টাইফয়েড যদি হয়ষ্টাফ রিপোর্টার :: এটি একটি পানি বাহিত রোগ। সাধারণত আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত ও দ্যনালীতে এই জীবাণু অবস্থান করে এবং প্রস্রাব ও মলের মাধ্যমে পরিবেশে উন্মুক্ত হয় যা পরবর্তীতে পানি বা খাবারের মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। টাইফয়েড জীবাণু সংক্রমিত পানি বা খাবারের মাধ্যমে অন্য আরেকজন আক্রান্ত হন।

টাইফয়েড জ্বর কিভাবে ছড়ায়ঃ

টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি স্যালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া বহন করে অথবা টাইফয়েড জ্বর হতে আরোগ্য লাভ করেছেন কিন্তু এই ব্যাকটেরিয়া বহন করছেন এমন কিছু সংখ্যক ব্যক্তিও এই রোগের বাহক হতে পারেন। টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত ব্যক্তি এবং স্যালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়া বহনকারী উভয় ধরনের ব্যক্তিরাই মলত্যাগের মাধ্যমে এই ব্যাকটেরিয়ার বিস্তার ঘটিয়ে থাকে। যা আমাদের দেশে বেশির ভাগ এই একটি সমস্যা সবচেয়ে বেশি দায়ি।

যেমনঃ- পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা যথাযথ না হলে এবং তার ফলে টাইফয়েড রোগীর মলত্যাগের পর এই ব্যাকটেরিয়া পানির সংস্পর্শে আসলে এবং পরবর্তীতে এই দূষিত পানি খাবারে ব্যবহৃত হলে অথবা টাইফয়েড জ্বরের ব্যাকটেরিয়া বহন করছে এমন কোন ব্যক্তির স্পর্শকৃত বা হাতে বানানো খাবার গ্রহণ থেকেও টাইফয়েড জ্বর সংক্রমিত হতে পারে। বসতিপূর্ণ এলাকার লোকজনের টাইফয়েড জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।

পানি ছাড়াও জীবাণু দ্বারা দূষিত দুধ কিংবা দুগ্ধজাত সামগ্রী, নারিকেল, চিংড়ি, মাছ, ডিম, কাচা সবজি, সালাদ, লেটুস প্রভৃতি থেকেও জীবানুটি মানুষের মাঝে ছড়াতে পারে। মাছি মানুষের মলমুত্র খেয়ে জীবনধারণ করে। মানুষ যখন মাছিতে বসা খাবার খায় তখন সেটি মানুষে সংক্রমিত হয়। আক্রান্ত ব্যক্তির হাত না ধুয়ে খাবার খাওয়া, মল ত্যাগের পরে হাত না ধোয়া ইত্যাদি কারনেও এটা ছড়াতে পারে।

একবার শরীরে প্রবেশ করার পরে জীবাণু অন্ত্র থেকে রক্তে প্রবেশ করার মাধ্যমে সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। এই অসুখ তরুণদের মাঝেই বেশি হতে দেখা যায়।আমাদের দেশে মুলত খাবার পানি ও হোটেলের খাবার বা অনেক সময় ঠাণ্ডা আইস্ক্রিম বা ড্রিঙ্ক জাতিয় খাবার থেকে বেশি চড়ায় বলে বিশেষজ্ঞদের ধারনা  টাইফয়েড জ্বর সাধারনত  ১০-১৪ দিন পর ধরা পরে।

লক্ষণঃ-

যেহেতু  টাইফয়েড জ্বর সাধারনত ১০-১৪ দিন পর ধরা পরে তাই রোগের প্রথম অবস্তায় হঠাৎ জ্বর আসতে পারে যা ১০৩ -১০৪ ফারেনহাইট (৩৯.৪ অথবা ৪০ সে.) এবং পরে তাপমাত্রা ব্রিদ্ধি পেতে থাকবে যা তাপমাত্রা ৪-৫ দিনের মধ্যে নিচে নেমে আসে না। (Reflex bradycardia) – শরীরে ব্যথা, খাদ্যে অরুচি ও গাঁ মেজ মেজ করা এবং মাথাব্যথা থাকবে । অনেকের কোষ্ঠকাঠিন্য থাকতে পারে এবং বাচ্চাদের ডায়রিয়া এবং বমি হ’তে পারে- জরের তুলনায় পালস রেট কম থাকবে । ৫/৬ দিন পরে বুকে বা পিঠে গোলাপী বা লালচে মত দাগ দেখা দিবে যা অনেক সময় মিলিয়ে যায় –( আঙ্গুলের চাপে মিলিয়ে যায় )- পেট ফাপা-ফোলা, বা অনেক সময় গ্যাস্ট্রিকের মত লক্কন আবার কার কারও কোস্টকাটিন্নতা বেশি দেখা যায়।

