কৃষিবিদ নিতাই চন্দ্র রায়

‘আমদের ছোট গাঁয়ে ছোট ছোট ঘর,/থাকি সেথা সবে মিলে নাহি কেহ পর। পাড়ার সকল ছেলে মোরা ভাই ভাই,/ এক সাথে খেলি আর পাঠশালে যাই। আম গাছ, জাম গাছ, বাঁশ ঝাড় যেন/মিলে মিশে আছে ওরা আত্নীয় হেন। সকালে সোনার রবি পুবদিকে উঠে,/পাখি ডাকে বায়ু বয়  নানা ফুল ফোটে। আমদের ছোট গ্রাম মায়ের সমান,/আলো দিয়ে বায়ু দিয়ে বাঁচাইছে প্রাণ।’ কবি বন্দে আলী মিঞার কবিতার সেই ছোট গ্রাম আর এখন বাস-বে নেই। গ্রামগুলো দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। গ্রামের আম, জাম গাছ ও বাঁশ ঝাড়ের জায়গায়  উঠছে নতুন নতুন দালানকোঠা। গ্রামগুলি প্রতিনিয়ত পরিণত হচ্ছে নগরে।

২০১১ সাল। সারা পৃথিবীতে একটি তাৎপর্যপূর্র্ণ বছর। এ বছর পৃথিবীর  নগরবাসী জনসংখ্যা গ্রামবাসী জনসংখ্যাকে ছাড়িয়ে গেছে। বর্তমানে নগরবাসী জনসংখ্যা ৫১.৩ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। ১৯০০ সালে বিশ্বে নগরবাসী জনসংখ্যার অনুপাত ছিল ১৩ শতাংশ। মাত্র ৫০ বছরের ব্যবধানে,  ১৯৫০ সালে এ অনুপাত দাঁড়ায় ২৯ শতাংশে এবং ২০০৫ সালে তা  দাঁড়ায় ৪৯ শতাংশে। বর্তমানে বাংলাদেশের প্রায় ৫ কোটি লোক ৩১৫টি নগরে বসবাস করে।  আগামী ২০২০ সাল নাগাদ দেশের শতকরা ৫০ ভাগ  অর্থাৎ সাড়ে আট কোটি লোক নগরে বসবাস করবে। আর ২০৫০ সাল নাগাদ বাংলাদেশের গোটা জনগোষ্ঠি অর্থাৎ প্রায় ২৭ কোটি লোক নগরে বসবাস করবে। নগরায়নের ফলে দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে কৃষি জমি। ১৯৭০ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ ছিল ১ কোটি হেক্টর। বর্তমানে ২০১১ সালে দেশে মোট আবাদি জমির পরিমাণ দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮০ লাখ হেক্টর। বাড়ি-ঘর, রাস-া-ঘাট, কল-কারখানা, অফিস-আদালত ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রভৃতি নির্মাণের ফলে প্রতি বছর ১ শতাংশ হারে কৃষি জমি হ্রাস পাচ্ছে।  এভাবে কৃষি জমি কমতে থাকলে ২০৫০ সালে দেশে মোট কৃষি জমির পরিমাণ দাঁড়াবে ৪৮ লাখ হেক্টরে। মাত্র ৪৮ লাখ হেক্টর কৃষি জমি থেকে ২৭ কোটি মানুষের খাদ্য-শস্য, ফল-মূল, শাক-সবজি, মশলা ও ভেষজ উদ্ভিদ উৎপাদন করাটা বেশ কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। এজন্য আমাদেরকে নগরীয় কৃষির কথা ভাবতে হবে গুরুত্বের সাথে। স’ানীয় সরকার গবেষক আবু তালেব ১৯৯৭ সালের ১৩ জানুয়ারী ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক জাতীয় সেমিনারে ‘নগর সরকারের রূপরেখা’ ও ‘নগরীয় কৃষি’র বিষয়টি সরকারের বিবেচনার জন্য উপস’াপিত করেন; আমাদের সরকাগুলি যদি এর প্রয়োজনীয়তা ও গুরুত্ব বুঝতে পারত এখন উভয় ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনেক দূর এগিয়ে থাকত।

