ফিরে দেখা ‘সিডর’

সোহানুর রহমান :: ২০০৭ সালের ১৫ই নভেম্বর। বৃহস্পতিবার। ঠিক ১০ বছর আগে আজকের এই কালো রাত্রিতে বঙ্গোপসাগর থেকে প্রায় পৌনে ৩শ কিলোমিটার বেগে ধেয়ে আসা ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলীয় উপকূলে আঘাত হেনেছিল। কয়েক ঘণ্টার তাণ্ডবে লন্ডভন্ড বাংলাদেশের উপকূলীয় ১১ টি জেলায় ভয়াবহ ধংসলীলা চালায় সাইক্লোন সিডর। সেই সাঙ্ঘাতিক ঝড়ের সময় জলোচ্ছ্বাসের উচ্চতাই ছিল প্রায় ১০ ফুটের মতো। মারা গিয়েছিলেন সাড়ে তিন হাজারের মতো মানুষ । ঘরবাড়ি ভেঙে আশ্রয়হীন হয়েছিলেন আরো হাজার হাজার লোক।

সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন উদ্যোগে ব্যাপক ত্রাণ তৎপরতা চালানোসহ দুর্গতদের পুনর্বাসনে কোটি কোটি টাকা ব্যয় করা হলেও কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। প্রলয়ংকারী ঐ ঘূর্ণিঝড়ে মাঠ পর্যায়ে রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির ‘ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কর্মসূচীর’ স্বেচ্ছাসেবকদের ব্যাপক প্রচারনা সহ প্রাক-প্রস্তুতি ও আগাম সতর্কতা যথেষ্ট সক্রিয় থাকায় প্রানহানীর সংখ্যা আশাতীতভাবে হ্রাস পেলেও এর প্রতিবেশগত দীর্ঘ মেয়াদী বিরূপ প্রভাব দৃশ্যমান। সিডরের কালো রাত্রির ভয়াল দূর্যোগ আজও তাড়া করে ফিরছে গোটা উপকূলবাসীকে। সেই ঘটনার ১০ বছর পর এসে কতটা ঘুরে দাঁড়াতে পেরেছেন সেখানকার মানুষজন?

ঘুর্ণিঝড় সিডর পরবর্তী ক্ষয়ক্ষতির কিছু দিক
সিডর আমাদের থেকে কম কিছু কেঁড়ে নেয়নি । সরকারী-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান, বিভিন্ন গনমাধ্যমের তথ্যানুযায়ী সিডরে ক্ষয়ক্ষতির সংক্ষিপ্ত বিবরণ:

* সিডর কেড়ে নিয়েছিল ৩ হাজার ৩৬৩ মানুষের জীবন । কিন্তু রেডক্রসের মতে মৃতের সংখ্যা ২০ হাজারের অধিক ।
* নিখোঁজের সংখ্যা ছিল ৮৭১ জন। নিখোজদের বেশীরভাগেরই পরবর্তীতে আর কোন খোঁজ মেলেনি। ৫৫ হাজার মানুষ আহত।
* সিডর আঘাত হেনেছিল ১ হাজার ৮১১ টি ইউনিয়নে। প্রায় ৮০ লাখ মানুষ সিডরের কবলে পড়ে। এতে প্রায় ৯ লাখ ৬৮ হাজার ঘর-বাড়ি ধ্বংস হয়।
* ঘূর্ণিঝড় সিডরে বাংলাদেশের প্রায় ৬০ লাখ টন ধান নষ্ট হয়েছে ।
* ৩১টি জেলার ২১০টি উপজেলায় ২০ লাখ একর জমির ফসল নষ্ট হয়েছিল।
* সিডরের আঘাতে প্রায় সাড়ে ২৪ লাখ গবাদি পশু মারা যায়।

