মূল সেতুর নির্মাণ কাজ উদ্বোধনষ্টাফ রিপোর্টার :: পদ্মা সেতু এখন আর কেবল স্বপ্ন নয়। ইতোমধ্যে পদ্মা সেতুর ২৭ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। মূল সেতু নির্মাণের কাজও চলছে পুরোদমে। আজ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রকল্পের নদীশাসন ও মূল সেতু নির্মাণ কাজের উদ্বোধন করবেন।
আর মাত্র ৩৬ মাসের মধ্যেই খুলে যাবে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের প্রায় ৫ কোটি মানুষের ভাগ্যের দুয়ার। দেশের সড়ক যোগাযোগের ক্ষেত্রে রচিত হবে এক নতুন ইতিহাসের। জাজিরার পদ্মা পারের মানুষ এখন আনন্দে আত্মহারা। চর জাগা-মরা পদ্মার বাঁকে বাঁকে উপচে পড়ছে সম্পদহারা মানুষের আনন্দের ঢেউ। স্বপ্ন বাস্তবায়নের শেষ ধাপে এসে বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি সব হারিয়েও খুশি পদ্মা পারের শত শত মানুষ। তারা বরণ করতে প্রস্তুত এই সাফল্যের বর কন্যাকে। প্রশাসনও সম্পন্ন করেছে তাদের সব প্রস্তুতি।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ মাওয়ায় সেতুর মূল কাজের ৭ নাম্বার পিলারের পাইলিং স্থাপনের কাজ এবং জাজিরায় নদীশাসনের কাজের উদ্বোধন করবেন। প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা জোরদার এবং উদ্বোধনী অনুষ্ঠানকে সফল করার জন্য শুক্রবার শেষ বিকাল পর্যন্ত একের পর এক সভা করেছেন সেতুমন্ত্রী থেকে শুরু করে জনপ্রতিনিধি, জেলা প্রশাসন, সেনা সদস্যসহ সব আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে প্রশাসনের পক্ষ থেকে।

