তিস্তা চুক্তি নিয়ে জলঘোলা হওয়ার পর বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে নতুন করে আলোচনা শুরু করতে চাইছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। মলদ্বীপে আসন্ন সার্ক সম্মেলনে দু’দেশের শীর্ষ স্তরে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হওয়ার কথা। তবে তিস্তা চুক্তি নিয়ে রণকৌশলই এ বার পাল্টে ফেলেছে কেন্দ্রীয় সরকার। দিল্লি বুঝতে পেরেছে, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে বাদ দিয়ে ঢাকার সঙ্গে এই চুক্তি রূপায়ণ করা সম্ভব নয়। তাই এই কূটনৈতিক দৌত্যে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে অনেক বেশি করে যুক্ত করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
এই রণকৌশল কাজে লাগানোর প্রথম সুযোগ হতে পারে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাৎসরিক সমাবর্তনে। এই সমাবর্তনে উপস্থিত থাকার জন্য শেখ হাসিনাকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দিল্লি চাইছে, হাসিনা যদি আসেন, তা হলে ওই অনুষ্ঠানে মমতাও উপস্থিত থাকুন। এবং মমতার সঙ্গে শেখ হাসিনার মুখোমুখি কথা হোক। সেই কারণে দিল্লি চাইছে, আপাতত ত্রিপুরা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ না করে হাসিনা কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের আমন্ত্রণ গ্রহণ করুন। কেন্দ্রীয় সরকারের ধারণা, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীর একান্ত সাক্ষাৎকার তিস্তা চুক্তি সংক্রান্ত বরফ গলিয়ে দিতে পারে। বাংলাদেশের এক কূটনীতিকের বক্তব্য, “দেরিতে হলেও নয়াদিল্লির এই বোধোদয় দু’দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ককে এগিয়ে নিয়ে যেতে সাহায্য করবে।”
সাউথ ব্লক বলছে, মমতাকে রাজনৈতিক দূত হিসেবে ব্যবহার করার কৌশলটি আসলে চিনা পদ্ধতি। সমাজতন্ত্রী এই দেশে ইদানীং জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে ফেডেরাল ডিপ্লোমেসি বা যুক্তরাষ্ট্রীয় কূটনীতি। এই কূটনীতি অনুসারে চিন তাদের দেশকে চার ভাগে ভাগ করেছে। এবং চার প্রান্তে চারটি আঞ্চলিক কূটনৈতিক কেন্দ্র স্থাপন করেছে। যেমন কুনমিন প্রান্তে একটি আঞ্চলিক দফতর খোলা হয়েছে ভারতের পূর্বাঞ্চল এবং মায়ানমারের সঙ্গে কূটনৈতিক দৌত্য করার জন্য। কলকাতা-কুনমিন মাত্র দু’ঘণ্টার উড়ান। প্রতিদিন বিমান চলাচলও করে। কুনমিনের আঞ্চলিক নেতারা পূর্ব ভারতের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রাখছেন। তাঁরা মমতার সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছাও প্রকাশ করেছেন।
অন্য দিকে, ঝিয়াবাও প্রদেশ থেকে পশ্চিম ভারত এবং পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক রক্ষা করা হচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থনৈতিক বিষয়ও দেখভাল করা হচ্ছে। ঝিয়াবাও এলাকার নেতারা সরাসরি গুজরাত সরকারের সঙ্গে কথা বলে সেখানে বিদ্যুতের ট্রান্সফর্মার বসানোর বরাত নিয়েছেন। ওই প্রকল্পে গুজরাতের দু’হাজার লোকের কর্মসংস্থান হবে।
এই সব কার্যকলাপে চিনের শীর্ষ নেতৃত্বের কোনও আপত্তি নেই এবং তাঁরা সে ভাবে নাকও গলান না। সম্প্রতি ভারতের কয়েক জন বিশেষজ্ঞ চিনে গিয়ে এই মডেলটি দেখে এসে বিদেশ মন্ত্রকের কাছে রিপোর্ট দেন। দেরিতে হলেও ভারত এখন ওই পদ্ধতি অনুসরণ করে মমতাকে কাজে লাগিয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের বাধা কাটানোর চেষ্টা করছে।
মনমোহন সিংহের সরকার আরও স্বীকার করেছে যে, তিস্তা চুক্তি পশ্চিমবঙ্গ সরকার মেনে নেবেই এমন একটা ‘আত্মসন্তুষ্টি’ তাদের মধ্যে এসে গিয়েছিল। কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করার লক্ষ্যে ওই চুক্তি করতে চাওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতে যে রাজ্যের আপত্তি থাকতে পারে, তা বোঝার ক্ষেত্রে খামতি ছিল। মমতার আপত্তিতে প্রধানমন্ত্রীর সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরে ওই চুক্তি করা যায়নি। যার ফলে ওই সফর কার্যত ব্যর্থই হয়।
