে এগুলো জব্দ করে র‌্যাব-৭। এ সময় তিনজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে আরো একজনকে।

জব্দ করা সরঞ্জামের মধ্যে রয়েছে বস্তাভর্তি ১৫০ কেজি বিস্ফোরক দ্রব্য, বোমা তৈরির ৩০ ধরনের সরঞ্জাম, আধা কেজি গান পাউডার, গ্রেনেডের মতো দেখতে ৭৬টি হাতবোমা এবং ২৪টি গুলি। এ ছাড়া কিছু ফ্লাস্ক, গ্লাভস ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ব্যবহৃত বুটও রয়েছে। ছাত্রশিবিরের সংবিধান ও ছাত্রী সংস্থার কিছু কাগজপত্রও পাওয়া গেছে। কক্সবাজারের একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সনদও ছিল এর মধ্যে।

জব্দ করা বিস্ফোরক ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম দেখতে গতকাল ঢাকা থেকে হেলিকপ্টারে উড়ে চট্টগ্রামে আসেন র‌্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ঘটনাস্থলে র‌্যাবের ডিজি সাংবাদিকদের বলেন, ‘উদ্ধার করা বিস্ফোরক দিয়ে সেনাবাহিনীর একটি ব্যাটালিয়ন চালানো যায়।’ আর র‌্যাবের বোমা বিশেষজ্ঞ মেজর খালিদ বলেছেন, এই পরিমাণ বিস্ফোরক দিয়ে দেড় থেকে দুই হাজার বোমা বানানো যেত। আর উদ্ধার করা বোমাগুলো বিস্ফোরিত হলে আশপাশের অন্তত ৩০ বর্গগজ এলাকায় ব্যাপক ক্ষতি হবে এবং লোকজন মারা যেতে পারে।

এর আগে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রামের হাটহাজারির আবু বক্কর (র.) মাদ্রাসায় অভিযান চালিয়ে জঙ্গি সন্দেহে ১২ জনকে আটক করা হয়। ২২ ফেব্রুয়ারি বাঁশখালীর সাধনপুরে লটমণি পাহাড়ে ‘জঙ্গি প্রশিক্ষণকেন্দ্রে’ অভিযান চালিয়ে পাঁচজনকে আটক করা হয়। এ সময় বিপুল পরিমাণ গোলাবারুদও জব্দ করা হয়। র‌্যাবের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তিন অভিযানই একই সুতায় বাঁধা।

শুক্রবার রাতে অভিযান চালানো হয় চট্টগ্রামের হালিশহর আবাসিক এলাকার কে ব্লকের ১ নম্বর লেনের ১/১৯ নম্বর বাড়ির দ্বিতীয় তলায়। বি এ ম্যানশন নামের বাড়িটির মালিক যুক্তরাষ্ট্রে থাকেন।

গ্রেপ্তার ও আটক ব্যক্তিরা এক মাস আগে ওই বাড়ির দ্বিতীয় তলার ফ্ল্যাটটি ভাড়া নিয়েছিলেন। গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন কক্সবাজারের পেকুয়া উপজেলার ফয়জুল হক (৩০), তাঁর বোন রহিমা আক্তার (২১) এবং বাগেরহাটের মোড়েলগঞ্জ উপজেলার আব্দুল হাই (৩৬)। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে জাহেদ (২৫) নামের একজনকে। গতকাল রাতে এ প্রতিবেদন লেখা পর্যন্ত চারজন র‌্যাব হেফাজতেই ছিলেন।

র‌্যাব-৭-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ জানান, হাটহাজারীর ওই মাদ্রাসা এবং বাঁশখালীর পাহাড়ি এলাকা থেকে গ্রেপ্তার ব্যক্তিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে নগরীর একটি গোপন আস্তানার তথ্য দেন। পরে গোপন সংবাদের ভিত্তিতে র‌্যাবের একটি বিশেষ দল শুক্রবার সন্ধ্যার পর থেকে হালিশহর এলাকায় অভিযান চালায়। অভিযানের শুরুতে ওই ভবনের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষ থেকে এক নারীসহ চারজনকে আটক করা হয়। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে তাঁরা জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেন। এরপর তল্লাশি চালিয়ে সেখান থেকে বিপুলপরিমাণ বিস্ফোরক, বোমা ও বোমা তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়।

