Ranga Mathay Chiruni

বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘রাঙা মাথায় চিরুনি’ : শিশু মনের চিরন্তন কৌতুহল

সানি সরকার

এখানে প্রথমে-ই বলে রাখি, আমি একদমই ছোটদের সাহিত্যের নিয়মিত পড়ুয়া নই। কখনো কখনো  গল্প, উপন্যাস বছরে কয়েকটি পড়লেও ছোটদের কবিতা বা ছড়ার সঙ্গে আমার প্রায় সংযোগ নেই বললেই চলে। কখনো ছোটদের লেখার জন্যে আমন্ত্রণ আসলে, এড়িয়ে গেছি। কারণ আমি জানি, এবং খুব গভীরভাবে বিশ্বাস করি, শিশু-সাহিত্য আমার দ্বারা কক্ষনো-ই সম্ভব নয়। কারণ শিশু সাহিত্যের জন্যে যে দৃষ্টি,অধ্যাবসায়, ধৈর্য ও নিমগ্নতার প্রয়োজন তা আমার নেই। একেবারেই নেই।

আমার ছোটদের সাহিত্য পড়ার একমাত্র কারণ, নিজেকে রিফ্রেশ করা। এমন অনেকবারই হয়েছে। লক্ষ করেছি, ছোটদের জন্যে লেখাগুলি পড়তে গিয়ে অদ্ভুত এক প্রাণোচ্ছ্বাস ছড়িয়ে যায় মনে। মনে হয় কি সুন্দর! এ-ভাবেও ভাবা যায়? কিংবা এ-ও কি সম্ভব? কত সহজ-সরল আর নিপুন বিন্যাস সেই সমস্ত লেখার ভেতরে। কোনো জটিল কিছু নেই। আসলে এটা শিশু সাহিত্য, কিশোর সাহিত্য পড়ার ক্ষেত্র বেশি ঘটে। আবার বড়োদের সাহিত্য পড়তে গিয়ে, বা  যে-কোনো বয়সের পাঠকদের জন্যে লেখা পড়তে গিয়ে ব্যাপারটি খুব ঘটে থাকে। এখানে এই এই প্রসঙ্গে এইটুকুই বলার, লেখকের লেখার সঙ্গে পাঠকের রিলেট করাটিই প্রধান। আর কিছু নয়।

পড়ছিলাম প্রিয় কবি ও সাহিত্যিক  বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়-এর ছোটদের কবিতা-ছড়ার বই ‘রাঙা মাথায় চিরুনি’। নামটির মধ্যিখানে-ই কেমন মায়াময়তা আর সারল্য আছে তাই না? হ্যাঁ ঠিক তাই। ঠিকই ধরেছেন। আমারও তেমন-ই মনে হল। বিপ্লব দু-হাত উজাড় করে লেখেন এটা আমরা প্রত্যকেই জানি। তাঁর বিচরণ বাংলা সাহিত্যের সমস্ত শাখায়। কিন্তু ওঁর শিশু সাহিত্য, শিশুতোষ সাহিত্য বা কিশোর সাহিত্যের সঙ্গে এতো প্রগাঢ় হৃদ্যতা কিন্তু আগে টের পাইনি। হয়তো এটি আমার জানার অক্ষম একটি দিক।

যাইহোক, এই বইটি পড়তে পড়তে আমার মনে হল, আমার সামনে দিয়ে একটি দুরন্ত শিশুবেলা, কৈশোরবেলা খলবল করতে করতে খেলা করলো কিছুক্ষণ। কত ছবি জীবন্ত হয়ে আমার সামনে ঘোরাঘুরি করলো। বড়ো নাড়াও খেলাম কখনো। যখন দেখলাম, একজন কিশোর বা কিশোরীর আত্মায় কবি মিশে গিয়ে লিখছেন: ‘কত কিছুই কিনতে ইচ্ছে করে/ সূর্য কিনে রাখি আঁধার ঘরে।/ সন্ধে হলেই নাচবে আলোর ঢেউ/ রাতের বেলা আসবে না ভূত কেউ।/ সাহস যাবে বেড়ে অকস্মাৎ/দাপিয়ে বাড়ি খেলবো সারারাত/কে দেখাবে আমাকে ভয় আর?/ ভূত না আমি-বলো তো জয় কার?’ মনে হল না, কবি বিপ্লবের এই কবিতার মধ্যে যে শিশু মনের অবাধ বিচ্ছুরণ, এতো আমাদেরই, একদা মনের অলিন্দে লুকিয়ে থাকা কথাগুলি-ই? শুধু তাই নয়, মনে হচ্ছে না, আমাদের সর্বকালের শিশু-কিশোরদের অনন্ত চিন্তন? হ্যাঁ, একদমই তাই।
তেমন-ই আরেকটি লেখা দাগ রেখে গেল মনে: ‘এই প্যালারাম বল তো দেখি/আকার কেমন বাতাসের?/গুনফল বল কত হবে/উনত্রিশ আর সাতাশের। /#/পদার্থ যা চোখে দেখিস/তার ক’রকম অবস্থা/বকরাক্ষস বল তো দেখি/ চাল খেত রোজ ক’বস্তা?/#/প্রশ্নগুলো মাথায় রাখিস/চললি কোথায় প্যালা?/খাতা কলম আনবি সাথে/জবাব দেব ও বেলা।

বিপ্লব যে তাঁর এই বইটিতে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন, নিঃসংকোচে তা বলা যায়। এই বইটির লেখাগুলির ভেতরে যেমন শিশু মনের বিচ্ছুরণ লক্ষ্যনীয় একটি দিক, তেমনই রূপকথা ও শিশু কিশোরদের আনন্দ প্রদানের জন্যে যথেষ্ট হাস্যরস-সমৃদ্ধ আবার নীতি-জ্ঞান মূলক উপাদান  অন্যতম বৈশিষ্ট্য, বইটির এই দিকটি এড়িয়ে গেলে চলবে না কিন্তু। কারণ ছোট্ট পেপার ব্যাকটি শিশু মনের চিরন্তন কৌতুহলকে আরেকটিবার উস্কে দেবে।

যে-কোনো বইয়ের প্রথম আকর্ষণই হল প্রচ্ছদ। শিল্পী ধীমান পাল এই বইটির আকর্ষণীয় প্রচ্ছদটি এঁকেছেন। শুধু তা-ই না, প্রতিটি লেখা ধরে, লেখার বক্তব্য ইলাস্ট্রেশনের মধ্যে দিয়ে প্রকাশ করা কম কথা নয় একেবারেই। সেই দিক থেকে অনেকটাই সফল এই শিল্পী।

________________________________________
বই: রাঙামাথায় চিরুনি
লেখক: বিপ্লব গঙ্গোপাধ্যায়
প্রচ্ছদ: ধীমান পাল
প্রকশক: সঞ্চিতা।। পুরুলিয়া,পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
দাম: তিরিশ টাকা

লেখকের ই-মেইলঃ  sany.sarkar2013@gmail.com
Attachments area
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here