বিধ্বস্ত এলাকার প্রায় ১৮শ সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সম্পূর্ণ ও প্রায় সাড়ে ৬ হাজার আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
জলোচ্ছাসে প্রায় পৌনে ৭শ কিলোমিটার আঞ্চলিক ও জাতীয় মহাসড়ক সহ পল্লী যোগাযোগ অবকাঠামোর সড়কসমুহ সম্পূর্ণ ক্ষতিগ্রস্থ হয়। এছাড়া আরো প্রায় ৯০ হাজার কিলোমিটার বিভিন্ন ধরনের সড়ক আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।
বিভিন্ন সড়ক-মহাসড়কের ১ হাজার ৬৫৪ টি সেতু এবং কালভার্ট সম্পূর্ণ ও প্রায় ৯শটি আংশিক ক্ষতিগ্রস্থ হয়।

সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল বাগেরহাট জেলার শরণখোলা এবং সাউথখালি এলাকা। তবে পটুয়াখালী, বরগুনা এবং ঝালকাঠি জেলাতেও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ক্ষয়ক্ষতির মধ্যে রয়েছে দুর্গত এলাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কৃষি জমি এবং গবাদীপশুসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের অবকাঠামো। বরগুনা জেলা প্রশাসনের হিসাবে, ২০০৭ সালের এই ঘূর্ণিঝড়ে সিডরে জেলায় মারা যায় ১ হাজার ৩৪৫ মানুষ। সেই সময় থেকে এ পর্যন্ত নিখোঁজ রয়েছেন ১৫৬ জন। তবে বেসরকারি হিসাবে নিহতের সংখ্যা প্রায় দুই হাজার।

আহতের সংখ্যা ২৮ হাজার ৫০ জন। ২ লাখ ১৩ হাজার ৪৬১টি পরিবার ক্ষতিগ্রস- হয়। সম্পূর্ণ গৃহহীন হয়ে পড়ে ৭৭ হাজার ৭৫৪টি পরিবার। ফসলের ক্ষতি হয়েছে দুই লাখ ৪৩ হাজার ৩৯৩ একর, ৩০ হাজার ৪৯৯টি গবাদি পশু ও ৬ লাখ ৫৮ হাজার ২৫৯টি হাঁস-মুরগি মারা যায়। ভয়াল সিডরের স্মৃতিতে এখনও শিউরে ওঠেন উপকূলের মানুষ। তবে বেসরকারি হিসাবে এ সংখ্য আরও বেশি। আর সেসব ভয়াবহ স্মৃতি মনে করলে এখনো অজানা আশঙ্কায় শিউরে ওঠেন এলাকাবাসী। মহাবিপদ সংকেতের কথা শুনলে আতংকিত হয়ে ওঠেন। বরগুনা সদর উপজেলার সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ এলাকা নলটোনা গ্রাম।

ঘূর্ণিঝড়ের পরের দিনই সেখানে অর্ধশতাধিক মানুষের লাশ পাওয়া যায়। গ্রামটি পানির নিচে থাকায় লাশ দাফনের জন্যও কোনো স্থান খুঁজে পাওয়া যায়নি। ভয়াবহ সিডরের ১০ বছর পার হলেও এখনও জেলার ১০০ কি.মি. বেড়িবাঁধ অরক্ষিত অবস্থায় আছে বলে পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে।

সিডরের আঘাতে ভোলা সদর উপজেলাসহ বোরহানউদ্দিন, চরফ্যাশন ও মনপুরা উপজেলায় ৪২ জন মারা যায়। আহত হয় সহস্রাধিক মানুষ। ৫২ হাজার ঘর-বাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়। বেড়িবাঁধ ভেঙে যায় ৫ কিলোমিটার এলাকার। নদীতে মাছ ধরতে গিয়ে নিখোঁজ হয় ১৫ জেলে। সিডরের ১০ বছর পেরিয়ে গেলেও আজো সেই দুর্বিষহ স্মৃতি ভুলতে পারছেনা ভোলার মানুষ। মনপুরা উপজেলারও একই চিত্র। ভোলার মনপুরা নদী ও সাগর বেষ্টিত একটি উপজেলা। এই উপজেলায় নদীভাঙন রোধ ও লবণাক্ত জোয়ারের পানি থেকে ফসলি জমি রক্ষায় নির্মাণ করা হয়েছিল একটি বাঁধ। পানি নিষ্কাশনের জন্য তৈরি করা হয় স্লুইস গেট।

