তাহমিনা শিল্পীতাহমিনা শিল্পী :: আমার ছিল অনেকগুলো বাবা!  রহিম বাবা, গোলাপ বাবা, জব্বার বাবা! এভাবেই আরো অনেকগুলো…….!!! – ইমদাদুল হক মিলনের একটি বইয়ের প্রথম কয়েকটি লাইন ছিল ঠিক এইরকমই!
ভাবছেন এ আবার কেমন কথা! তবে আমি একটু খোলাশা করেই বলি। পুরোটা জানার পর নিশ্চই আর কোন দ্বিধা-দ্বন্ধ থাকবেনা আশা করছি।

ইমদাদুল হক মিলনের গল্পের মত অনেকগুলো না হলেও আমারো আছে তিনজন বাবা। আমার জীবনে যাদের কারো অবদানকেই কোন অংশে খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। আর অস্বীকার করার তো প্রশ্নই নেই। এবার আসি আমার বাবাদের প্রসঙ্গে।
এদের মধ্যে প্রথমজন আমার জন্মদাতা। যার ঔড়সে জন্ম আমার। তিনি আমার বাবা। আমি আমার বাবাকে “আব্বু” বলে ডাকি। তাতে বুঝিবা সম্পর্কের কোন ভিন্ন রূপ পাওয়া যায়না। কারন ডাক যাই হোক না কেন? বাবা সবসময় বাবার জায়গাতেই থাকে। ডাক তার জায়গাবদল করতে পারেনা।

যাহোক, বলছিলাম আমার আব্বুর কথা। যার উছিলাতে এই পৃথিবীর অপার সৌন্দর্য, আলো, রঙ, রূপ দর্শন। যার হাত ধরেই ছোট্র ছোট্র পায়ে হাঁটতে শিখা। যার চোখেই প্রকৃতি দেখা, যার স্বপ্নই নিজের স্বপ্ন করে, তারই ছায়াতে একটু একটু করে বাঁচতে শেখা এরং বেড়ে উঠা। তার ডাকেই চোখ মেলে সকালের প্রথম সূর্য দেখা। কি মধুর, মমতাময় সে ডাক! বড় হয়েছি অনেক তবুও আজো ঘুমের ঘোরে শুনতে পাই সে ডাক- “আব্বু সকাল হয়েছে, এবার উঠে পরো।” এই ডাক কানে না বাজলে যেন একটি দিনও ঘুম ভাঙে না আমার! আজো অসুস্থ হলে ঘুমের মধ্যে কপালে পাই সেই নির্ভরতার হাতের ছোঁয়া।

শুনতে পাই কেউ যেন বলছে-” ইস্ জ্বরে যে গা পুড়ে যাচ্ছে।” যেমন পেতাম আমার ছোট্র কপালে। আজো বৃ্ষ্টি হলে দুকলম লিখতে ইচ্ছে করে শুধু ছোটবেলার সেদিনের সেই বিকেল বেলার কথা মনে করেই। যেদিন বৃ্ষ্টি হয়েছিল খুব। আর আব্বু বারান্দায় ডেকে নিয়ে বলেছিল- “চলো আমরা মনোযোগ দিয়ে বৃষ্টি দেখি।” বৃ্ষ্টি যে মনযোগ দিয়ে দেখতে হয় সেই প্রথম শিখেছিলাম। আর বৃ্ষ্টি শেষ হলে বলেছিল-“যাও খাতা-কলম নিয়ে আসো। এখন আমরা এই বৃ্ষ্টি নিয়ে দুইজনে দুইটা কবিতা লিখব।