যা প্রথম সপ্তাহে কোন সময় ধরা পড়েনা বা অনেক সময় অন্য জাতিয় জ্বরের লক্ষণের মত ও দেখা যায় – লক্ষণের দিক দিয়ে ১২ দিন পর টাইফয়েডের আসল রুপ ধরা পরে। তখন প্লিহা বাড়া , মারাত্মক অস্তির ভাব, ডায়রিয়া, হার্ট রেট বা হৃদস্পন্দন কমে যাওয়া, ক্ষুধামন্দা। কফ বা কাশি বেড়ে যাওয়া- শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পাওয়া- প্রলাপ (Delirious) বকে ইত্যাদি লক্ষন দেখা যায়।

পরবরতিতে ২১/২২ দিন অতিক্রম হওয়ার পর যে সকল মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে- কফ বা কাশি বেড়ে যাওয়া- শরীরের ওজন দ্রুত হ্রাস পাওয়া- প্রলাপ (Delirious) বকে-অন্ত্রে ছিদ্র বা রক্তক্ষরণ–হৃৎপিন্ডের মাংসপেশীতে প্রদাহ-অগ্ন্যাশয়ে প্রদাহ (Panereatitis)–কিডনিতে (Kidney) সংক্রমণ–মেরুদন্ডে সংক্রমণ–শরীরের ঝিল্লিতে (Membrane) সংক্রমণ ও প্রদাহ এবং মাথায় ও মেরুদন্ডে তরল/রক্ত (Fluid) জমাট বাঁধা-বিভিন্ন ধরণের মানসিক সমস্যা যেমন- বিকারগ্রস্থ (Delirium) , দৃষ্টিভ্রম (Hallucination), মস্তিষ্ক বিকৃতি (Paranoid) দেখা দেয়। মোট কথায় অবশেষে শরীরের যে কোন অঙ্গের মারাত্মক বিকলাঙ্গতা ও দেখা দিতে পারে।

পরীক্ষা-নিরীক্ষা

* প্রথম সপ্তাহের পরীক্ষা : এ সময় সাধারণত রক্তের দুটি পরীক্ষা করা হয়।

সিবিসি : কমপ্লিট ব্লাড কাউন্ট। যাতে দেখা হয় রক্তের বিভিন্ন কণিকার হ্রাস-বৃদ্ধি কতটা হয়েছে। অন্য পরীক্ষাটি ব্লাড কালচার : এটা রক্তের পরীক্ষা। এতে সাধারণত তিন দিন সময় লাগে। দেখা হয় কী ধরনের জীবাণু সংক্রমণ ঘটেছে এবং সেই জীবাণুর বিপক্ষে কোন অ্যান্টিবায়োটিক কার্যকরী।

* দ্বিতীয় সপ্তাহের পরীক্ষা : এ সময় শুধু রক্তের একটি পরীক্ষা করা হয়। যা ব্লাড কালচার নামে পরিচিত।

* তৃতীয় ও চতুর্থ সপ্তাহে : এ সময় মূলত করা হয় স্টুল বা পায়খানা কালচার পরীক্ষা

উইডাল টেস্ট

উইডাল টেস্ট নামের পরীক্ষাটি করে অনেকে টাইফয়েড নির্ণয় করে থাকেন। কিন্তু এটা পুরোপুরি নিশ্চিত পরীক্ষা নয়। তাই টাইফয়েড নির্ণয়ে উইডাল টেস্টের ভূমিকা নগণ্য। যদি প্রথম সপ্তাহে উইডাল টেস্ট স্বাভাবিক পাওয়া যায় এবং পরের সপ্তাহে উইডাল টেস্ট স্বাভাবিকের চেয়ে চার গুণ বেশি হয়, তখন টাইফয়েড হয়েছে সন্দেহ করা হয়।

জটিলতাঃ

উপযুক্ত চিকিৎসা না হলে টাইফয়েড সংকটাপন্ন পরিস্হিতি তৈরি করতে পারে। পরিপাকতন্ত্র থেকে রক্তপাত হতে পারে, এমনকি পরিপাকতন্ত্র ছিদ্র পর্যন্ত হয়ে যেতে পারে। এ রোগের কারণে হাড় বা সন্ধিতে প্রদাহ, মেনিনজাইটিস, পিত্তথলিতে ইনফেকশন, নিউমোনিয়া, শরীরের বিভিন্ন স্হানে ফোঁড়া, স্নায়বিক সমস্যা ইত্যাদি হতে পারে। বিভিন্ন জটিলতা থেকে রোগীর মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে।