কিন্তু গত এক দশক ধরে ১২টির মধ্যে ১০টিই অকেজো হয়ে রয়েছে। কিন্তু মেরামত করার কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ফলে লবণাক্ত পানিতে যেমন ফসল নষ্ট হচ্ছে তেমনি বছর বছর জলাবদ্ধতার কারণে মানুষের দুর্ভোগ বাড়ছে। মনপুরায় ৮৯ কিলোমিটার বাঁধের ১০টি স্লুইস গেইটই অচল হয়ে রয়েছে। অনেকগুলো স্লুইস গেট জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছে। কপাটসহ ফলে সামান্য জোয়ার হলেই পানি ঢুকে পড়ছে লোকালয়ে। ফলে প্রতি বছর বিস্তৃর্ণ এলাকায় জোয়ারের লবণাক্ত পানি ঢুকে মাঠের ফসল নষ্ট হচ্ছে।

সিডরের ভয়াল তাণ্ডবে পটুয়াখালীর কলাপাড়ায় ৯৪ জন মানুষের প্রাণহানি ঘটে। আজও নিখোঁজ রয়েছে সাত জেলে ও এক শিশু। আহত হয়েছে ১৬৭৮ জন। এর মধ্যে ৯৬ জন প্রতিবন্ধী হয়ে গেছে। বিধবা হয়েছেন ১২ গৃহবধূ। এতিম হয়েছে ২০ শিশু। সম্পূর্ণভাবে ঘর বিধ্বস্ত হয়েছে ১২ হাজার ৯০০ পরিবার। আংশিক বিধ্বস- হয় ১৪ হাজার ৯২৫টি ঘরবাড়ি। তিন হাজার ২২৫ জেলে পরিবার ক্ষতিগ্রস্থ হয়। প্রকৃতির ওই কালো থাবায় শতকরা ৯০ ভাগ পরিবার ক্ষতির শিকার হয়। এর মধ্যে ৫৪৭৩টি পরিবারকে ঘর নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। ৫৪০ পরিবারকে ব্যারাক হাউস নির্মাণ করে দেয়া হয়েছে। সিডর ও আইলায় ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্থ পটুয়াখালীর বেড়িবাঁধগুলো। সমপ্রতি আবার আঘাত হানে ঘূর্ণিঝড় রোয়ানু। ভাঙন ঠেকাতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বেড়িবাঁধ নির্মাণ করলেও তা টেকসই হয়নি। জোয়ারের পানি বেড়ে বারবার ভেঙে যাচ্ছে সেটা।

এ অবস্থায় পানিবন্দী হয়ে পড়েছে জেলার হাজার হাজার মানুষ। বারবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের আঘাতে বিপর্যস্ত এ এলাকার মানুষ। তাদের অভিযোগ, পানি উন্নয়ন বোর্ড ঠিকাদারের মাধ্যমে বেড়িবাঁধ মেরামত করলেও, কাজের মান এত খারাপ যে বারবার তা ভেঙে যাচ্ছে। বাঁধ ভেঙে লবণাক্ত পানি ঢুকে পড়ায় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে শত শত একর ফসলি জমি। ২০০৭ সালের এইদিনে মির্জাগঞ্জের উপর দিয়ে বয়ে যাওয়া স্মরণকালের ভয়াবহ ঘূর্ণিঝড় সিডর ও জলোচ্ছ্বাসে প্রাণহানি ঘটেছিল ১১৫ জন নারী, পুরম্নষ ও শিশুর।

গলাচিপার আমখোলা ইউনিয়নের ২৭ জন সেদিনের প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে প্রাণ হারান। সিডরে উপকূলের জেলা পিরোজপুরে মানবসম্পদের পর সবচেয়ে বড় ধরণের ক্ষতের সৃষ্টি করেছিল ফলজ ও বনজ বৃক্ষ সম্পদের। প্রলয়ঙ্করী ঘূর্ণিঝড়ে সে সময় অসংখ্য বনজ ও ঔষধি বৃক্ষসহ প্রায় কোটি টাকার সম্পদ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল। বিভিন্ন ধরনের হাজার হাজার বাগান পরিণত হয়েছিল বিরানভূমিতে। গত দশ বছরেও সে ক্ষত পূরণ করতে পারেনি এ উপজেলার বৃক্ষপ্রেমী মানুষজন।

