এর আগে গতকাল ভোরে রাজধানীর শ্যামলীর বাসা থেকে বের হওয়ার পর আর তাকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বলে সারাদেশে চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। তাকে অপহরণ করা হয়েছে বলে পরিবারের পক্ষ থেকে দাবি করা হয় এবং এ নিয়ে থানায় জিডিও করা হয়। উদ্ধারের দেড়ঘণ্টা আগে ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার নিজের বাসায় সংবাদ সম্মেলন করে
স্বামীকে জীবিত ও অক্ষত অবস্থায় ফেরত চান। স্বামী উদ্ধারের খবর পাওয়ার পর তিনি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ধন্যবাদ জানান। পরে ফরিদা আখতার বলেন, স্বামীকে এখনও কাছে না পাওয়ায় তিনি পুরোপুরি উৎকণ্ঠামুক্ত নন।
র্যাব-৬ এর অধিনায়ক খোন্দকার রফিকুল ইসলাম বলেন, ফরহাদ মজহার হানিফ পরিবহনের একটি বাসে খুলনা থেকে ঢাকায় যাচ্ছিলেন। খুলনায় তার অবস্থান শনাক্ত হওয়ার পর বিভিন্ন সড়কে তল্লাশি চৌকি বসানো হয়। এরই এক পর্যায়ে রাত ১১টা ২০ মিনিটের দিকে যশোরের নোয়াপাড়ায় ঢাকাগামী গাড়িটি তল্লাশি করে তাকে পাওয়া যায়।
র্যাব অধিনায়ক বলেন, তার স্বজনরা অপহরণের কথা বলেছিলেন। কিন্তু তাকে গণপরিবহনে একাই পাওয়া গেছে। পুরো ঘটনাটিই তার কাছে জানতে চাওয়া হবে।
র্যাবের এক কর্মকর্তা বলেন, ফরহাদ মজহার ঢাকাগামী হানিফ পরিবহনের ৫০৫ নম্বর কোচের আই-৩ নম্বর আসনের যাত্রী হিসেবে ঢাকা যাচ্ছিলেন। ওই বাসটি রাত সোয়া ৯টার দিকে শিববাড়ি মোড় থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায়।
র্যাব জানায়, গতকাল রাত সোয়া ৮টার দিকে ফরহাদ মজহার খুলনার নিউমার্কেট এলাকায় ‘নিউ গ্রিল হাউজ’ নামের একটি হোটেলে খাওয়া-দাওয়া করেন। সেখান থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর টিভিতে খবর দেখে হোটেল মালিক তাকে চিনতে পেরে র্যাবকে অবহিত করেন। এরপর র্যাব ও পুলিশ ওই এলাকায় তার সন্ধানে অভিযান শুরু করে। খুলনা থেকে বের হওয়ার সব রাস্তায় তল্লাশি চৌকি বসানো হয়। শহরের ভেতরও তল্লাশি শুরু হয়। এর আগে গতকাল বিকেলে প্রযুক্তিগত তদন্তে তার মোবাইল ফোনের অবস্থান খুলনার শিববাড়ি এলাকায় শনাক্ত হওয়ার পর র্যাব ওই এলাকায় অভিযান চালায়।
পুলিশ জানায়, গতকাল সকাল ১০টায় ফরহাদ মজহারের স্ত্রী ফরিদা আখতার লোক মারফত তার স্বামীকে অপহরণের কথা আদাবর থানা পুলিশকে জানান। পুলিশ সঙ্গে সঙ্গেই খোঁজ নেওয়া শুরু করে এবং ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা শ্যামলীর রিংরোডে লেখকের বাসায় যান। ফরিদা আখতার ওই থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেন সন্ধ্যা ৭টায়।
পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার বিপ্লব কুমার সরকার জানান, ফরহাদ মজহারের বাড়ির সামনের সিসি ক্যামেরার ফুটেজে দেখা গেছে, ভোর ৫টা ৫ মিনিটে স্বাভাবিক পোশাক পরে তিনি হেঁটে বাসা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন। প্রযুক্তিগতভাবে তার মোবাইল ফোন সন্ধান করে বারবার অবস্থান পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
