ষ্টাফ রিপোর্টার :: বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যে এক ধরনের ঐক্য দৃশ্যমান বলে মনে হলেও এই প্রক্রিয়ার অংশীজনদের কারও কারও মধ্যে পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস দানা বেঁধেছে।
কারও কারও বক্তব্যে ও প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য কিছু তত্পরতায় এই সন্দেহের জন্ম দিয়েছে। বিশেষ করে বৃহত্তর ঐক্যের অন্যতম শরিক জোট যুক্তফ্রন্টের নেতৃত্বকারী দল বিকল্পধারা ঐক্যে জামায়াতের প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সংযুক্তি না রাখার বিষয়ে অনড় অবস্থান নেয়ায় বিষয়টিকে সন্দেহের চোখে দেখছে বিএনপি।
বৃহত্তর ঐক্যের আরেক শরিক জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের মধ্যেও বিকল্পধারার অবস্থান নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিএনপি, ২০ দল ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের কারও কারও ধারণা- বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া ভেস্তে দিতে ও বিএনপির জোট থেকে জামায়াতকে সরাতে কৌশলে বিকল্পধারার কোনো কোনো নেতা জামায়াতের বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসছেন।
বিএনপি ও দলটির নেতৃত্বাধীন ২০ দল শরিকদের বেশ ক’জন দায়িত্বশীল নেতার সঙ্গে কথা বললে তারা জানান, কারাগারে যাওয়ার আগে ও পরে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া স্পষ্ট বলেছেন, সরকারবিরোধী দল ও জোটগুলোকে নিয়ে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা করতে হবে।
পাশাপাশি ২০ দলের ঐক্য অটুট রাখার বিষয়েও তিনি দলের নেতাদের নির্দেশনা দিয়ে রেখেছেন। বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানও গত এক সপ্তাহে যতবার দল ও জোটের বিভিন্ন নেতাদের সঙ্গে কথা     বলেছেন ততবারই তিনি ২০ দল ঠিক রেখে এর সমান্তরালে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়া সামনে এগিয়ে নেয়ার পরামর্শ দিয়েছেন।
বিএনপি নেতারা জানান, খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের দেয়া নির্দেশনা অনুযায়ী জামায়াতকে জোট থেকে বাদ দেবে না বিএনপি।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ বলেন, ‘আমাদের (বিএনপির) কথা তো পরিষ্কার। আমরা বলেছি সংসদ ভেঙ্গে নির্দলীয় নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে সবার অংশগ্রহণে সুষ্ঠু নির্বাচন দিতে হবে। বৃহত্তর ঐক্যেরও মূল দাবি এটাই।
খালেদা জিয়াসহ সকল রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের মুক্তি দিতে হবে এবং নির্বাচনের আগে আর কাউকে গ্রেফতার করা যাবে না, এ ব্যাপারেও বৃহত্তর ঐক্যের পক্ষ থেকে অভিন্ন ঘোষণা দেয়া হয়েছে।
এখানে জামায়াতের বিষয়টি তো মুখ্য নয়। তাছাড়া জামায়াত ২০ দলে আছে, তারা তো বৃহত্তর ঐক্যের মঞ্চে উঠছে না। এ কারণে আমাদের কথা হলো- জামায়াতকে ২০ দলে রেখেই বৃহত্তর জাতীয় ঐক্য গড়তে কোনো সমস্যা নেই।’
জামায়াতের সঙ্গ ত্যাগ না করার প্রশ্নে বিএনপির এমন অনড় অবস্থানকে সহজভাবে নিচ্ছেন না যুক্তফ্রন্টের কোনো কোনো নেতা। যুক্তফ্রন্ট চেয়ারম্যান ও বিকল্পধারার সভাপতি অধ্যাপক একিউএম বদরুদ্দোজা চৌধুরীর বারিধারার বাড়িতে গত ২৫ সেপ্টেম্বর বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান ইকবাল হাসান মাহমুদ টুকুর উপস্থিতিতে জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, স্বাধীনতাবিরোধী কোনো শক্তি বা দল বৃহত্তর ঐক্যে থাকতে পারবে না। এ ব্যাপারে বিএনপির সমাবেশের (রবিবার অনুষ্ঠিত সমাবেশ) পর বিএনপি তাদের অবস্থান জানাবে বলেও ওইদিনের বৈঠকে সিদ্ধান্ত হয়েছিল। সমাবেশ যেহেতু শেষ, এখন জামায়াতের বিষয়ে বিএনপি তাদের কী অবস্থান জানায় তা দেখার অপেক্ষায় আছে যুক্তফ্রন্ট।
অধ্যাপক বি. চৌধুরী বলেছেন, ‘আমরা তো শুরু থেকেই বলে আসছি, স্বাধীনতাবিরোধী কেউ বৃহত্তর ঐক্যে থাকতে পারবে না। যারা আমাদের স্বাধীনতায় ও রক্তভেজা পতাকায় বিশ্বাস করে না, আমরা তাদের বিশ্বাস করবো কেমন করে! তাছাড়া যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার মধ্যে পাঁচ দফার ভিত্তিতে যে লিখিত অঙ্গীকার হয়েছে সেখানেও পরিষ্কার লেখা আছে, স্বাধীনতাবিরোধীরা ঐক্যে থাকতে পারবে না। কাজেই লিখিত এই অঙ্গীকার থেকে কারও পেছনে যাবার সুযোগ নেই।