ঝালকাঠিতে বিভিন্নভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয় লক্ষাধিক পরিবার। কৃষি, মৎস্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, রাস্তাঘাট, ব্রিজ-কালভার্ট, বাঁধ, ঘরবাড়ি, গাছপালাসহ বিভিন্ন সেক্টরে প্রায় ছয়শ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়। ওই সময়ে সড়ক বিভাগের আওতাধীন ১৮টি সড়ক এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদফতরের আওতাধীন ৩৯টি সড়ক ও ২০টি ব্রিজ-কালভার্ট ক্ষতিগ্রস্থ হয়। অর্থ বরাদ্দ ও উদ্যোগের অভাবে অনেক কাজ ঝুলে রয়েছে। ভেঙে পড়া সেতুতে কাঠের পাতাটন, বাঁশের সাঁকো তৈরি করে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে যাতায়াত করছে শিশু, কিশোর, বৃদ্ধসহ বিভিন্ন বয়সের মানুষ। বর্তমান সরকার আমলে অনেক সাইক্লোন সেল্টার নির্মিত হয়েছে। যা ভবিষ্যতে এ ধরনের দুর্যোগ থেকে মানুষকে রক্ষা করতে সহায়তা করবে।

১০ বছর কাটলো, কেউ কথা রাখেনি
সব মিলিয়ে ক্ষয়ক্ষতির পরিমান প্রায় ঘূর্ণিঝড় সিডর-এর আঘাতে বাংলাদেশের ২.৩১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার -এ সম্পরিমান সম্পদের ক্ষতি হয়েছে । যা ছিল সে সময়ের বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচীর প্রায় অর্ধেক। সিডরের তান্ডবের পরে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং স্থানীয় পুলিশ ও প্রশাসন ত্রান তৎপড়তা শুরু করলেও পরবর্তীতে দেশী বিদেশী বিভিন্ন পর্যায় থেকেও ত্রান ও পূণর্বাসন কার্যক্রম গ্রহন করা হয়। ইউরোপীয় কমিশন তড়িতভাবে ১.৫ মিলিয়ণ ইউরো অর্থ্যাৎ প্রায় ২.৪ মিলিয়ণ ইউএস ডলার সমপরিমান ত্রাণ সামগী্র বাংলাদেশের আক্রান্ত মানুষের কাছে পাঠায়। অন্যান্য অনেক সংস্থাও সাহায্যের জন্য এগিয়ে এসেছিল।

যুক্তরাষ্ট্র, ফিলিপাইন, সৌদি আরবসহ বিশ্বের অনেক দেশ সিডরে ক্ষতিগ্রস্থ মানুষের সাহায্যের জন্য অর্থ সাহায্য এবং লোকবল পাঠিয়েছিল কিন্তু আমাদের দূর্ভাগ্য এ সাহায্যের দ্বারা সিডর আক্রান্ত মানুষের চেয়েও বাইরের অনেকেই বেশি উপকৃত হয়েছেন । দেশি-বিদেশী বিভিন্ন সংস্থা ও রাষ্ট্র থেকে যে পরিমান অর্থ সাহায্য এসেছিল তাতে সিডর আক্রান্ত প্রতিটি পরিবারে আবারও স্বচ্ছলতা ফিরে আসত যদি সঠিক ভাবে তা বন্টন করা হত । অন্যদিকে সিডর উত্তরকালে প্রায় ৪০টি দেশ ও আন্তর্জাতিক সংস্থা সাহায্য-সহযোগীতার আশ্বাস দিলেও তার মধ্যে ৩২টি দেশ সে ওয়াদা রক্ষা করেনি।