দেখি কে বেশি ভাল লিখতে পারে?”  তখন না বুঝলেও আজ বুঝি সেদিনের সেই প্রতিযোগিতার উদ্দেশ্য ছিল আমাকে লিখতে শিখানো আর উৎসাহি করা। আজো আমি বৃ্ষ্টি হলে খুব মনযোগ দিয়েই দেখি। কিছু না কিছু লিখে আব্বুকে উপহার দেই। তার আনন্দিত মুখটা দেখে নিজেও আন্দোলিত হই। আর আব্বুর সেই সুত্র মতে এখন আমি আমার ছেলেকে নিজের প্রতিযোগী করে লিখি আর ওকে লিখতে উৎসাহি করি।

আজ আমি সেই ছোটবেলার দিনগুলো থেকে অনেক দুরে চলে এসেছি। আর আব্বুও তার নাতির সাথে মজা করে বলে সে এখন আগের যুগের মানুষ। তবুও আমি আব্বুকে পাই সেই ছোটবেলার দিনগুলোর মতই। আর পরম করুনাময়ের কাছে আব্বুর দীর্ঘায়ু ও সুস্থতা কামনা করি। আর বলি আজীবন যেন আব্বুকে পাই এমনিভাবেই।

এবার আসি আমার আরেক বাবার প্রসঙ্গে। তিনি সম্পর্কে আমার শশুড়। তাকে আমি “বাবা” বলে ডাকি এবং “বাবা” বলেই মানি।
আমার অনার্স দ্বিতীয় বর্ষের প্রথম দিকে আব্বু আমাকে তুলে দিয়েছিল আমার এই বাবার হাতে। আব্বু তাকে বলেছিল-“আমার মেয়েটা আপনাকে দিলাম।”

সত্যিই বাবা আমাকে কন্যাতুল্য স্নেহ দিয়ে নিজের মেয়ের আসনেই রেখেছিলেন। এতটা স্নেহ, এতটা ভালবাসা তিনি আমায় দিয়েছিলেন যা হয়ত নিজের একমাত্র মেয়েকেও তিনি দেননি কখনো।

কতদিন সে আমাকে সাথে করে কলেজে পৌঁছে দিয়েছেন। ঢাকার রাস্তায় কোন দুর্ঘটনা হয়েছে কিম্বা রাজনৈতিক সংঘর্ষ হয়েছে শুনলেই যে আতঙ্কিত হয়ে সবার শত আপত্তি স্বত্বেও আমাকে আনতে কলেজে চলে গেছেন। সামান্য মাথাব্যথা, সর্দি-জ্বর হলেও কেমন যেন অস্থির হয়ে যেতেন। নামায শেষে মসজিদে মিলাদের তবারক নিজে না খেয়ে এনে আমাকে খাওয়াতেন এই ভেবে যে তাতে আমার মঙ্গল হবে। প্রতিবার অজুর পর মাথায় হাত বুলিয়ে দোয়া করে দিতেন যেন খুব ভাল থাকি।

আমি আপনার দোয়ায় খুব ভাল আছি বাবা। শুধু আপনি নেই বলে মাঝামাঝে কষ্ট হয় খুব। ২০০৭ সালের নভেম্বরের ১৮ তারিখ। যেদিন আপনি ওপারে চলে গিয়েছিলেন আমাদের সবাইকে ছেড়ে জীবনে সেদিন প্রথমবার নিঃশব্দে বারবার আমার চোখ ভিজে উঠেছিল। সেদিনই প্রথম আমি বুঝেছিলাম কাছের কাউকে হারানোর বেদনা।

বাবা জানি আপনি যেখানেই থাকবেন সেখান থেকেই আমার মঙ্গল চাইবেন। আর সেখানেই অনেক ভাল থাকবেন। আপনার মত ভাল মানুষদের আল্লাহ্ কখনো খারাপ রাখতে পারেননা। তবুও সন্তান হিসাবে আপনার মঙ্গল কামনায় সৃষ্টিকর্তাকে ডাকব আজীবন।