পুলিশ কর্মকর্তা বিপ্লব কুমার সরকার বলেন, প্রয়োজন হলেই ফরহাদ মজহার তার ফোনটি খুলেছেন। কথা বলে আবার বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি সাধারণত যে মোবাইল সেট ও নম্বর ব্যবহার করেন সেটি সঙ্গে নেননি। অন্য একটি মোবাইল সেট নিয়ে গেছেন।
পুলিশের একটি সূত্র জানায়, প্রযুক্তিগত তদন্তে তারা দেখেছেন ফরহাদ মজহারের অবস্থান কখনও আরিচা, ফরিদপুর ও মাগুরা। সর্বশেষ খুলনা অঞ্চলে তার অবস্থান দেখা গেছে।
ফরিদা আখতার পুলিশকে জানিয়েছেন, ফরহাদ মজহার সাধারণত ভোরে ঘুম থেকে উঠলেও ওই সময়ে বাসা থেকে বের হন না। সাধারণত সকাল ৮টা থেকে ১০টার পরেই বাসার বাইরে যান। কিন্তু গতকাল ৫টা ২৯ মিনিটে ফরহাদ মজহার নিজেই তার স্ত্রীকে মোবাইল ফোন দিয়ে বলেন, ‘আমাকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাকে মেরে ফেলবে।’ ৬টা ২১ মিনিটে ফোন দিয়ে তাকে পেতে স্ত্রীকে ৩৫ লাখ টাকা জোগাড় করতেও বলেন। তা না দিলে তাকে মেরে ফেলা হবে বলেও জানান।
তবে রাত ৮টার দিকে ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীকে আবারও ফোন দেন বলে তাদের একজন স্বজন জানিয়েছেন। ওই সময় তাকে পেতে মুক্তিপণ হিসেবে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকা জোগাড় করতে বলেন তিনি। যদিও টাকা কার কাছে দিতে হবে বা কে নেবে সে বিষয়ে কিছু না বলেই ফোন কেটে দেন।
তার পারিবারিক বন্ধু পরিচয় দিয়ে গৌতম দাশ নামে এক ব্যক্তি সাংবাদিকদের জানান, ফরহাদ মজহারকে ভোরে কয়েকজন ডেকে নিয়ে যায়। ২৪ মিনিট পর তিনি টেলিফোনে বলেছেন, তাকে তুলে নিয়ে যাচ্ছে।
স্বজনরা বলছেন, ভোর সাড়ে ৪টার দিকে তার স্ত্রী ঘুম থেকে উঠে ফরহাদ মজহারকে কম্পিউটারে কাজ করতে দেখেছেন। এরপর তিনি ৫টার দিকে আবার উঠে দেখেন, ফরহাদ মজহার কম্পিউটারের টেবিলে নেই। স্ত্রী আবার ঘুমিয়ে পড়লেও ভোর ৫টা ২৯ মিনিটে স্বামীর ফোনেই তার ঘুম ভাঙে।
ফরহাদ মজহারের বাসার নিরাপত্তাকর্মী মোহাম্মদ আলী বলেন, ফরহাদ মজহার ভোরে বাসা থেকে হেঁটে ছোট ফটক দিয়ে বেরিয়ে সড়কে ওঠেন। তাকে কেউ উঠিয়ে নিয়ে গেছে, এমন কোনো দৃশ্য তার চোখে পড়েনি।
আদাবর থানার উপপরিদর্শক মহসীন আলী বলেন, পুরো ঘটনা জানিয়ে সন্ধ্যায় স্ত্রী ফরিদা আখতার বাদী হয়ে থানায় জিডি করেছেন। এর ভিত্তিতে তার অবস্থান শনাক্ত করে তাকে উদ্ধারের চেষ্টা চলছে।
ফরহাদ মজহার নিজেকে মার্কসবাদী হিসেবে পরিচয় দেন। তবে ধর্মভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলামের সঙ্গে তার গভীর সম্পৃক্ততা নিয়ে বিভিন্ন সময়ে বাম দলগুলোর সমালোচনা রয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে শাহবাগে গড়ে ওঠা গণজাগরণ মঞ্চের কার্যক্রম নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে সমালোচনার মুখে পড়েন তিনি। সর্বশেষ গত রোববার তিনি জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বক্তব্য দেন। ভারতে গো-রক্ষা আন্দোলনের নামে ‘মুসলিম হত্যা’র প্রতিবাদে দৈনিক আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমান ওই সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করেছিলেন।
ফরহাদ মজহার রাতে উদ্ধার হলেও গতকাল বিকেলে বিএনপি সংবাদ সম্মেলনে তাকে অপহরণের জন্য সরকারকে দায়ী করে।