বরিশাল বিমান বন্দরে ত্রান সমন্বয় কেন্দ্র স্থাপন করে সেদিন ঘূর্ণি উপদ্রুত উপকূলীয় এলাকায় ত্রান ও উদ্ধার তৎপড়তা পরিচালিত হয়। তবে সেনা সমর্থিত তত্ববধায়ক সরকার একমাসের মাথায় ত্রান তৎপড়তা অনেকটাই গুটিয়ে নেয়। রাজনৈতিক শূণ্যতার কারনে সেদিনের তত্বাবধায়ক সরকার সাধারন মানুষকেও ত্রান কাজে খুব একটা সম্পৃক্ত করতে পারেনি। গৃহীত হয়নি দীর্ঘমেয়াদী পুর্ণবাসন কার্যক্রমও। ফলে ঘূর্নি উপদ্রুত এলাকার মানুষের দূর্ভোগ অনেক দীর্ঘায়িত হয়। সহায় সম্বল ও আশ্রয়হীন মানুষের অবর্ণনীয় হাহাকার দেখারও কেউ ছিলনা। আজও সিডর আক্রান্ত মানুষের ক্ষত মোছেনি । সিডরের সেই ধ্বংসযজ্ঞ আজ রয়ে গেছে । ঘুরে দাড়াতে পারেনি আক্রান্তরা।

শিশুদের উপর প্রভাব
জাতিসংঘ শিশু তহবিল (ইউনিসেফ) বলছে, সিডরে সব মিলিয়ে ৮.৫ মিলিয়ন মানুষ ক্ষতিগ্রস্থ হয় এর অর্ধেকই শিশু এবং এর অর্ধেক মিলিয়নের বয়স ৫ বছরের নিচে। বরিশালের উপকূলীয় এলাকা এবং প্রত্যন্ত চরাঞ্চলের শিশু ও কিশোর-কিশোরী ও তাদের পরিবার প্রয়োজনীয় ন্যুনতম নাগরিক সেবা থেকে এমনিতেই বঞ্চিত এবং তার ফলে বাধাগ্রস্থ হচ্ছে তাদের স্বাভাবিক বিকাশ, উন্নয়ন, সুরক্ষা এবং অংশগ্রহণ। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে সাইক্লোনের মত ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগের মাত্রা বেড়ে যাওয়ায় দুর্গম দ্বীপসমূহ এবং পুরো উপকূলীয় অঞ্চলের অবস্থা আরো শোচনীয় করে তুলছে। এর ফলে মানুষের খাদ্য, পানি, জ্বালানি, স্বাস্থ্য ও জীবিকার নিরাপত্তাকে যেমন ঝুঁকিপূর্ন করেছে তেমনি মানুষের স্থ্যচ্যুতি ও স্থানান্তরিত হওয়ার সম্ভাবনাকে বাড়িয়ে দিয়েছে।

সামপ্রতিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, পটুয়াখালী, বরগুনা পিরোজপুর ও বাগেরহাট জেলায় সিডর-পরবর্তী সময়ে বেড়ে ওঠা পাঁচ থেকে ১৮ বছর বয়সী শিশুদের ৪৮ শতাংশই কোনো না কোনো ধরনের মানসিক ব্যাধিতে আক্রান্ত। চারটি ভিন্ন ভিন্ন এলাকার পাঁচ থেকে ১৬ বছর বয়সী ১৫৮ শিশুর ওপর পরিচালিত এ গবেষণায় দেখা গেছে, তাদের মধ্যে মানসিক রোগে আক্রান্তের হার ৪৮ দশমিক ১ শতাংশ। সিডরের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানার পর তার প্রভাব পরবর্তী বংশধরদের মধ্যেও স্থায়ী প্রভাব রেখে যেতে পারে, যা এ গবেষণায় উঠে এসেছে। এ ধরনের দুর্যোগে শারীরিক ক্ষতি হলে, দীর্ঘমেয়াদে তার প্রভাবে শিশুদের মানসিক বিকাশে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। অন্যদিকে অনেক মা-বাবা হারানো নি:স্ব শিশু ঝুকিপূর্ন শিশুশ্রমের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছে।