২০০৪ সালের ৩১ ডিসেম্বর যখন জন্ম নিল আমার একমাত্র ছেলে। তখন নার্স হিসাবে ছিলেন আমাদের পারিবারিক সুত্রে পরিচিত কমলা মন্ডল। উনি প্রথম ওকে দেখে বলেছিলেন-“আরে! এ যে একেবারে তোমার আব্বুর মুখ।” তারপর আমি ওকে দেখলাম আমিও অবাক, সত্যিই তো একেবারে যেন আমার আব্বুর মুখটাই ছোট আকারে দেখছি। আসলে আমার মুখখানা যে আমার আব্বুরই কার্বনকপি। ব্যাস সেদিন থেকেই ও হয়ে গেল আমার আরেকটা বাবা।

ওকেও আমি বাবা বলে ডাকি।কখনো আবার বাবুয়া, পুটুবেবীও ডাকি।ওর ছোট্র ছোট্র হাতের ছোঁয়ায় আমি সবসময়ই আব্বুর পরশ পাই।ওর সাথে কাটানো প্রতিটা মুহূর্তে আমি আবার আব্বুর সাথে কাটানো ছোটবেলাটা ফিরে পাই।

এখন আমার ঘুম ভাঙ্গে ওর ছোট্র আদরের ছোঁয়ায় আর মা ডাকে। এখন আমি ঘুমাতে যাই ওর ছোট্র মুখে আধো আধো গল্প শুনে। অফিসে যাই আমার হাতে ওর চুমুর স্পর্শ নিয়ে। বাসায় ফিরতে ও সামনে এসে দাঁড়ায় এক গ্লাস পানি হাতে। আর আদুরে গলায় বলে-‘মা তোমার আসতে কষ্ট হয়নি তো?” অসুস্থ হলেই কপালে ছোট্র হাতটা রেখে বলে-” মা তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে? আমি বাতাস করে দিব?”

এযেন আমার আব্বুকেই বারবার ফিরেফিরে পাওয়া। এযেন বারবার ছোটবেলার মত আব্বুর আদরের স্বাধ নেয়া।
বাবা! বাবুয়া আমার! আমার পুটুবেবী! তুই সবসময় ভাল থাকিস, অনেক বড় হ। আর তুই শুধু মানুষ হ। মানবতা যেন কক্ষনো ছেড়ে না যায় তোকে। এছাড়া আর যে কিছুই চাওয়ার নাই তোর জন্য পরম করুনাময়ের কাছে। আল্লাহ্ যেন অনন্ত আমার এই দোয়াটুকু কবুল করেন।

“কাটে না সময় যখন আর কিছুতেই/বন্ধুর টেলিফোনে মন বসেনা/জানলার গ্রীলটাতে ঠেকাই মাথা/মনে হয় বাবার মত কেউ বলে না/
আয় খুকু আয়……!!”

আহা….!! গীতিকার পুলক বন্দোপাধ্যায়ের লেখা এবং হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও শ্রাবন্তী মজুমদারের গাওয়া অসাধারন এই গানেই প্রকাশ পায় বাবার সাথে সন্তানদের এক চিরন্তনী নিবিড় ও আবেগী বন্ধনের। এরপরে বোধহয় বাবাকে নিয়ে আর কিছুই বলার অপেক্ষা রাখে না।

তবুও আজ ২১ জুন বিশ্ব বাবা দিবস। আজকের দিনটি কেবলই বাবার জন্য।তাই বাবাকে নিয়ে দু’চারটি কথা না বললেই নয়।
“বাবা” ছোট্ট একটি শব্দ, অথচ এর ব্যাপকতা অতি বিশাল। এই ছোট্র শব্দটিই সন্তানদেরকে এক অসীম আবেগে জড়িয়ে রাখে পরম নির্ভরতায়।