এখানেই ভুলের ইতি নয়। এর পর হাসিনা যখন তিনবিঘা সফরে আসেন, তখন সেই অনুষ্ঠানে মমতাকে আমন্ত্রণই জানানো হয়নি। বিদেশ মন্ত্রকের সঙ্গে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের আলোচনায় ঠিক হয়েছিল, তিনিই মমতাকে আমন্ত্রণ জানাবেন। কিন্তু স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক থেকে নিয়মমাফিক রাজ্য প্রশাসনের কাছে শেখ হাসিনার সফরসূচি পাঠানো হলেও মমতাকে আমন্ত্রণ জানাননি চিদম্বরম। সেটা যে মস্ত বড় ভুল হয়েছে, তা ভারতের বিদেশ মন্ত্রক স্বীকার করে নিচ্ছে। তবে মমতা বা ঢাকা কেউই বিষয়টি নিয়ে বিশেষ বিতর্ক বাড়াতে চায়নি। তাতে মৈত্রীর পরিবেশ নষ্ট হত। তবে দিল্লির ভূমিকা নিয়ে দু’পক্ষের মধ্যেই চাপা অসন্তোষ ছিল।
কলকাতার ইন্ডিয়ান কাউন্সিল অফ কালচারাল রিলেশনসে (আইসিসিআর) রবীন্দ্র সার্ধ শতবর্ষ উপলক্ষে একটি অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে রাজ্যে যাওয়ার কথা ছিল বিদেশমন্ত্রী এস এম কৃষ্ণর। রবীন্দ্রনাথের উপর আইসিসিআর একটি তথ্য চিত্র প্রদর্শন করার পরিকল্পনা ছিল। সেখানেই মমতার সঙ্গে তিস্তা নিয়ে কথা হওয়ার কথা ছিল কৃষ্ণের। কিন্তু কৃষ্ণকে বিদেশ সফরে চলে যেতে হয়। ফলে তাঁর আর কলকাতা যাওয়া হয়নি। ইতিমধ্যে মমতাও সিকিমের মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে তিস্তা নিয়ে আলোচনা করেন। সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী মমতার অবস্থানকে সমর্থন জানান।
এখন মমতা নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্রকে গোটা বিষয়টি খতিয়ে দেখতে বলেছেন। সেই রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে তিনি পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবেন। গত মাসে দিল্লিতে মনমোহনের সঙ্গে বৈঠকে মমতা জানিয়ে দিয়েছেন, শেখ হাসিনার সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক মধুর। কিন্তু তিস্তায় জল নেই। এবং পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করে জল চুক্তি করতে তিনি রাজি নন। বাংলাদেশ ও ভারতের সরকারের বক্তব্য, জলের অভাব রয়েছে বলেই বাঁটোয়ারা হচ্ছে। তাই এমন সমাধান সূত্র বার করতে হবে যখন জল থাকবে তখনই বাঁটোয়ারা হবে। কতটা জল থাকলে বাঁটোয়ারা হবে সেটাই নির্ধারণ করতে হবে।
আজ দিল্লিতে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক নিয়ে এক বক্তৃতায় ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের হাই কমিশনার তারির করিম বলেন, “স্থানীয় রাজনীতির হাতে বন্দি না থেকে বৃহৎ চিত্রের দিকে তাকানোর সাহস দেখালে তবেই তিস্তার জলবণ্টন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান হতে পারে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেই সাহস দেখিয়েছেন। তবে সংশ্লিষ্ট কোনও পক্ষের স্বার্থহানি হোক, সেটা আমরা চাই না।”
মনমোহন ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন দু’টি বিষয় মেনে নিয়েছেন।
প্রথমত, পশ্চিমবঙ্গকে বঞ্চিত করে কোনও চুক্তি হবে না। দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থায় কোনও অঙ্গরাজ্যের সঙ্গে মতপার্থক্য নিয়ে জাতীয় স্তরে চুক্তি করা যায় না। আপাতত এই বোধোদয়ের পর কেন্দ্রীভূত কূটনীতির মডেলে পরিবর্তন এনে চিনের অনুসরণে যুক্তরাষ্ট্রীয় মডেলের পথে হাঁটতে চাইছে কেন্দ্র। ঢাকাও চাইছে, মমতাকে গোটা প্রক্রিয়ায় সামিল করে বাস্তব পরিস্থিতির উপর দাঁড়িয়ে ধীরেসুস্থে একটি দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি করা হোক।

সূত্র : আনন্দবাজার কলকাতা

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/নিউজ ডেস্ক

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here