আজ সকাল ৯টা ৪০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী হেলিকপ্টার অবতরণ করবে জাজিরার পদ্মা পাড়ে। এরপর ৯ টা ৫০ মিনিটে উদ্বোধন করবেন সেতুর দক্ষিণ পারের ১২ কিলোমিটার নদীশাসনের কাজ। সকাল ১০টা থেকে ১১টা ৩০ মিনিট পর্যন্ত সেতুর জাজিরা পয়েন্টে বিভিন্ন স্তরের ১ হাজার মানুষের সমন্বয়ে গঠিত সুধী সমাবেশে ভাষণ দেবেন শেখ হাসিনা। এরপর দুপুর পৌনে ১২টার মধ্যে তিনি ফের আকাশপথে রওনা দেবেন মাওয়ায় সেতুর মূল পিলারের উদ্বোধন শেষে জনসভায় অংশ গ্রহণের জন্য।
২০১৮ সালে পদ্মা সেতু দিয়ে চলাচল করবে যানবাহন ও ট্রেন এই মহাকর্মপরিকল্পনা নিয়েই এগোচ্ছে সবকিছু। পদ্মা সেতু প্রকল্প বাস্তবায়নের সুবিধার্থে মূল সেতু, নদীশাসন, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড, পুনর্বাসন কেন্দ্র এবং একটি তদারকি পরামর্শক সংক্রান্ত মোট ৬টি প্যাকেজে ভাগ করা হয়েছে। এর মধ্যে জাজিরা পারের কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও পুনর্বাসন কেন্দ্রের কাজ সম্পন্ন করা হয়েছে। দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলছে সংযোগ সড়ক নির্মাণের কাজ। এছাড়াও মূল সেতু নির্মাণ কাজও দৃশ্যমান, শুরু হয়েছে নদীশাসনের কাজও। এ কাজে এক সঙ্গে হাত লাগিয়েছে চীন ও বাংলাদেশের শ্রমিক-কলা কুশলীরা। শুরুর দিকে কিছুটা হাতাশা থাকলেও বিশাল এই কর্মযজ্ঞ দেখে হতাশা কেটে গেছে স্থানীয়দের। ক্ষতিগ্রস্তরা তাদের বাপ-দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটে-মাটি হারিয়েও সব কিছু ভুলে গেছে সেতু নির্মাণের কাজ শুরু হওয়াতে।
৬.১৫ কিলোমিটার দৈর্ঘ্যের পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম এই সেতু প্রকল্পের জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকা। মূল সেতু নির্মাণের দায়িত্ব দেয়া হয়েছে চীনের চায়না ব্রিজ কোম্পানিকে। আর নদীর দুই পারে চীনের সিনো হাইড্রো করপোরেশন লিমিটেড নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ৮ হাজার ৭০৮ কোটি ৮১ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৪ কি.মি. এলাকা নিয়ে করা হচ্ছে নদীশাসন। এর মধ্যে মুন্সীগঞ্জের মাওয়া পারে ২ কি.মি. এবং শরীয়তপুর জাজিরা পারে মূল সেতুর দুই পাশে ১২ কি.মি. পদ্মা নদীশাসন করা হচ্ছে। নদীশাসনের কাজের ১৫ শতাংশ অগ্রগতিও হয়েছে ইতোমধ্যে। ৩ বছরের মধ্যে কাজ শেষ করার শর্তে ১ হাজার ৯৭ কোটি টাকা ব্যয়ে ২০১৩ সালের ৮ অক্টোবর সংযোগ সড়ক ও টোল প্লাজা নির্মাণকাজ শুরু করেছে যৌথভাবে আব্দুল মোনেম লিমিটেড ও মালয়েশিয়ার এইচসিএম নামের দুটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান।
সাড়ে ১০ কিলোমিটার সংযোগ সড়কসহ প্রকল্পের সব কাজ তদারকির দায়িত্ব দেয়া হয়েছে দক্ষিণ কোরিয়ার কোরিয়ান এক্সপ্রেস ওয়ে ও বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে। সেতু নির্মাণের সার্বিক কাজ তদারকির জন্য জাজিরার নাওডোবা এলাকায় নির্মাণ করা হয়েছে বিশাল সেনা ব্যারাক। ইতোমধ্যে মূল সেতুর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চায়না মেজর ব্রিজ কোম্পানি ও সিনো হাইড্রো করপোরেশনের লোকজনের থাকার জন্য দৃষ্টি নন্দন ব্যারাক নির্মাণ করেছে পদ্মা তীরে।
পদ্মা বহুমুখী সেতু নির্মাণের জন্য সরকার ২০০৭ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ১১টি ধাপে শরীয়তপুরের জাজিরা পয়েন্টে নাওডোবা ইউনিয়নের ১০০ নাম্বার এবং ১০১ নাম্বার মৌজার সরল খার কান্দি, মোহর আলী মাদবর কান্দি, হাজী হাছেন বয়াতীর কান্দি, সমর আলী মৃধা কান্দি, হাজী গফুর মোল্যার কান্দি, শহর আলী বেপারীর কান্দি, লতিফ ফকিরের কান্দি, সলিমুদ্দিন মাদবরের কান্দি, আহমেদ মাঝির কান্দি, হাজী জৈনদ্দিন মাদবরের কান্দি, কাদির মিনার কান্দি, জমির উদ্দিন হাওলাদারের কান্দি, আ. মজিদ হাওলাদারের কান্দি, নঈমুদ্দিন খানের কান্দিসহ অন্তত ২৫টি গ্রামের ৪ হাজার ৮২৩ জন লোকের নিকট থেকে মূল সেতু, সংযোগ সড়ক, কনস্ট্রাকশন ইয়ার্ড ও পুনর্বাসন কেন্দ্র নির্মাণের জন্য ১ হাজার ১০০ একর ভূমি অধিগ্রহণ করা হয়েছে। আর নদীশাসনের জন্য জাজিরা অংশে উলি্লখিত এলাকার বাসিন্দাদের থেকে নেয়া হয়েছে ১৫৫ একর জমি। সহস্র মানুষের নিকট থেকে অধিগ্রহণকৃত সেই ভূমির ওপরই চলছে স্বপ্নের পদ্মা সেতুর মহাকর্মযজ্ঞ।
স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্ববৃহৎ এই প্রকল্পের বাস্তবতা আজ প্রত্যক্ষ করতে শুরু করেছে বিশ্ববাসী। দেশি-বিদেশি হাজারো ষড়যন্ত্রকে দুই পায়ে মাড়িয়ে নিজেদের অর্থে নির্মাণ হচ্ছে এই স্বপ্নের সেতু। শেখ হাসিনার ইস্পাত কঠিন মনোবল আর দৃঢ় সাহসিকতাই এই অসম্ভবকে সম্ভব করার প্রত্যয়ে সফলতা পেতে শুরু করেছে। মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই প্রমত্তা পদ্মার বুক চিড়ে আকাশে উঁকি দিতে থাকবে একের পর এক পিলার।
প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে গৃহীত আয়োজন সম্পর্কে জানতে চাইলে পদ্মা সেতুর তদারকি টিমের ডেপুটি চিফ কো-অর্ডিনেটর ব্রিগেডিয়ার জেনারেল দেওয়ান শেখ শহিদুল ইসলাম বলেন, তারা এখন জাতির স্বপ্ন পূরণের শেষ ধাপে অবতীর্ণ হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে সংশ্লিষ্ট সকলের সহযোগিতায় সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে।
শরীয়তপুর থেকে আমাদের প্রতিনিধি সৈকত দত্ত জানান, শরীয়তপুরে প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার আগমন উপলক্ষে শরীয়তপুর জেলার জাজিরা নাওডোবা এলাকায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন হয়েছে।