বাবা মানে পথ প্রদর্শক। বাবা মানে বিশ্বাস আর ভালবাসা।বাবা মানে আশ্রয় আর নিরাপত্তা। বাবা মানেই বেঁচে থাকার প্রেরণা আর নিশ্চয়তা। বাবা মানেই ছায়া সুনিবিড় বিশাল বটগাছ। সন্তানের জন্য এক অসীম আকাশ, পরম বন্ধু।
“বাবা” যার কারণে এই পৃথিবীর রং, রূপ ও আলোর দর্শন। সেই বাবা শব্দটির সঙ্গেই অপার স্নেহ আর মমতার এক দৃঢ় বন্ধনে জড়িয়ে থাকি আমরা।

শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর যে শব্দগুলো সবার আগে বলতে শিখে। “মা” এর পরে তারমধ্যে অন্যতম হচ্ছে “বাবা”। এ যেন সন্তানের কাছে চিরন্তন আস্থার প্রতীক।আ র সন্তান যখন এই শব্দটি উচ্চারণ করতে শিখে তখন বাবার মন আনন্দে ভরে উঠে। বাবার সেই অনুভূতি যেন তখন অবুঝ সন্তানের হৃদয়কেও আন্দোলিত করে।

বাবার প্রতি সন্তানের সেই চিরন্তন ভালোবাসার প্রকাশ প্রতিদিনই ঘটে। তারপরও বাবার প্রতি সন্তানের ভালবাসা প্রকাশের জন্য একটি বিশেষ দিন উৎসর্গ করা হয়। এরই পরিপ্রেক্ষিতে বাবা দিবসের প্রচলন।

গত শতাব্দীর প্রথমদিকে বাবা দিবস পালন শুরু হয়। আজকাল নতুন প্রজন্মের কাছে বাবা দিবসের ধারণাগুলো দিন দিন বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। আসলে মায়েদের পাশাপাশি বাবারাও যে তাদের সন্তানের প্রতি দায়িত্বশীল- এটা বোঝানোর জন্যই এই দিবস পালন শুরু।
অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জুনের তৃতীয় রবিবার নানা আয়োজনে পালন করা হয় বাবা দিবস। হাজার কষ্ট সয়ে তিলে তিলে যে সন্তানকে বড় করেছেন একজন বাবা। তাকে ঘিরেই বাঙালি সন্তানদের হৃদয়ে দিবসটি উৎসবে পরিণত হয়েছ।

যদিও একটি মাত্র দিন শুধু বাবার জন্য নয়। তবুও এই বিশেষ দিনটিতে ফুল ও কার্ড দিয়ে শুভেচ্ছা জানায়। বাবাকে নিয়ে বেড়াতে যায়। আর যাদের বাবা বেঁচে নেই তারাও এই দিনে বাবার স্মৃতি হাতরে বেড়ায়।
ছোট-বড়, ধনী-গরিব সকলের কাছেই বাবার স্নেহ-ভালোবাসা প্রথম চাওয়া আর পাওয়া।

কিন্তু বাবাদের চাওয়া খুবই সামান্য। সন্তানদের একটুখানি মনযোগ, একটু ভালবাসা। ব্যাস এতটুকু পেলেই তারা খুশি। এতটুকুনই বোধহয় তাদের পরম পাওয়া।
কিন্তু সব সন্তান কি পারছে বাবার এই সামান্য চাওয়া পুরণ করতে? পারলে বোধহয় কোন বাবাকেই থাকতে হত না বৃদ্ধাশ্রমে কিম্বা অযত্নে বাড়ির কোন অন্ধ প্রকোষ্ঠে!

তাই পৃথিবীর সব সন্তানকেই বলছি -“আসুন আজ বিশ্ব বাবা দিবসে অন্তত একবার ঘুরে আসি আমাদের ফেলে আসা ছেলেবেলাতে। দেখে আসি কিভাবে পরম মমতার চাদরে আমাদের জড়িয়ে রেখেছিল আমাদের স্নেহময় বাবা। আর সেকথা স্মরণ করেই বাবাকে ভাল রাখি আর বলি, “ভালবাসা নিও প্রিয় বাবা!”

লেখক: tahmina_shilpi@yahoo.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here