এ রোগের প্রথম ৬ দিনের ভিতর টাইফয়েড জ্বর নির্ণয় করা খুভ কঠিন এবং এর জন্য বলা হয় যাহাতে যে কোন জাতিয় জ্বরের জন্য প্রথম সপ্তায় কোন ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক ব্যাবহার না করা কারন পরবর্তীতে আন্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্স দেখা যায় । যার কারনে সাত দিন পর রক্তের কালচার করানো ভাল – তখন অনেক সময় ধরা পরে (স্যালমোনেলা টাইফি ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি নিশ্চিত হওয়ার ) Widal Test ভিডাল টেষ্ট – এ পরীক্ষার ফলাফল নিশ্চিত কোনো তথ্য দেবে এমন টা আসা করা টিক না তবে ২১ দিন পর অবশ্যই নিশ্চিত হওয়া সম্বভ, রক্ত এবং পায়খানার কালচার করে।

চিকিৎসাঃ

আধুনিক যোগে টাইফয়েডের চিকিৎসা অত্তান্ত সহজ যদি টাইফয়েড সঠিক সময় ধরা পরে বিশেষ করে যদি আগে কোন অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্টেন্ট না হ্যা থাকে, সে জন্য সিপ্রোফ্লোক্সাসিন ই যথেষ্ট- সাথে অবশ্য অন্যান্য আনুসাঙ্গিক কিছু ঔষধ সহযোগী হিসাবে আপনার চিকিৎসক দিতে পারেন অথবা রেজিস্ট্যান্টদের ক্ষেত্রে সেফট্রায়োক্সোন ব্যাবহার হয়ে থাকে এবং অসুখ দীর্ঘ মেয়াদি হলে বা রোগী আবেগ প্রবন হলে স্টেরয়েড গ্রোফের ঔষধ ও দিয়ে থাকেন চিকিৎসকরা – শারীরিক অবস্থা বুজে আই ভি স্যালাইন ও অনেকের প্রয়োজন থাকতে পারে।

টাইফয়েড প্রতিরোধের জন্য বাজারে এখন ভ্যাকসিন বের হয়েছে যার একটা প্রতি ৩ বছর পর পর মাংশপেশীতে নিতে হয় এবং একটি মুখে ও দেওয়া হয়ে থাকে — ( Biovac Typhoid )
মনে রাখবেন পথ্য হিসাবে এই অসুখের রোগিদের কে প্রচুর পরিমানে উচ্চ প্রোটিন জাতিয় খাবার ও তরল খাবার সব সময় খাওয়ালে পরবর্তীতে রোগির তেমন মারাত্মক ক্ষতির সম্বাভনা খুভি কম।

প্রতিরোধ বা যা করনীয়ঃ

  1. শাকসবজি, ফলমূল এবং রান্নার বাসনপত্র পরিষ্কার পানিতে ধৌত করতে হবে।
  2. ভালভাবে রান্নাকৃত বা সিদ্ধকৃত খাবারই কেবলমাত্র পান করুন।
  3. খাবার গ্রহণ, প্রস্তত বা পরিবেশনের পূর্বে খুব ভালভাবে হাত ধৌত করুন।
  4. ভালভাবে ফুটানো, পরিশোধিত বা বোতলজাত বিশুদ্ধ পানিই কেবলমাত্র পান করুন।
  5. পর্যাপ্ত পরিমাণে ফুটানো পানি বা পরিশোধিত পানি সংরক্ষণ করুন এবং পানি যাতে দূষিত হতে না পারে সে জন্য ২৪ ঘণ্টার মধ্যে সংরক্ষণকৃত সেই পানি পান করুন।
  6. বোতলজাত, পরিশোধিত বা ফুটানো পানি হতে বরফ তৈরি করা না হলে সেই বরফ মিশিয়ে পানি বা অন্য কোন পানীয় পান করা হতে বিরত থাকুন।
  7. যে সমস্ত সবজি বা ফলমূলের খোসা উঠানো যায় না সেগুলো এড়িয়ে চলুন।
  8. আর যে সমস্ত ফলমূলের খোসা উঠানো যায় সেগুলোর ক্ষেত্রে আগে ভালভাবে সাবান দিয়ে হাত পরিষ্কার করে তারপর খোসা উঠানো উচিত এবং সেই খোসা খাওয়া উচিত নয়।
  9. রাস্তার পার্শ্বস্থ দোকানের খাবার গ্রহণ এবং পানি পান করা থেকে বিরত থাকা উচিত।
  10. টয়লেট ব্যবহারের পর ভালভাবে হাত পরিষ্কার করুন, এছাড়া টয়লেট সব সময় পরিষ্কার রাখুন।
  11. মনে রাখবেন হাত ভাল ভাবে ধৌত করতে পারিষ্কার পানি ব্যবহার করবেন সব সময় বিশেষ করে খাবার পানি অবশ্যই হাতের সম্মুখভাগ, পশ্চাতভাগ, আঙ্গুলগুলোর মাঝামাঝি অংশ এক কথায় হাতের সকল অংশই যথাযথভাবে পরিষ্কার করুন।
Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here