দুপুরে বেনজীর আহমেদ সাংবাদিকদের বলেন, ‘হাটহাজারী ও বাঁশখালী থেকে গ্রেপ্তার জঙ্গিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে এ অভিযান চালানো হয়েছে। এবার গ্রেনেডসদৃশ বোমা এবং বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে। এসব দিয়ে বড় ধরনের নাশকতা চালানো সম্ভব হতো। এখানে বানানো বোমাগুলোয় ফিউজ লাগানো ছিল। অদ্ভুত সব ফ্লাস্ক ব্যবহার করা হয়েছে। এসএস পাইপে বোমা তৈরি করা হয়েছে।’ র‌্যাবের ডিজি বলেন, ‘দেশে নাশকতা চালানোর ভয়াবহ তৎপরতা ছিল। র‌্যাবের তৎপরতার কারণে তা আগেভাগে ভেঙে দিতে পেরেছি। এ জন্য দেশের মানুষকে ধন্যবাদ।’

কোনো জঙ্গিগোষ্ঠী এ ধরনের ঘটনার সঙ্গে জড়িত- সাংবাকিদের এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের ডিজি বলেন, ‘জঙ্গিগোষ্ঠী কারা সেটি এই মুহূর্তে বলতে চাচ্ছি না। তদন্তের পর বলতে পারব।’ তিনি বলেন, ‘এ ধরনের বিশাল আন্ডারগ্রাউন্ড কর্মযজ্ঞ করতে হলে বড় ধরনের নেটওয়ার্ক এবং অর্থনৈতিক সাপোর্ট দরকার। আমরা দেখেছি জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক আছে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে যেসব জঙ্গিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে তাদের দেশীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক যোগাযোগ আছে কি না সেগুলো অবশ্যই খতিয়ে দেখা হবে। এটা আমাদের এক নম্বর অগ্রাধিকার। জঙ্গি তৎপরতার সঙ্গে চলমান অস্থিরতার যোগসূত্র আছে কি না তা তদন্ত করে দেখা হবে। জামায়াতে ইসলামীর ছাত্রসংগঠন ছাত্রশিবিরের সংবিধান এবং ছাত্রী সংস্থার কাগজপত্র পাওয়ায় জঙ্গিদের সঙ্গে ছাত্রশিবিরের যোগসূত্র আছে কি না তারও তদন্ত হবে।’

উর্দু চিঠিসহ ভয়ংকর বিস্ফোরক জব্দ : গত ৮ ফেব্রুয়ারি সকালে তামাবিল থেকে সিলেটগামী একটি বাস থেকে উর্দু চিঠিসহ ডিভাইসগুলো জব্দ করে বিজিবি। বিজিবি সূত্র জানায়, ডিভাইসগুলো জব্দের পর এ ব্যাপারে অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কর্মকর্তাদের জানানো হয়েছে। সবাই মিলে এখন জড়িতদের গ্রেপ্তারে কাজ চলছে।

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ৮ ফেব্রুয়ারি দুপুর পৌনে ১২টার দিকে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে বিজিবি জানতে পারে তামাবিল থেকে সিলেটগামী একটি বাসে করে মারাত্মক বিস্ফোরক নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। এ তথ্যর ভিত্তিতে উত্তর-পূর্ব রিজিয়নের অধীন সিলেটের পাঁচ বিজিবি ব্যাটালিয়নের শ্রীপুর বিওপির একটি টহল দল সিলেট-জাফলং সড়কের আসামপাড়া এলাকায় বাসটি থামায়। বাসটি (সিলেট জ ১১-০৩২৬) তল্লাশি করে ব্যাগের ভেতরে রাখা জিরার মধ্য থেকে ডিভাইসগুলো পাওয়া যায়। প্রতিটি আইইডিতে একটি করে সেফটি ফিউজ, ডেটোনেটিং কর্ড ও নন-ইলেকট্রিক ডেটোনেটর এবং ১২৫ গ্রাম এক্সপ্লোসিভ জেল ছিল। সব কিছু কাপড় ও স্কচটেপ দিয় পেঁচিয়ে শুধু সেফটি ফিউজ বের করে রাখা ছিল, যাতে ফিউজে আগুন ধরিয়ে বিস্ফোরণ ঘটানো যায়।

