[author ]- শফিকুল ইসলাম[/author]

untitled-1_74কিশোরগঞ্জের ইতিহাসের আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে  হাওর। কেবল ভূ-প্রকৃতিগত বৈচিত্র্যের কারণে নয়, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক এবং প্রাকৃতিক সৈান্দর্যের দৃষ্টিকোণ থেকেও এই হাওর এক বিরাট স্থানজুড়ে আছে।  হাওর মুলতঃ সাগর শব্দের অপভ্রংশ মাত্র। উচ্চারণ বিকৃতিতে সাগর থেকে সায়র এবং সায়র থেকে হাওর হয়েছে বলে ব্যাখ্যা করা হয়ে থাকে। বর্ষাকালে বিশাল হাওর এলাকায় অথৈ জলরাশি দেখলে সাগরের কথাই মনে করিয়ে দেবে। হাওর আর কিছু নয়, এটা অপেক্ষাকৃত বড় জলাভূমি।

নিকলী’র দর্শনীয় স্থানসমূহ:-
হাওরের একেবারে কূল ঘেষে নিকলী উপজেলা পরিষদের অবস্থান। নিকলী কিশোরগঞ্জ সড়কের কুর্শা হতে নিকলী উপজেলা পরিষদ হয়ে বেড়ীবাঁধ পর্যন্ত দীর্ঘ
প্রতিরক্ষা দেয়ালে বর্ষায় বিশাল সব ঢেউয়ের আছড়ে পড়ার দৃশ্যটি সত্যিই মনোমুগ্ধকর। চাঁদ রাতে বেড়ীবাঁধের বেঞ্চে বসে আপনি সম্পূর্ণ নিরাপদে রাতের হাওর অবলোকন করতে পারেন। এখানে দাঁড়িয়ে যতদূর দৃষ্টি যাবে শুধুই পানি আর পানি। এখানকার সবচেয়ে আকর্ষনীয় দৃশ্য ভোরের সূর্যোদয়। দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি ভেদ করে ভোরের সূর্যদয়ের দৃশ্যটি দেখলে যেন কক্সবাজার বা কুয়াকাটা সমুদ্র সৈকতেরই প্রতিরূপ দেখতে পাবেন যা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বস করা যাবে না।

১) গুরই শাহী মসজিদ: উপজেলা সদরের সোজা দক্ষিণ দিকে অবস্থিত গুরই ইউনিয়নে অতি প্রাচীন এ মসজিদটি অবস্থিত স্থাপত্যশৈলীর বিচারে অতি প্রাচীর এ মসজিদটি একটি প্রত্মতাত্ত্বিক নিদর্শন, এতে কোন সন্দেহ নেই। মসজিদটির দেয়ালগাত্রে স্থাপিত শিলালিপিটির পাঠোদ্ধার করা গেলে এর ইতিহাস জানা যেতে পারে। এ মসজিদকে ঘিরে এ অঞ্চলে অনেক কথা প্রচলিত রয়েছে। যেমন অনেকেই বলেন, এটি নাকি গায়েবী মসজিদ। এখনও অনেক মায়েরা তাদের শিশু সন্তানদের মুখে প্রথম ভাত দেয়ার সময় স্বপরিবারে গুরই শাহী মসজিদে যান।

২) হাজী সাহেবের দরগা: নিকলী সদর ইউনিয়নের পূর্বগ্রামের দরগাহাটিতে মহান ধর্মীয় ব্যক্তিত্ব হাজী সাহেবের মাজার (দরগা) শরীফ অবস্থিত। মাজার সংলগ্ন মসজিদ এবং পাশেই দরগাবাড়ী কবরস্থান। এখানে প্রতিবছরই ওরছ অনুষ্ঠিত হয়।

৩) পাহাড় খাঁর ভিটা: নিকলী উপজেলা সদরের ঠিক উত্তরদিকে মজলিশপুর গ্রামের পশ্চিমে হাওড়ের মাঝে দ্বীপ সদৃশ গোলাকৃতির এ ভিটাতে সাধক পুরুষ পাহাড় খাঁর মাজার রয়েছে। বর্যার দ্বীপ সদৃশ এ ভিটাকে হাওড়ের পানিতে ভাসমান কোন বস্তু মনে হতে পারে। পাহাড় খাঁর শিষ্য আনু পাগলার সামধিও এ ভিটাতেই। এলাকায় এবং এলাকার বাহিরে তাঁদের অনেক ভক্তবৃন্দ রয়েছ। প্রতি বছর বর্ষার শুরুতে শিষ্যের ওরছ ভক্তবৃন্দের সমাগম হয় এ ভিটাতে।

৪) হযরত শাহ গুণ জালাল (র:)এর মাজার: দামপাড়া ইউনিয়নের উত্তর দামপাড়ায় সাহেবের হাটিতে 360 আউলিয়ার একজন হযরত শাহ জালাল (র:)এর মাজার অবস্থিত। বাৎসরিক ওরছে অনেক বরেণ্য ওলামায়ে কেরাম এ মাজারে জিয়ারতে আসেন। এলাকায় খুবই সম্মানীয় এ মাজার শরীফ।