সিডর উপদ্রুত এলাকার আক্রান্ত মানুষের জীবন মান উন্নয়নে সুপারিশমালা ::
# উপকূলীয় এলাকার মানুষের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করার দাবি তাদের। এলক্ষে একটি উপকূল ও চরাঞ্চল উন্নয়ন বোর্ড গঠনের প্রস্তাব রাখছি।
# উপকূলীয় এলাকায় অবকাঠামো নির্মাণ বিশেষ করে উপকূলীয় বেড়িবাঁধ উঁচুকরণ, পরিবেশ-বান্ধব স্থায়ী বাধ নির্মাণ, স্লুইচগেট সচলকরণ, পানি উন্নয়ন বোডের্র পরিকল্পনা ও কৌশল আধুনিকায়ন করা না হলে, জনদুর্ভোগ কমবে না।
# সুপেয় পানির সংকট সমাধানে, ভরাট হওয়া সরকারি পুকুর ও খাল-নদী সংস্কার এবং পানির উৎসের লিজ বন্ধে দ্রুত কঠোর ব্যবস্থার পাশাপাশি, গ্রামাঞ্চলভিত্তিক সমন্বিত পানি সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।
# নারী ও শিশুবান্ধব আশ্রয় কেন্দ্র নির্মাণ, দুর্যোগকালে সমুদ্রে জেলেদের সাথে যোগাযোগের উন্নত মাধ্যম ব্যবহার, কমিউনিটি রেডিও চালুকরণ, সচেতনতা অনুষ্ঠান জোরদারকরণ এবং শহরে জলবায়ু সহনীয় অবকাঠামো নির্মাণে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দিতে হবে।
# ইউনিয়ন পরিষদের দুযোর্গ ব্যবস্থাপনা কমিটিকে শক্তিশালী করার সাথে উপকূলীয় স্বেচ্ছাসেবক বাহিনী সিপিপির সম্পর্ক নিবিড়করণ ও উপজেলা পর্যায়ে সিপিপির কার্যালয় স্থাপন করতে হবে।
# সংকট মোকাবিলায় নাগরিক ও যুব অংশগ্রন বৃদ্ধিসহ সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে আরো বেশি কার্যকর ও সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
# সিডরের ঐ ভয়াল তান্ডবে ক্ষয়ক্ষতি আরো ভয়াবহ আকার ধারন করতে পারত যদি বিশাল সবুজ বেষ্টনী ও পারিকল্পিত বনায়ন না থাকত। প্রকৃতির ঐ তান্ডব সেদিন প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত রুখে দাড়িয়েছিল প্রকৃতিই। বেশি বেশি করে গাছ লাগাতে হবে এবং উপকূলীয় বনায়ন বাড়াতে হবে।

২০০৭-এর ১৫ নভেম্বর কালো রাতের সিডর-এর তান্ডব এখনো মনে রেখেছে দক্ষিন উপকূলবাসী। এসব দুর্যোগ মোকাবিলায় সব ধরনের প্রস্তুতির সঙ্গে দরকার জন-সচেতনতা ও জবাবদিহিতা। আর্থিক সহায়তার সঠিক ব্যবহারের পাশাপাশি দুর্যোগের সময় মনস্তাত্ত্বিক সহায়তারও প্রয়োজন রয়েছে। প্রতিটি দুর্যোগের পর ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে বাংলাদেশকে অনেক অর্থ ব্যয় করতে হচ্ছে।

কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দেশ হিসেবে প্রশ্ন হচ্ছে, আমরা ইনোসেন্ট ভিকটিম। শিল্পোন্নত দেশগুলো যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য মূলত দায়ী, তাই তাদের ক্ষতিপূরণ দেওয়া উচিত। যথাযথ পদক্ষেপের মাধ্যমে ভবিষ্যতে যেন ঘুর্ণিঝড়ের আঘাতের ভয়াবহতা ও ক্ষতি থেকে মানুষ কিছুটা লাঘব পেতে পারে তার নিশ্চয়তা প্রদান করতে হবে।

 

 

লেখক: প্রধান নির্বাহী, প্রতীকি যুব সংসদ (Bangladesh Model Youth Parliament) প্রধান সমন্বয়কারী, ইয়ূথনেট ফর ক্লাইমেট জাস্টিস   kishanibd@gmail.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here