ডিভাইসগুলোর সঙ্গে উর্দু ভাষায় লেখা এক পাতার একটি চিঠিও পাওয়া যায়। তাতে আইইডি সম্পর্কে বিবরণ দেওয়া আছ। চিঠিতে আরো লেখা রয়েছে, ‘আমি যেভাবে লাগিয়ে পাঠিয়েছি সেভাবেই আগুন লাগিয়ে তৎক্ষণাৎ নিক্ষেপ কর, না হয় নিঃশেষ হয়ে যাবে। তুমি যে টাকা পাঠিয়েছ তা পেয়েছি। যদি প্রয়োজন পড়ে গোয়াইনঘাটের মতিনের সঙ্গে কথা বলতে হবে। মতিনের ভাই তথায় আসবে। আমি যে জিনিস দিয়েছি তাতে যদি কোনো ভুল হয় তা হলে আমার লোক পাঠাব, সে সব করে দেবে। এসব কথাবার্তা অন্য কোথাও বলবে না।’- ইতি মনজুর খান। বিজিবি পুরো বিষয়টি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে জানিয়েছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে গতকাল রাতে বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল আজিজ আহমেদ  বলেন, ‘যেগুলো উদ্ধার করা হয়েছে সেগুলো বেশ শক্তিশালী ডিভাইস। গোয়েন্দা তথ্যর ভিত্তিতে সেগুলো জব্দ করা গেছে। গোয়েন্দা তৎপরতা বৃদ্ধি করার জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’

গাজীপুরে ককটেল বানাতে গিয়ে কবজি উড়ে গেছে শিবিরকর্মীর : গতকাল গাজীপুরে ককটেল বানানোর সময় বিস্ফোরণে আবদুল আলিম (৩৭) নামে এক শিবিরকর্মীর হাতের কবজি উড়ে গেছে। পুলিশ আহত অবস্থায় তাঁকে আটক করেছে। পরে তাঁর বাড়িতে অভিযান চালিয়ে গান পাউডার, পেট্রল, ও পেট্রলবোমা তৈরির সরঞ্জাম জব্দ করা হয়েছে।

আলিমের বাড়ি গাজীপুর মহানগরীর চান্দনা এলাকায়, বাবার নাম জমির উদ্দিন মুন্সী। জয়দেবপুর থানার ওসি খন্দকার রেজাউল হাসান রেজা জানান, গতকাল সকাল ১০টার দিকে ককটেল তৈরির সময় আলিমের ঘরে বিস্ফোরণ ঘটে। এতে তাঁর বাম হাতের কবজি ও ডান হাতের বুড়ো আঙুল উড়ে যায়। আহত অবস্থায় পালানোর সময় এলাকাবাসীর সহায়তা পুলিশ তাঁকে আটক করে শহীদ তাজউদ্দীন আহমদ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করে। এ সময় আলিমের অন্য সঙ্গীরা পালিয়ে যায়। পরে অভিযান চালিয়ে ঘটনাস্থল থেকে এক কেজি গান পাউডার, পাঁচ লিটার পেট্রল ও পেট্রলবোমা তৈরির জন্য রাখা বেশ কিছু খালি বোতল জব্দ করা হয়।

ওই হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক আব্দুস সালাম সরকার জানান, উন্নত চিকিৎসার জন্যে আলিমকে ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে।

এলাকাবাসী জানায়, আলিম শিবিরের সাথী। তাঁর বড় ভাই বসির জেলা জামায়াতের রুকন। নাশকতা সৃষ্টির অভিযোগে দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে জয়দেবপুর থানায় একাধিক মামলা রয়েছে। গতকাল ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখা গেছে, যে ঘরে বোমা বানানো হচ্ছিল তা পুলিশ তালা দিয়ে রেখেছে। বাড়ির অন্য সদস্যরা ঘটনার পর আত্মগোপনে রয়েছে।

পরীক্ষাকেন্দ্রে ককটেল হামলা : গতকাল সকালে গাজীপুর চৌরাস্তার চন্দনা হাই স্কুল অ্যান্ড কলেজে এসএসসি পরীক্ষার কেন্দ্রে একটি ককটেল নিক্ষেপ করে দুর্বৃত্তরা। সেটি বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হলেও এতে কেউ হতাহত হয়নি। ঘটনার পর কেন্দ্রে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here