নগর সরকারের বিষয়টি এখন সামনে এসেছে বলে মনে হয়; আশা করি নগর সরকারের রূপরেখা অনুযায়ী নগর সরকার সারাদেশের ছোট-বড় সকল নগরে একসঙ্গে গঠিত হবে। আর নগরীয় কৃষি নিয়ে বর্তমানে পত্র পত্রিকায় বেশ লেখালেখি শুরু হয়েছে। আলোচনা-সমালোচনা শুরু হয়েছে দেশের বিভিন্ন মহলে। এটি অবশ্যই একটি ভাল লক্ষণ। দেশের বেশ কয়েকটি শহরে ব্যক্তি উদ্যোগে নগরীয় কৃষির কিছু কাজকর্মও শুরু হয়েছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায় রাজধানীর অদূরে হেমায়েতপুর এলাকার ইংল্যান্ড প্রবাসী সরকার তাসেকের ছাদে সবজি চাষের কথা। অনেকটা শখের বশেই তার মাতা বেগম তাহেরুন নেছা নিজ বাড়ির  ছাদে শুরু করেন সবজি চাষ। কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ও বালাই নাশক ছাড়াই তিনি তাঁর ছাদে ফলান নানা রকমের সুস্বাদু ও বিষমুক্ত শাক-সবজি। তার দেখাদেখি একই গ্রামের লালমিয়া  ও আওলাদসহ আরো কয়েক জন একই ভাবে বাড়ির ছাদে চাষ করেছেন শাক-সবজি। তাদের এ সাফল্যে সাভার নগর এলাকার ব্যাংক কলোনিতে বাড়ির ছাদে এরই মধ্যে সবজির চাষ শুরু করেছেন তোফায়েল হোসেন, চানমিয়া ও শফিকুলসহ অনেকে। একই নগরে সবজি চাষের আরো হিড়িক লেগেছে রাজাসন, ব্যাংকটাউন, সবুজবাগ, ছায়াবিথী ও শাহীবাগ এলাকার বহুতল বাড়ির অনেক ছাদে। ছাদে সারাদিন রোদপড়ে। সেকারণেই ছাদ থাকে উত্তপ্ত। ফলে গরমের কারণে নিচ তলায় গ্রীষ্ম কালে বসবাস করা খুব কষ্টকর। ছাদে সবজি চাষের কারণে ছাদের তাপমাত্রা শতকরা ৩০-৪০ ভাগ হ্রাস পায়। ছাদের নিচতলা থাকে বেশ ঠাণ্ডা। ছাদে একটা সবুজ-শীতল ও স্নিগ্ধ পরিবেশ বিরাজ করে। তাই সরকার তাসেক মনে করেন, তার অনুকরণে দেশের প্রতিটি বহুতল ভবনের ছাদে সবজি চাষ করা উচিত। কারণ জনসংখ্যা অনুপাতে দেশে আবাদি জমির পরিমাণ ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

