সংসদে প্রধানমন্ত্রীস্টাফ রিপোর্টার :: সরকারি চাকরিতে বিদ্যমান সব কোটা বাতিলের ঘোষণা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি বলেছেন, কোটা নিয়ে যখন এতকিছু, তখন কোটাই থাকবে না। কোনো কোটার দরকার নেই। কোটা পদ্ধতি তুলে দিলাম। প্রতিযোগিতার মাধ্যমে সবাই চাকরিতে আসবে। আর ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ও প্রতিবন্ধীদের চাকরির জন্য বিশেষ ব্যবস্থা রাখা হবে। তিনি শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, আন্দোলন অনেক হয়েছে। এবার তাদের ক্লাসে ফিরে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি।

বুধবার জাতীয় সংসদে প্রধানমন্ত্রীর জন্য নির্ধারিত প্রশ্নোত্তর পর্বে শেখ হাসিনা এসব কথা বলেন। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে অধিবেশন শুরু হয়। এই অধিবেশনে প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় গভীর রাতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের বাসায় হামলা, ভাংচুর ও লুটপাটের ঘটনায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, যারা ভাংচুর ও লুটপাটে জড়িত, তাদের বিচার হবে। গোয়েন্দা সংস্থার তদন্ত চলছে। লুটের মাল কোথায় আছে, তা ছাত্রদেরই বের করে দিতে হবে।

প্রশ্নোত্তর পর্বে সরকারদলীয় সংসদ সদস্য জাহাঙ্গীর কবির নানকের সম্পূরক প্রশ্নের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, কোটা নিয়ে যখন এতকিছু, তখন কোটাই থাকবে না। কোনো কোটার দরকার নেই। তিনি বলেন, কোটা থাকলেই সংস্কারের প্রশ্ন আসবে। এখন সংস্কার করলে আগামীতে আরেক দল আবার সংস্কারের কথা বলবে। তখন আবারও মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হবে। কোটা থাকলেই ঝামেলা। সুতরাং কোটারই দরকার নেই। কোটা ব্যবস্থা বাদ, এটাই আমার পরিষ্কার কথা।

বুধবার সংসদে বক্তব্যে কোটা কেন রাখা হয়, সে বিষয়টি ব্যাখ্যা করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, অনগ্রসর জনগোষ্ঠী পিছিয়ে থাকা জনপদের মানুষদের তুলে আনতে এই কোটা ব্যবস্থা। কোটা তুলে দেয়ার কথা বলার পাশাপাশি তিনি সংস্কারের সুযোগ থাকার কথাও বলেন। ‘যদি দরকার হয় কেবিনেট সেক্রেটারি তো আছেনই।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, দেখে দুঃখ লাগে, ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া বন্ধ করে কোটার সংস্কার চেয়ে আন্দোলনে নেমেছে। রোদের তাপে পুড়ে ওরা তো অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। তাদের অবরোধের কারণে মানুষ হাসপাতালে যেতে পারছে না। অফিস-আদালতে ঠিকভাবে যেতে পারছে না। সবাইকেই দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।

সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা ব্যবস্থার সংস্কারের দাবিতে ঢাবিসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে টানা চার দিন ধরে আন্দোলন চলছে। প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে সুনির্দিষ্ট ঘোষণা না আসা পর্যন্ত কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিল আন্দোলনকারীরা। পর্যায়ক্রমে সারা দেশে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ‘ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদ’ কোটার পরিমাণ ১০ শতাংশে কমিয়ে আনার দাবি তুলেছে। তারা কোটায় প্রার্থী পাওয়া না গেল মেধা তালিকা থেকে তা পূরণের দাবিও জানায়।

সংসদে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের পর আন্দোলনকারীদের প্ল্যাটফর্ম ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের যুগ্ম আহ্বায়ক নুরুল হক নূর বলেন, তারা রাতে বসে এই বক্তব্য বিশ্লেষণ করে বৃহস্পতিবার সিদ্ধান্ত জানাবেন।

বুধবার সকাল ১০টায় গণভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে কোটা সংস্কার আন্দোলন প্রসঙ্গে কথা বলতে যান কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের সভাপতি সাইফুর রহমান সোহাগ ও সাধারণ সম্পাদক এসএম জাকির হোসাইন। সেখান থেকে ফিরে দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে তারা বলেন, আমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছি। সাক্ষাতের সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সরকারি চাকরিতে কোনো কোটা থাকবে না।’

এদিকে দুপুরে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের সাংবাদিকদের বলেন, ‘আজ সংসদে প্রধানমন্ত্রীর প্রশ্নোত্তর পর্ব আছে। সেখানে এই কোটা প্রসঙ্গ চলে আসতে পারে। সেখানে দেখুন প্রধানমন্ত্রী কী বলেন। এরপর থেকে সবার দৃষ্টি ছিল সংসদের দিকে। সেখানে প্রধানমন্ত্রী এ প্রসঙ্গে কি বলেন তা জানার অপেক্ষায় ছিলেন অনেকেই।

