ষ্টাফ রিপোর্টার :: আল-বদর নেতা মীর কাসেম আলীর যুদ্ধাপরাধ মামলার আপিল রায় নিয়ে ‘অবমাননাকর’ মন্তব্যের বিষয়ে ব্যাখ্যা দিতে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম ও মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হককে তলব করেছে সর্বোচ্চ আদালত।
মঙ্গলবার (৮ মার্চ) যুদ্ধাপরাধী মীর কাসেমের চূড়ান্ত রায় ঘোষণার আগে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা নেতৃত্বাধীন নয় বিচারকের পূর্ণাঙ্গ আপিলবিভাগ এই আদেশ দেয়। বেঞ্চের অপর আট সদস্য হলেন_ বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা, বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা, বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী, বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার, বিচারপতি মো. নিজামুল হক ও বিচারপতি মোহাম্মদ বজলুর রহমান।
গত ৫ মার্চ রাজধানীর বিলিয়া মিলনায়তনে এক গোলটেবিল বৈঠকে দুই মন্ত্রীর দেয়া যে বক্তব্য সংবাদমাধ্যমে এসেছে তা বিচার প্রশাসনের ওপর হস্তক্ষেপ এবং সুপ্রিম কোর্টের সম্মান ও মর্যাদাকে হেয় করার শামিল বিবেচনা করে কারণ দর্শাতে নোটিশ দিয়েছে আপিলবিভাগ।
ওই বক্তব্যের কারণে তাদের বিরুদ্ধে আদালত অবমাননার কার্যক্রম কেন শুরু করা হবে না_ তা জানতে চাওয়া হয়েছে নোটিশে। দুই মন্ত্রীকে ১৫ মার্চ সকাল ৯টায় হাজির হয়ে এর জবাব দিতে হবে।
আসন গ্রহণের পর নয়টা ৫ মিনিটে আদেশের আগে প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহা বলেন, ‘দেশের সর্বোচ্চ আদালত নিয়ে অশুভ ও অবমাননাকর বক্তব্যে সর্বোচ্চ আদালতের বিচারকরা স্তম্ভিত, যা বিচারবিভাগের স্বাধীনতায় নগ্ন হস্তক্ষেপ বলে আমরা মনে করি।’ গত ৫ মার্চ একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি আয়োজিত এক গোলটেবিল আলোচনায় প্রধান বিচারপতি এসকে সিনহাকে বাদ দিয়ে নতুন বেঞ্চ গঠন করে মীর কাসেমের আপিলের পুনঃশুনানির দাবি তোলেন কামরুল।
তিনি বলেন, আপিলের শুনানিতে যুদ্ধাপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউশন দলের কাজ নিয়ে প্রধান বিচারপতির অসন্তোষ প্রকাশের মধ্যদিয়ে ‘রায়েরই ইঙ্গিত’ মিলছে।
‘এই মামলার রায় কী হবে, তা প্রধান বিচারপতির প্রকাশ্যে আদালতে বক্তব্যের মধ্য দিয়ে আমরা অনুধাবন করতে পেরেছি। তার বক্তব্যের মধ্যে এটা অনুধাবন করেছি, এই মামলায় আর মৃত্যুদ-ের রায় দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।’
মুক্তিযুদ্ধ বিষয়কমন্ত্রী মোজাম্মেল হকও প্রধান বিচারপতির মন্তব্য প্রত্যাহারের দাবি জানান বলে গণমাধ্যমের খবর।
তাদের ওই বক্তব্য তুমুল আলোচনার জন্ম দেয়। মীর কাসেমের আইনজীবী সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি খন্দকার মাহবুব হোসেন এবং বিএনপি নেতারা মন্ত্রীদের বক্তব্যকে ‘ঔদ্ধত্যপূর্ণ’ আখ্যায়িত করে বলেন, এটা বিচারবিভাগের ওপর হস্তক্ষেপ।
এ ধরনের মন্তব্য এড়ানোর পাশাপাশি সবাইকে ধৈর্য ধরার আহ্বান জানিয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, বিতর্কিত বক্তব্যে যুদ্ধাপরাধের বিচারেই প্রশ্নবিদ্ধ হবে।
আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মতো বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমদও বলেন, বিচারাধীন বিষয় নিয়ে কারো মন্তব্য করা উচিত নয়।
প্রধানমন্ত্রীর তিরস্কার
এ ছাড়া প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহাকে নিয়ে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য সরকারের নয় বলে সোমবার মন্ত্রিসভার বৈঠকে জানান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি মন্ত্রিদ্বয়ের নাম উল্লেখ করেননি। তবে যে দুই মন্ত্রীকে ইঙ্গিত করে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেছেন, এ সময় ওই দুই মন্ত্রী সেখানে উপস্থিত ছিলেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি সংগঠনের অনুষ্ঠানে গিয়ে দুইজন মন্ত্রী যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছেন, এতে মনে হয় যেন ওই সংগঠনটি সরকারের কোনো সংগঠন এবং এই বক্তব্য যেন সরকারের বক্তব্য। তিনি বৈঠকে স্পষ্ট করেন, মন্ত্রীদের এ ধরনের বক্তব্যে তিনি বিব্রত হয়েছেন, তার সরকারও বিব্রত।
এই তথ্যের সত্যতা নিশ্চিত করে মন্ত্রিসভায় উপস্থিত একাধিক সদস্য জানান, প্রধানমন্ত্রী দুই মন্ত্রীর বক্তব্য ‘ডিসওন’ করেছেন। মন্ত্রিসভার একাধিক সদস্য বলেছেন, নির্ধারিত আলোচ্যসূচি শেষে দুই মন্ত্রীর বক্তব্য নিয়ে আলোচনার সূত্রপাত করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এই আলোচনায় তিনি কারো নাম উল্লেখ করেননি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, যদি কেউ এ ধরনের বক্তব্য দিতে চান, তাহলে রাস্তায় গিয়ে দেন। মন্ত্রিসভার সদস্য হয়ে বক্তব্য দেয়ার সুযোগ পেলেই যা খুশি বলবেন এবং যে কোনো সংগঠন ও প্রতিষ্ঠানে গিয়ে কথা বলছেন, এটা ঠিক নয়।
সময় চাইবেন কামরুল
এদিকে খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছেন, আদালত অবমাননার অভিযোগ নিয়ে ব্যাখ্যা দিতে তিনি আদালতের কাছে সময় চাইবেন।
সাংবাদিকদের প্রশ্নে আইনমন্ত্রী কামরুল বলেন, ‘আমি আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, আদালতের দিকনির্দেশনা অনুযায়ী যাব। আদালত রুল নিশি জারি করেছে, আমি টেলিভিশনে দেখেছি। হয়তো আদেশের কাগজ পেয়ে যাব। আমি আদালতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল বলেই সেই রুল নিশির জবাব দেব এবং আদালত যেভাবে নির্দেশ দেবে সেভাবেই আমি অগ্রসর হব।’
এই রায় নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, সে বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে কামরুল বলেন, সব প্রশ্নের উত্তর তিনি আদালতকেই দেবেন। তবে সেজন্য তিনি সময় চাইবেন।
তিনি বলেন, ‘আমি আজই দেশের বাইরে যাচ্ছি। একটি সরকারি সফরে মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুর যাব। ১৬ বা ১৭ তারিখ দেশে ফিরব। “আমি আদালতের কাছে আইনজীবীর মাধ্যমে সময় প্রার্থনা করব। এই সফরের জিও ২ মার্চ হয়েছে, আজ মালয়শিয়াতে একটি কনফারেন্সে যাচ্ছি।”
সাংবাদিকরা একের পর এক প্রশ্ন করতে থাকলে এক পর্যায়ে ক্ষিপ্ত হয়ে কামরুল বলে ওঠেন_ আমি আর কোনো প্রশ্নের জবাব দেব না কোনো জবাব দেব না।’
কামরুল বলছেন, মন্ত্রী হিসেবে নয়, যুদ্ধাপরাধ মামলা নিয়ে ওই বক্তব্য ছিল তার ব্যক্তিগত মতামত।