দানব কখনো হয় না মানুষসেবিকা দেবনাথ:: বাচ্চা মেয়েটার ঘুমের ছবি এত মানুষ দেখবে তা হয়তো কেউ কখনও ভাবেনি। নিজেও সেলিব্রেটি না, কোন সেলিব্রেটি পরিবারের সদস্যও নয় মেয়েটি। নিতান্ত সাধারণ পরিবারের মেয়েটার বয়স পাঁচ কী ছয় বছর হবে। তবুও তার দুটি ছবিতে এখন লাখ লাখ লাইক পড়ছে। হাজারে হাজারে মানুষ কমেন্টস করছে। শেয়ারও হচ্ছে দেদারসে।

গায়ের রং শ্যামলা হলেও মেয়েটার মুখটা বেশ মায়া কাড়া। দেখলেই আদর করতে ইচ্ছা করে। গায়ে কমলা ও গোলাপী রঙ মিশেলের একটা ফ্রক। ফ্রকের বুকের অংশটা গোলাপী রঙের। তার উপর কমলা রঙ্গের কাপড় দিয়ে তৈরি ছোট ছোট কুচি লেসের মতো করে বসানো। আর সুতার কাজের লাল ফুল, সবুজ পাতা ও ফুলের উপর নীল রঙের প্রজাপতি। ফ্রকের নিজের অংশটা কমলা রঙের। সেখানেও সুতা দিয়ে ফুল, লতা, পাতার কারুকাজ। ডান কানে একটা লাল পাথরের টব কানের। মাথা ভর্তি কুচকুচে কালো চুল।

প্রথম ছবিতে ডান দিকটা কাত করে শুয়ে আছে বাচ্চা মেয়েটি। পাশ বালিশ ধরে বাচ্চারা যেমনটা ঘুমায় দেখতে ঠিক তেমনটা। আরেকটা ছবিতে দেখা যায় মেয়েটির চোখ দুটো বুঝানো। মুখটা বেশ খানিকটা হা করা। নাক দিয়ে শ্বাস নিতে কষ্ট হলে মুখ ‘হা’ করে যেমন শ্বাস নেয় তেমন। দেখলে মন হবে ঘুমাচ্ছে। ঘুমই বটে। সাগরের জলে পাতা শয্যায় ঘুমাচ্ছে মেয়েটি। তাই মুখ আর বুকটা বাদে পুরো শরীরটাই জলের নিচে।

 দানব কখনো হয় না মানুষপূজা শেষে প্রতিমা ভাসন দিলে দেখতে যেমন লাগে বাচ্চা মেয়েটার ছবি দুটি দেখে আমার তেমনই মনে হয়েছে। আর বারবার মনে পড়ছে সমুদ্র তীরে উপুর হয়ে পড়ে থাকা লাল গেঞ্জি ও নীল রঙ্গা থ্রি-কোয়াটার প্যান্ট পড়া আইলানের কথা। যে আইলান কাঁদিয়েছিলো বিশ্ববাসীকে। বিশ্ব মানবতার করুণ চিত্র তুলে ধরেছিলো। বাচ্চা মেয়েটার ওই দুটি ছবি দেখেও কাঁদছে অনেকে। সেও চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে আমাদের মানবতার দৈন্যতাকে। যে দেশ বংশ পরম্পরায় বর্বরতা চালিয়ে যাচ্ছেন তারা হয়তো ভুলে গেছেন, প্রকৃতি একদিন ঠিকই এই বর্বরতার প্রতিশোধ নেবে। এ থেকে নিস্তার নেই।

গণমাধ্যমে প্রতিদিনই রোহিঙ্গা ইস্যুতে রিপোর্ট দেখছি। নির্যাতিত-নিপীড়ত মানুষগুলোকে দেখি আর বুকের ভেতরটা হাহাকার করে ওঠে। বাচ্চাগুলোর কষ্ট দেখলে নিজের উপরও ঘেন্না ধরে যায়। আজকের এই সভ্য পৃথিবীতে এমন বর্বরতা!!! মনে মনে বলি,‘ঈশ্বর মানুষের মনে তুমি এত বিষ কীভাবে দিলে? এত নিষ্ঠুরতা তুমি কীভাবে সহ্য করো?’

টুকটাক পড়ে আমার মনে হয়েছে ফুটবলের আরেক নাম রোহিঙ্গা। ফুটবল যেমন একজনের লাথি খেয়ে আরেক জনের পায়ের কাছে যায় রোহিঙ্গাদের অবস্থাও যেন তেমন।

বিভিন্ন প্রতিবেদন পড়ে যেটুকু জেনেছি, রোহিঙ্গা ইস্যু নতুন নয়। ওরা অনেকদিন আগে থেকেই নির্যাতিত হয়ে আসছে। ইদানিং ইস্যুটা নিয়ে বেশ আলোচনা হচ্ছে। মিয়ানমারের একটি বড় অংশ মনে করে, রোহিঙ্গারা ভারতীয়, বাঙ্গালী ও মুসলমান। যাদেরকে ব্রিটিশরা আরাকানে এনেছে। চারপাশে যা দেখছি তাতে একটাই উপলব্ধি হচ্ছে, সংখ্যালঘু হয়ে জন্মানোটাই যেন অপরাধ। যারা মানবাধিকারের ধ্বজা উড়িয়ে বেড়ান তারা এই ইস্যুতে কিঞ্চিত না বেশ খানিকটা মৌন।

রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমাদের দেশের মানুষ দ্বিধাবিভক্ত। একদল মনে করছে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া ঠিক হবে না। আরেকদল বলছে তাদের আশ্রয় দেয়া উচিত। যারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার ক্ষেত্রে বিরোধিতা করছেন তাদের যুক্তি বাংলাদেশে রোহিঙ্গিদের আশ্রয় দেয়াটা এই ইস্যুর সঠিক সমাধান নয়। এটি আমাদের দেশ এবং রোহিঙ্গা উভয় পক্ষের জন্য ক্ষতিকারক। রোহিঙ্গারা সহজেই বাংলাদেশের মুসলিম জঙ্গী গোষ্ঠীর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। ওদের অভাবের সুযোগ নিয়ে জঙ্গী সংগঠনগুলো ওদের নাশকতার কাজে লাগাচ্ছে।

তবে সীমিত জ্ঞানে আমার যা মনে হচ্ছে, রোহিঙ্গাদের উপর যা চলছে তাকে আর দাঙ্গা বলা যায় না। মানুষ হিসেবে তাদের প্রতি আমাদের সহানুভূতি থাকা উচিত। তবে আমি আবারও বলছি বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়া রোহিঙ্গা ইস্যুর কোন সমাধান নয়।

মানবাধিকার সংগঠনগুলো, মানবতার মূর্তিমান প্রতীক যারা তারা কেন এই ইস্যুতে আরও সোচ্চার হচ্ছেন না? তারা কি ফান্ডের অভাবে ভুগছেন? সহমর্মিতা, সহানুভূতি, সমানুভূতি শব্দগুলো কেন জানি না মনে হয় দিন দিন বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। ভূপেন হাজারিকার একটা গানই ঘুরে ফিরে মনে পড়ছ, ‘মানুষ যদি সে না হয় মানুষ/ দানব কখনো হয় না মানুষ’। আমরা মানুষরূপী প্রাণীগুলো দিনকেদিন দানব হয়ে উঠছি। আর গিলে খাচ্ছি মানবতা।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here