আর আবাদি জমি গ্রাস করছে বহুতল বিশিষ্ট দালানকোঠা। এ কারণে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন। অথচ পরিকল্পিত নগরীয় কৃষির মাধ্যমে শহরের অনুৎপাদনশীল ছাদে শাক-সবজি, ফল-ফুল, মশলা ও ভেষজ উদ্ভিদের চাষ করে দেশের খাদ্য ঘাটতি অনেকটা কমিয়ে আনা সম্ভব। বাংলাদেশে কৃষি বলতেই বুঝায় গ্রামীণ কৃষি। গ্রাম ছাড়াও নগরে যে কৃষি কাজ হতে পারে; নগরবাসির প্রয়োজনীয় খাদ্যশস্য, ফলমূল, শাক-সবজি, মাছ-মাংশ, দুধ প্রভৃতি যে পরিকল্পিত ভাবে নগরীয় এলাকায় উৎপাদন সম্ভব তা অনেকেই মানতে রাজি নন। কেউ মানুক, আর নাই মানুক। ২০৫০ সালে বাংলাদেশে কোনো গ্রাম থাকবে না। তাই আমাদের খাদ্য নিরাপত্তার স্বার্থেই এখন থেকে নগরীয় কৃষি ব্যবস’ার দিকে নজর দিতে হবে। ২০০২ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যার মাসিক কৃষি কথায় মেট্রোপলিটান কৃষি কর্মকর্তা আহমেদ আলী চৌধুরী ইকবালের একটি নিবন্ধ থেকে জানা যায় যে, কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তর, ঢাকা জেলার ৪টি মেট্রোপলিটান থানাকে ২৩টি ভাগে ভাগ করে ব্লক ্লসুপারভাইজারগণের মাধ্যমে সমগ্র ঢাকা সিটি করপোরেশনের বিশাল এলাকায় কৃষি কার্যক্রম চালানো হচ্ছে। কৃষি কার্যক্রমগুলো হলোঃ বাড়ির ছাদে ও আঙ্গিনায় বাগান স’াপন, চাহিদা ভিত্তিক তাৎক্ষণিক রোগ ও পোকা দমনে ব্যবস’া গ্রহণ, উপকারী ও পরিবেশ সহায়ক বৃক্ষ রোপণ, ইঁদুর দমন, আম ও অন্যান্য ফলের গাছে কীটনাশক, ছত্রাক নাশক ও হরমোন সেপ্র করণ, জংলি কুল গাছকে বার্ডিংএর মাধ্যমে উন্নত করণ, মিশ্র ফলের বাগান স’াপন, চাহিদা  ভিত্তিক মাশরুম সরবরাহ, বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে ছাত্র-শিক্ষকদের কৃষি বিষয়ক কারিগরী পরামর্শ প্রদান ও বাগান স’াপন, আধুনিক ও উন্নত জাতের শাক-সবজি ও ফুল ও ফলের প্রদর্শনী স’াপন এবং আগ্রহী কৃষাণ-কৃষাণীকে প্রশিক্ষণ প্রদান।

এসব দৈনন্দিন কাজের পাশাপাশি বঙ্গভবন, প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, প্রধানমন্ত্রীর বাসবভন, জাতীয় সংসদ ভবন, কেন্টনমেন্ট, মন্ত্রীদের বাসভবন, সচিবদের বাসভবন ও অন্যান্য ভিআইপিদের বাসভবনে কৃষি কার্যক্রমের দায়িত্ব পালন করা হয় মেট্রোপলিটান কৃষি থানার মাধ্যমে। বর্তমানে মেট্রোপলিটান থানার সংখ্যা বৃদ্ধির সাথে সাথে হয়তো ব্লকের সংখ্যা এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পদ সংখ্যা বাড়ানো হয়ে থাকতে পারে। নগরীয় কৃষির এ সামান্য কার্যক্রম  আমার জানা মতে শুধু রাজধানীতেই পরিচালনা করা হচ্ছে। দেশের অন্যান্য নগরে এ ধরনের ব্ল্লক বা ওয়ার্ড ভিত্তিক নগরীয় কৃষি কার্যক্রমের জন্য উপসহকারী কৃষিকর্মকর্তার পদ আছে বলে আমার জানা নেই। আমরা বলতে চাই, ঢাকা নগরে যে সামান্য নগরীয় কৃষির কার্যক্রম চলছে তা ব্যাপকতর করতে হবে, এবং তা দেশের অন্যান্য নগরে একটি নির্দিষ্ট সংগঠনের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে সমপ্রসারণ করা উচিত হবে। সারা দেশের নগরগুলিতে নগরীয় কৃষি কার্যক্রম পরিচালনার জন্য কৃষি সমপ্রসারণ অধিদপ্তরের অধীনে নগরীয় কৃষি নামে একটি পরিদপ্তর গঠন করা যেতে পারে। নগরীয় কৃষি পরিদপ্তরের অধীনে আঞ্চলিক পরিচালক, উপপরিচালক, নগরীয় কৃষি কর্মকর্তা ও উপসহকারী নগরীয় কৃষি কর্মকর্তার পদ সৃষ্টি করে নগরীয় কৃষির সকল কার্যক্রমকে একটি প্রতিষ্ঠানের অধীনে পরিচালনার ব্যবস’া নেয়া যেতে পারে। এবং প্রতিটি নগরে নগরীয় কৃষির সকল কার্যক্রম নগর সরকারের মাধ্যমে পরিচালিত ও সমন্বিত হওয়া উচিত। এভাবে নগরীয় কৃষির কার্যক্রম সারা দেশে চালু করতে হবে। এগুলি ছাড়াও নগরীয় কৃষির কার্যক্রম সফলভাবে সম্পাদনের জন্য নগরে প্রাণিসম্পদ উন্নয়ন, মৎস চাষ সংক্রান- কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে হবে।