শনিবার সকাল ৯টা ৫০ মিনিটে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পদ্মা সেতু নদী শাসন ফলক উন্মোচন ও মাওয়া এলাকায় মূল সেতুর ফলক উন্মোচনের উদ্দেশ্যে জাজিরার নাওডোবায় আসবেন। পদ্মা সেতু নদী শাসন ফলক উন্মোচন শেষে নাওডোবা এলাকায় একটি সুধী সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। আর সুধী সমাবেশকে ঘিরে শরীয়তপুর তথা দক্ষিন বঙ্গের মানুষের মধ্যে বইছে আনন্দের জোয়ার। এই নিয়ে তৃতীয় বারের মত শরীয়তপুরে আগমন ঘটছে প্রধানমন্ত্রীর। যোগ্য পিতার যোগ্য সন্তান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আসবে জাজিরার নাওডোবায় এই নিয়ে যেন পদ্মার পাড়ের মানুষ একটু বেশি আনন্দিত।

শরীয়তপুরে সুধী সামাবেশের জন্য তৈরি করা হচ্ছে মঞ্চ ও প্যান্ডেল। ইতিমধ্যেই মঞ্চের সব প্রস’তি শেষ হয়েছে। বাকি শুধু কিছু সাজানো গুচ্ছানো। সুধী সমাবেশকে সুন্দর করে গড়ে তুলতে থাকছে ৯০টি ফ্যান, ৮০টি ডিজিটাল লাইট সহ অত্যাধুনিক সব ডিজিটাল প্রযুক্তির সাউন্ড সিস্টেম।

প্রধানমন্ত্রীর জাজিরার নাওডোবায় আগমন স্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক (যুগ্ম-সচিব) রাম চন্দ্র দাস, পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল-মামুন, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য এনামুল হক শামীম, বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় উপ-কমিটির সহ-সম্পাদক ইকবাল হোসেন অপু, নদী শাসন প্রকল্প নির্বাহী প্রকৌশলী মো. শাহফিকুল ইসলাম, জেলা আওয়ামীলীগ সভাপতি আলহাজ্ব আবদুর রব মুন্সি, জাজিরা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ আব্দুল কাদের, জাজিরা থানা অফিসার ইনচার্জ মোঃ নজরুল ইসলাম প্রমূখ।

জেলা প্রশাসক (যুগ্ম-সচিব) রাম চন্দ্র দাস বলেন, প্রধানমন্ত্রী আগমন উপলক্ষে ইতিমধ্যেই সব ধরনের প্রস্তুতি সম্পন্ন করা হয়েছে। মঞ্চ নির্মানের কাজও ইতিমধ্যে সম্পন্ন হয়েছে। পুলিশ সুপার সাইফুল্লাহ আল মামুন জানান, প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে জাজিরা এলাকায় তিন স্তরের নিরাপত্তার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। পুরো এলাকা নিরাপত্তার চাঁদরে ডেকে রাখা হয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here