বি. চৌধুরী সরাসরি ‘জামায়াত’ শব্দটি উচ্চারণ না করলেও তার ছেলে, বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী বলেছেন, জামায়াতের সঙ্গে প্রত্যক্ষ-পরোক্ষ সম্পর্ক রাখলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের মঞ্চে বিএনপির স্থান হতে পারে না। বৃহত্তর ঐক্যে আসতে হলে বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছেড়ে আসতে হবে।
এ ব্যাপারে যুক্তফ্রন্ট নেতা ও নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না গতকাল সোমবার বলেন, ‘স্বাধীনতাবিরোধী কেউ বৃহত্তর ঐক্যে থাকবে না, এটা তো আমাদের রেজুলেশন আছেই। তবে মাহী বি চৌধরী বিষয়টিকে যেমনটি করে বলছেন বি. চৌধুরী তো ওইভাবে বলেননি। মাহী বি চৌধুরী যুক্তফ্রন্টের মুখপাত্র নন, যুক্তফ্রন্টের মূল নেতা বি. চৌধুরী। সে কারণে বলবো- বি. চৌধুরী সাহেব কী বলছেন সেটিই বিবেচ্য বিষয়। কাজেই এ নিয়ে ঐক্যের ভেতরে কোনো ভুল বোঝাবুঝি আছে বলে অন্তত আমি মনে করি না।’
এদিকে, বৃহত্তর ঐক্যের ভেতরে-বাইরে উদ্ভূত সামগ্রিক প্রেক্ষাপট ইঙ্গিত করে রবিবার বিএনপির সমাবেশে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, ‘রাজপথে যদি শয়তানও থাকে, তার সঙ্গে ঐক্য হবে। বিএনপি ঐক্যের জন্য প্রস্তুত। খালেদা জিয়ার ডাকে যে ঐক্যের যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেই ঐক্য মানুষের মনে আশা তৈরি করেছে। এই ঐক্যে অনৈক্যের সুর বাজলে জনগণ থুথু দেবে।’
গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের এই বক্তব্যকে ইঙ্গিত করে মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, ‘ঐক্য নিয়ে বিএনপির সমাবেশে দলটির কয়েকজন নেতা যেসব বক্তব্য রেখেছেন তা নিয়ে ঐক্যের ভেতরে একটা সংশয় তৈরি হয়েছে। পরবর্তী সময়ে যখন বৃহত্তর ঐক্যের বৈঠক হবে সেখানে বিএনপিকে এ ব্যাপারে ব্যাখ্যা দিতে হবে।’
রবিবার বিকালে রাজধানীর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বিএনপি যখন সমাবেশ করছিল তখন বনানীর চেয়ারম্যানবাড়ি মাঠে বিকল্পধারার সহযোগী সংগঠন ‘প্রজন্ম বাংলাদেশ’ আয়োজিত ছাত্র-যুব সমাবেশ চলছিল। বিএনপির স্থায়ী কমিটির এক নেতা  বলেন, সমাবেশটির আয়োজন নিয়ে সন্দেহ আছে।
প্রজন্ম বাংলাদেশের এই সমাবেশে যুক্তফ্রন্ট নেতা আ স ম আবদুর রব ও মাহমুদুর রহমান মান্নার উপস্থিত থাকার কথা থাকলেও তারা যাননি। তবে চমক হিসেবে সমাবেশে হাজির হন বিএনপি দলীয় সাবেক দুই সংসদ সদস্য শহীদুল হক জামাল ও অধ্যক্ষ আবদুর রশীদ খান, তারা দুজনই বরিশাল থেকে বিএনপির টিকিটে এমপি হয়েছিলেন। এরমধ্যে জামাল বিএনপির আমলে একবার সংসদের হুইপেরও দায়িত্ব পালন করেন। এই সমাবেশে বিকল্পধারার যুগ্ম মহাসচিব মাহী বি. চৌধুরী বিএনপিকে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘১৫১ আসন পাওয়ার পর বিএনপির চেহারা দেখেছি। ওই চেহারা আর দেখতে চাই না। ভয় দেখিয়ে কোনো ঐক্য করা যাবে না। মুখে বলবেন এক কথা, কাজে আরেক, হবে না। আমরা ভারসাম্যের রাজনীতি ও সরকার চাই। এক কেন্দ্রিক সরকার আর নয়।’
মাহী চৌধুরীর উদ্যোগে গঠিত প্রজন্ম বাংলাদেশ প্রজন্মের অনুষ্ঠানে বিএনপি দলীয় সাবেক দুই এমপির যোগদানের বিষয়ে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর রবিবার রাতে বলেন, ‘আমি যতদূর জানি প্রজন্ম বাংলাদেশ কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়। কাজেই সেখানে সাবেক দুই এমপির যাওয়ার বিষয়টিকে আমি ভিন্নভাবে দেখছি না।’
অন্যদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবার সচিবালয়ে সাংবাদিকদের বলেছেন, ‘আমার বিশ্বাস নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর অনেক কিছু ঠিক হয়ে যাবে। যুক্তফ্রন্ট ও ঐক্য প্রক্রিয়া নির্বাচনে আসবে, এমন খবরও আমাদের কাছে আছে।’ ওবায়দুল কাদেরের এই মন্তব্য নিয়েও পারস্পরিক সন্দেহ-অবিশ্বাস দেখা দিয়েছে বৃহত্তর ঐক্য প্রক্রিয়ায়।
বিএনপি, যুক্তফ্রন্ট ও জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, জাতীয় ঐক্য প্রক্রিয়ার আহ্বায়ক ড. কামাল হোসেন চিকিত্সা শেষে থাইল্যান্ড থেকে দেশে ফেরার পর বৃহত্তর ঐক্যের বৈঠক ডাকা হবে। সেখানে চলমান বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে। আলোচনা ফলপ্রসূ হলে বৃহত্তর জাতীয় ঐক্যের সমন্বয়হীনতা কাটাতে একটি কেন্দ্রীয় লিয়াজোঁ কমিটি গঠন করা হতে পারে।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here