নগরীয় কৃষি কার্যক্রম নগরের বর্তমান ৫ কোটি মানুষের মধ্যে সমপ্রসারণের জন্য আগামী পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় নগরীয় কৃষিকে অন-র্ভূক্ত করতে হবে। নগরীয় কৃষির জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখতে হবে। এসব ছাড়া এর ওপর গবেষণা কার্যক্রম হাতে নিতে হবে। কারণ  গবেষণা ছাড়া কোনো কাজেই সফলতা অর্জন করা যায় না। আমার জানা মতে নগরীয় কৃষির ওপর বাংলাদেশে কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করার তেমন সুযোগ নেই। তাই প্রয়োজনীয়  নগরীয় কৃষিবিদ, ডিপ্লমা নগরীয় কৃষিবিদ তৈরীর জন্য  দেশের বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কৃষি প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটগুলিতে নগরীয় কৃষির ওপর আলাদা বিভাগ চালু করতে হবে। অপর দিকে প্রশিক্ষিত নগরীয় কৃষক সৃষ্টির জন্য যুব প্রশিক্ষণ কেন্দ্রগুলোর সাহায্য নেয়া যেতে পারে। নগরের ছাদে, রাস-ার পাশে, বহুতল ভবনের বাড়িতে বাড়িতে, বারান্দায়, বেলকুনিতে, একতলা বাড়ির আঙ্গিনায়, মিল-কারখানা, অফিস-আদালতের অব্যবহৃত জায়গায় নগরীয় কৃষির কর্মকাণ্ড শুরু হলে আমাদের নগরগুলি হয়ে ওঠবে অফুরন- অক্সিজেনের ভাণ্ডার এবং ফুল, ফল ও সবুজ বৃক্ষে সজ্জিত বাগান। নগরের হাজা-মজা খাল-বিলগুলি ভরে ওঠবে বৃষ্টির  পরিস্কার পানিতে। আসতে শুরু করবে নানা রকমের পাখি। পাখির ডাকে আবার নগরবাসীর ঘুম ভাঙবে। সেই সাথে জেগে ওঠবে আমাদের মৃতপ্রায় নগরগুলি। তা হলে ভবিষ্যত প্রজন্মের জন্য ২০৫০ সালের মধ্যে একটি পরিবেশবান্ধব পরিকল্পিত ‘নগরীয় বাংলাদেশ’ গড়তে সমর্থ হব।

নিতাই চন্দ্র রায়, ডিজিএম (সমপ্রঃ), সেতাবগঞ্জ সুগারমিলস্‌ লিঃ, সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here