ঢাকা : অষ্টাদশী আয়েশা। ছদ্মবেশী প্রেমিকা। টার্গেট তার ধনীর দুলালরা। ফোন নম্বর সংগ্রহ করে কখনও মিস কল, কখনও সরাসরি কল করে। রং নম্বরের দোহাই দিয়ে কথা বলার উপলক্ষ্য তৈরি করে। চটপটে স্বভাব নিজেকে উপস্থাপন করে কখনও স্কুল, কখনও কলেজপড়ুয়া ছাত্রী হিসেবে। কয়েক দিনের ঘনিষ্ঠ ফোনালাপের পরপরই প্রেম নিবেদন। তার প্রস্তাবে যিনি রাজি হন, তিনিই তার প্রেমের ফাঁদে বন্দি হয়ে পড়েন। পরে তার লোভনীয় লংড্রাইভের প্রস্তাব লুফে নিয়ে বুঝতে পারেন- তিনি অপহৃত হয়েছেন। এতদিন প্রেমিকা ভেবে যার সঙ্গে কথা বলেছেন, অন্তরঙ্গ সময় কাটাতে ঘরের বাইরে বেরিয়েছেন, তিনি আসলে প্রেমিকা নন- প্রকৃতপক্ষে অপহরণ চক্রের লেডি ক্রিমিনাল। গত শুক্রবার রাতে এই আয়েশা আক্তার ও তার বয়ফ্রেন্ড মনোয়ার গ্রেপ্তার হন। গতকাল তাদের তিন দিনের রিমান্ডে নিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ। রিমান্ডে আয়েশা জানায়, বিত্তশালী পরিবারের সন্তানদের টার্গেট করে প্রেমের ফাঁদে ফেলি। পরে লংড্রাইভের প্রলোভন দেখিয়ে পাশাপাশি বসে অপহরণ সিন্ডিকেটের আস্তানায় নিয়ে যাই। এরপর অপহরণকারী চক্রের অন্যান্য সদস্য ওই প্রেমিকের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করে। দাবি করে লাখ লাখ টাকার মুক্তিপণ। প্রাণ বাঁচাতে অনেকেই অপহরণকারীদের টাকা দিয়ে ছেলের জীবন রক্ষা করেন। আয়েশা আরও জানায়, গত দেড় বছরে সে চার যুবককে প্রেমের ফাঁদে ফেলে প্রায় ৭ লাখ টাকা হাতিয়ে নিয়েছে। তাদের মধ্যে পুরান ঢাকার এক ব্যবসায়ীর ছেলে,  বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাইমুনকে প্রেমের ফাঁদে ফেলে দিনাজপুর জেলার বিরামপুর থানার গহিন এলাকায় নিয়ে যাই। সেখানে কথিত মামা শহীদুলের আস্তানায় কয়েকদিন আটকে রেখে প্রায় তিন লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায় করি। গোয়েন্দারা জানান, আয়েশার প্রেমের ফাঁদে পড়ে তিন লাখ টাকা দিতে বাধ্য হয়েছে মুন্সীগঞ্জ জেলার ইমরানের পরিবার। একই ভাবে যশোরের যুবক রাজীবের সঙ্গে  প্রেমের অভিনয়ের পর তাকেও জিম্মি করে দুই লাখ টাকা আদায় করে আয়েশার সিন্ডিকেট। গোয়েন্দারা আরও জানান, আয়েশা যে কৌশলে বিত্তশালী যুবকদের প্রেমের ফাঁদে ফেলে সেই একই কৌশলে মনোয়ারের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তুলে বিয়ে করে। এরপরই তারা ওই কৌশল অবলম্বন করে মুক্তিপণের টাকা আদায় করতে থাকে। মুক্তিপণের টাকা কখনওই তারা কোন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট বা কুরিয়ারের মাধ্যমে নেয় না। কেবল বিকাশের মাধ্যমে গ্রহণ করে। অনেকে তাদের ফাঁদে পড়ে ডিবি’র কাছে অভিযোগ করলেও কেউ কেউ মান-সম্মানের ভয়ে নাম প্রকাশ করতে রাজি হয়নি। অভিযান পরিচালনাকারী ডিবি’র সহকারী কমিশনার (এসি) মাহমুদা আফরোজ লাকী বলেন, হাজারীবাগ এলাকার সালেহা স্কুল থেকে এসএসসি পাসের পর আয়েশা ২০১২ সালে মোবাইলে প্রেম করে বিয়ে করে মনোয়ারকে। দিনাজপুরের পূর্বপরিচিত শহীদুল মামা নামে একজনের পরামর্শ ও সহযোগিতায় তারা প্রতারণার কাজ শুরু করে। সূত্রমতে, আয়েশা-মনোয়ারের সিন্ডিকেটের সদস্যরা রাজধানী জুড়ে সক্রিয়। তারা কখনওই এক বাসায় বেশিদিন থাকে না। এমনকি একটি ঘটনার পর ব্যবহৃত মোবাইল  সেট ও সিম বদল করে থাকে। গ্রেপ্তারকৃত আয়েশার গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জের শ্রীনগরে এবং মনোয়ারের বাড়ি আশুলিয়ায়। চলতি বছরের প্রথম দিকে রাজধানীর লালবাগ এলাকার বাসিন্দা মনির হোসেনের ছেলে ইয়ামিনের সঙ্গে মোবাইল ফোনে পরিচয় হয় আয়েশার। এরপর ইয়ামিনের সঙ্গে প্রেমের সম্পর্ক গড়ে তোলে আয়েশা। গত এপ্রিলে ইয়ামিনকে নিয়ে ঢাকার বাইরে বেড়াতে যাওয়ার প্রস্তাব দেয় আয়েশা। তার প্রস্তাবে রাজি হন ইয়ামিন। পরে তারা দুজনে দিনাজপুরে যাওয়ার জন্য গাবতলী থেকে বাসে উঠে রওনা হয়। আগে থেকে ওই বাসে অপহরণকারীদের কয়েক সদস্যও ছিল। বাস থেকে নামার পরপরই তারা ইয়ামিনকে আটক করে নিজেদের আস্তানায় নিয়ে যায়। এরপর অপহরণকারীরা ইয়ামিনের বাবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করে তার মুক্তির জন্য ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। এক পর্যায়ে অপহরণকারীরা ৫ লাখ টাকায় মুক্তি দিতে রাজি হয়। অনেক অনুনয়-বিনয় করে দেড় লাখ টাকার বিনিময়ে ছেলেকে ফিরে পান ইয়ামিনের পিতা মনির হোসেন। এরপর ইয়ামিনের পরিবারের পক্ষ থেকে লালবাগ থানায় একটি মামলা হয়। ওই মামলার তদন্তের সূত্র ধরেই প্রথমে আয়েশা, পরে তার বয়ফ্রেন্ড মনোয়ারকে গ্রেপ্তার করা হয়।-মানবজমিন

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here