তাহমিনা শিল্পী :: নয়ন আর আলামিন দুই বন্ধু। বয়স নয় দশ বছর। আমার অফিসের সামনে রোজ ওদের সাথে দেখা হয়। ওদের সাথে আমার খুব ভাব। মানে ভাবটা আমি নিজেই করে নিয়েছি।চায়ের দোকানে বসে চা খাই নয়ন আর আলামিনের সাথে। অনেক গল্প করি, বাতাবি লেবুর (জাম্বুরা) খোসায় টুপি বানিয়ে দেই, ছবি তুলে দেই। বলি আমিও তো তোমাদের বন্ধু। ওরা খুব মজা পায়, হেসে লুটোপুটি খায়। আমার সহকর্মীরা দেখে হাসে। ভাবে এটা আমার একটা পাগলামি।
যদি তাই হয়, তবুও এটা একেবারেই উদ্দেশ্যহীন কিম্বা স্বার্থহীন নয়। আসলে ওদের দেখলে মনে পরে যায় আমার ছোট বেলার কথা। জীবনের প্রথম বন্ধুদের কথা। বাতাবি লেবুর (জাম্বুরা) খোসা দিয়ে এভাবে কতবার টুপি বানিয়ে পরতাম। নারিকেলের পাতা দিয়ে বানাতাম ঘড়ি আর চশমা। কতোই না মধুর ছিল স্মৃতিময় সেই সময়টা!
বাবার চাকরির সুবাদে আমার ছোটবেলাটা কেটেছিল ছোট্ট মফস্বল শহর মাদারীপুর জেলার রাজৈর সরকারি হাসপাতালের কলোনিতে। সেখানে একটা মাঠ ছিল। বিকাল হলেই সব বাচ্চারা মাঠে খেলতে যেতাম। আমাদের কিচিরমিচির, কলোকাকলিতে মুখর থাকত কলোনির আকাশ-বাতাস। সেখানে একটা মসজিদও ছিল। কলোনির এবং তার আশেপাশের বাসা থেকে ছোটছোট ছেলে-মেয়েরা আসত ওই মসজিদে আরবী শিখতে। আমিও ভর্তি হয়েছিলাম, যখন আমার বয়স তিন বছর। মসজিদের হুজুর আমাদের বলতেন-“বলো, আলিফ”। আমি আমার দু’পাশে বসা সহপাঠীদেরকে দু’হাতের কনুই দিয়ে ধাক্কা দিতাম। আর সবার সাথে সুর মিলিয়ে দুলে দুলে পড়তাম,”আ-লি-ফ”। ওরা কিন্তু একদম রাগ করতনা বরং দ্বিগুণ আনন্দে একই ভাবে দুলে দুলে পড়ত।
সেদিন থেকেই বুঝেছিলাম বন্ধু কাকে বলে। তারপর বয়স যখন চার তখন শুরু হয়েছিল নামতা পড়ার দিন। গলায় গলা মিলিয়ে স্কুলের সহপাঠীদের সাথে একাত্ম হয়ে পড়েছিলাম- এক এক্কে এক, দুই এক্কে দুই……। এভাবে দুই দু গুনা চার, চার চারে ষোল। সেই থেকে বন্ধুত্বের বন্ধনের শুরু।
এরপর জীবনের প্রতিটি পর্বাংশে নামতার নিয়মেই পেয়েছি নতুন নতুন বন্ধু। যাদের কারোর প্রয়োজন কোন অংশে কম নয়। বরং প্রত্যেকেই সাতন্ত্রভাবেই নিজ নিজ বন্ধুত্বের স্বকীয়তায় উজ্বল হয়ে আছে, আমৃত্যু থাকবে আমার হৃদয়ে।
বন্ধু মানে একটা খোলা বই/গোপন কথার অনেকখানি ভাগ/প্রাণ খোলা হাসির একটুখানি রাগ/ঝগড়া আর অভিমানে নিবিড় পাগলামি/সুখ-দুঃখ ভাগ করে নেয়া/মাঠে, ক্যান্টিনে আড্ডা দেয়া/হঠাৎ একদিন খুঁজে না পাওয়া/মনের ভিতর বন্ধুর আনাগোনা/আচমকা একদিন ফিরে পেয়ে বুকে জড়িয়ে নেয়া/এভাবেই বন্ধু আমার থাকবে চিরকাল নতুন এবং দামি।
সত্যিই, আজো মনে পড়ে কত দুষ্টুমী, কত ঝগড়া, কত রাগ, অভিমানে সেসময়ের দিনগুলো পার করছি আমরা। বিপদে একে অপরের পাশে থেকেছি। তারপর সময়ের প্রয়োজনে, জীবনের তাগিদে দুরে সরে গেছি। কিন্তু মানসিক ভাবে কেউ কিন্তু দুরে যাইনি কখনো। সময় কিম্বা দুরত্ব পারেনি আমাদের বন্ধুত্বের রঙ বদলাতে। আজো যখন অনেকদিন পরে দেখা হয়। তখন প্রাণের উচ্ছাসে, আবেগে জড়িয়ে ধরা মুহূর্তটিই বলে দেয় সময়টা শুধু বদলে যায়। কিন্তু যত দুরেই থাকি বন্ধুর কিম্বা বন্ধুত্বের রঙ কখনো বদলায় না।
এরিস্টটল বলেছেন- “প্রত্যেক নতুন জিনিসকেই উৎকৃষ্ট মনে হয়। কিন্তু, বন্ধুত্ব যতই পুরাতন হয়, ততই উৎকৃষ্ট ও দৃঢ় হয়”। আর হেলেন কেলার বলেছেন- “অন্ধকারে একজন বন্ধুর সাথে হাঁটা আলোতে একা হাঁটার চেয়ে ভাল”। সত্যিই দুর্ভাগ্যবান তারাই যাদের কোন বন্ধু নেই। সে অর্থে আমি নিজেকে অনেক ভাগ্যবান মনে করি এবং আজীবন আলোতো- অন্ধকারে তোদের সাথেই হাঁটতে চাই।
খামারবাড়ি অথবা বিজয়স্মরনীর ট্রাফিক সিগনালে যখন গাড়ি থামে। তখন হকাররা পত্রিকা, খবরের কাগজ বিক্রি করে। হাঁক ছেড়ে বলে সময় (আমাদের সময়) পাঁচ টাকা, সময় নেন পাঁচ টাকা।যতবার এই হাঁক আমি শুনি ততোবারই মনে হয় যদি তাই হতো…!! সত্যিই যদি সময় কিনতে পাওয়া যেত। তবে পাঁচ টাকা হোক, পঞ্চাশ টাকা হোক…কিম্বা পাঁচ লাখ টাকা, আমি ওই সময়টা কিনতে চাই। জানি তা আর কখনো সম্ভব নয়। কারন- জীবনের অনেকটা পথ পেরিয়ে এসে/ এখন আমি পৌঁছে গেছি অনেকটা পথ দুরে/তবুও যে সেদিনগুলো বাজায় বীণা আমার হৃদয় মাঝে/সেই বীণাতেই সুর তুলে দিস বন্ধু তোরাই/সকল প্রহর সন্ধ্যা, দুপুর, সাঁঝে।
লেখকের ইমেইল: tahmina_shilpi@yahoo.com