৫) ছেত্রা গ্রামের আখড়া: গুরই ইউনিয়নের নিভৃত গ্রাম ছেত্রা।এ গ্রামেই রয়েছে বহু পুরাতন স্থাপত্য নিদর্শন বৈষব ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান ছেত্রা আখড়া। প্রায় জঙ্গলাকীর্ণ এ আখড়াটি ভ্রমন পিপাসুদের আকৃষ্ট করবেই।

৬) ষাইটধার লাল গোস্বমীর আখড়া: উপজেলা পরিষদের উত্তর-পশ্চিম কোনে সদর ইউনিয়নের গোবিন্দপুর গ্রামে এ
আখড়াটি অবস্থিত। অতি প্রাচীন এ আখড়ার কারুকার্যময় সুউচ্চ মঠ, ভাঙা প্রাচীর, পাকাঘাট এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু সন্নাসী এখনও এ আখড়ায় অবস্থান করেন।

৭) চন্দ্রনাথ গোস্বামীর আখড়া: নিকলী সদর ইউনিয়নের মোহরকোনা ভাটিপাড়ায় সাধক চন্দ্রনাথ গোস্বামীর আখড়াটি অবস্থিত। এ আখড়া ঘিরে এ অঞ্চলে অনেক কিংবদন্তী রয়েছে। প্রচলিত আছে-একদা মনষা দেবী মানবরূপ ধারণ করে এ আখড়ায় আর্বির্ভূত হয়েছিলেন এবং তাঁর রূপে মুগ্ধ হয়ে অনেকেই তাঁকে বিবাহের প্রস্তাব দেন। এ সমস্যা সমাধানকল্পে দেবী নৌকা বাইচের আয়োজন করতে বলেন এবং যে নৌকা সবার আগে আখড়ার ঘাটে এসে ভিড়বে, সে নৌকার মাঝিকেই তিনি বিয়ে করবেন কথিত আছে, এভাবেই নিকলী’র ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচের শুরু।

৮। হাওরে মাছ ধরা: এখানকার লোকজনকে ছোট ছোট ডিঙ্গি নৌকায় প্রচন্ড ঢেউয়ের মধ্যেও হাওড়ে মাছ ধরতে দেখলে ভয় পাবেন না। এটি এখানকার নিত্য নৈমিত্তিক দৃশ্য। ইচ্ছে হলে আপনিও বড়শী অথবা জাল দিয়ে মাছ ধরতে পারেন। একটু সাহস করলে ডিঙ্গি নৌকায় বসেও মাছ ধরতে পারেন।

৪৬টি মৌজার ৭৬,১৫০,৬৩ একর জমি নিয়ে কিশোরগঞ্জ জেলার হাওরগুলোর অবস্থান। নিকলি হাওর ছাড়া কিশোরগঞ্জে আরো অনেক হাওর রয়েছে। যেমন-হুমাইপুর হাওর (বাজিতপুর), সোমাই হাওর (অষ্টগ্রাম), বাড়ির হাওর (মিঠামইন), তল্লার হাওর (বাজিতপুর-নিকলি-অষ্টগ্রাম), মাহমুদপুর হাওর (নিকলি), সুরমা বাউলার হাওর।

ঢাকা থেকে যেভাবে যাবেন: সায়দাবাদ থেকে নিকলির সরাসরি বাস আছে। বাস ভাড়া ১৫০/- টাকা। আবার সায়দাবাদ
থেকে কিশোরগঞ্জের বাসে যেয়ে কালিয়াচাপরা সুগারমিল গিয়ে সিএনজিতে নিকলি হাওরের সামনেই নামা যাবে দুরত্ব-১৬০ কিলোমিটার। সময় লাগবে তিন থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা (যাত্রাবাড়ীর ট্রাফিক জ্যামবাদে)। নিকলি হাওরে বেড়ানোর আগে একটু বিশ্রাম করে নিতে পারেন ইউএনও-এ  অন্তর্ভুক্ত। কিশোরগঞ্জ জেলা হাওর এলাকা গেইটওয়ে নামে খ্যাত। সীমানা দক্ষিণে অষ্টগ্রাম থানা, উত্তরে মিঠামইন, উত্তর-পূর্ব কোণে ইটনা, উত্তর-পশ্চিমে কটিয়াদী, পশ্চিমে নিকলী এবং পূর্বে হবিগঞ্জ জেলার লাখাই থানা। নিকলী হাওর ছাড়া কিশোরগঞ্জে আরও অনেক হাওর রয়েছে।

থাকার ব্যবস্থা: এখানকার ডাকবাংলোতে আধুনিক স্থাপত্যৌশলীতে গড়া এ ডাকবংলোয় রাত্রিযাপন আপনাকে আনন্দ দেবে। সরকারি ডাকবাংলোর নিজস্ব কুক রয়েছে্ আপনার রুচিসম্মত পছন্দের সব খাবার সে আপনাকে রান্না করে খাওয়াবে।

বিকল্প হিসেবে আছে হোটেল শাহজাহান (আবাসিক) নিকলী পুরান বাজারে নদী তীরে বেসরকারী ব্যবস্থাপনায় হোটেল শাহজাহান অবস্তিত । বেশ পরিচ্ছন্ন এ আবাসিক হোটেলেও আপনি নির্বিঘ্নে রাত্রি যাপন করতে পারেন। আর খাবার হোটেলেও তরতাজা মাছ পাবেন যা থেকে তাজা মাছের স্বাদ নিতে পারবেন।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here