সংসদে প্রশ্নের জবাবের শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, একটি দেশ তখন উন্নত হয় যখন একটি শিক্ষিত সমাজ গড়ে ওঠে। শিক্ষিত সমাজের কর্মক্ষেত্র প্রসারিত করতে আমরা সে ধরনের পদক্ষেপ নিয়েছি। আমাদের সরকারের আমলে ছেলেমেয়েরা লেখাপড়ার সুযোগ পাচ্ছে, বৃত্তি পাচ্ছে, বিনা পয়সায় বই পাচ্ছে। আমাদের ছেলেমেয়েরা লেখাপড়া করবে, মানুষের মতো মানুষ হবে, তারা দেশ পরিচালনা করবে। তিনি বলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ আমিই তৈরি করে দিয়েছি, এখন সবাই ফেসবুক, ইন্টারনেট ব্যবহারের সুযোগ পাচ্ছে। আধুনিক প্রযুক্তির শিক্ষাব্যবস্থা আমিই চালু করেছি। এখন সেগুলো ব্যবহার করে গুজব ছড়ানো হল, এক ছেলে মারা গেছে। রাত একটার সময় হলের গেট ভেঙে রাস্তায় নেমে এলো ছেলেমেয়েরা। পরে ওই ছেলে যখন নিজেই ফেসবুকে জানিয়ে দিল আমি মারা যাইনি তখন তাদের মুখটা কোথায় গেল?’ প্রশ্ন রেখে এ সময় প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘এরপর শুরু হয় যত অঘটন, ভাংচুর, লুটপাট; এর দায় কে নেবে।’ তিনি বলেন, ‘ভিসির বাড়িতে আক্রমণ হল, আমরাও তো আন্দোলন করেছি। আমরা তো কখনও এমনটি করিনি। ভিসির বাড়িতে ভাংচুরের দৃশ্য দেখে পাকিস্তানি বাহিনী আমাদের ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে যেভাবে ভাংচুর লুটপাট করেছিল তা মনে করিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, হামলাকারীদের ভয়ে ভিসির ছেলেমেয়ে লুকিয়ে ছিল। একতলা-দোতলা ভবন তছনছ করা হল। পরে সিসি ক্যামেরা নিয়ে চলে গেল আমি এ ঘটনার তীব্র নিন্দা জানাই। যারা ঘটিয়েছে তারা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র বলে আমি মনে করি না।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘ছাত্ররা দাবি করেছে, আমিও বসে থাকিনি। আমাদের মন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদেরকে পাঠিয়েছি। তিনি ছাত্রদের সঙ্গে বসেছেন। আমি কেবিনেট সেক্রেটারিকে নির্দেশ দিয়েছি পরীক্ষা-নিরীক্ষা করতে। মন্ত্রী তাদের সঙ্গে বসল, একটা সমঝোতা হল। অনেকে মেনে নিল কিন্তু অনেকে মানল না। টিএসসিতে অনেকে থেকে গেল, কেন? তিনি বলেন, ‘যখন আলোচনা হয়েছে, কথা হয়েছে তাহলে কেন চারুকলায় মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজন পুড়িয়ে তছনছ করা হল। আর মেয়েরাও হল থেকে বেরিয়ে এলো, আমি সারারাত ঘুমাতে পারিনি। নানককে পাঠালাম, আলোচনা করল, তাদের ফিরে যাওয়ার কথা বলা হল কিন্তু তারা মানল না, আন্দোলন চালিয়ে গেল।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা একটা নীতি নিয়ে রাষ্ট্র পরিচালনা করি। যারা আন্দোলনে নেমেছে তারা আমার নাতির বয়সী, তাদের কিসে ভালো হয় তা আমরা ভালো জানি।’ তিনি বলেন, ‘১৯৭২ সাল থেকে কোটা ব্যবস্থা চলছে। ৩৩তম বিসিএসে মেধার ভিত্তিতে নিয়োগ হয়েছে ৭৭.৪০ ভাগ শিক্ষার্থীর আর ৩৫তম বিসিএসে মেধার ভিত্তিতে ৬৭.৪৯ শতাংশ শিক্ষার্থীর নিয়োগ দেয়া হয়েছে। মেধাবীরা কিন্তু বাদ যায়নি। যেখানে কোটা পাওয়া যাবে না, সেখানে মেধা তালিকা থেকে দেয়া হবে। এটা কিন্তু চলছে, জানি না ছাত্ররা এটা জানে কিনা।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমি জানি, ছাত্ররা মেধাবী, তাদের লিখিত পরীক্ষায় পাস করে এ পর্যায়ে আসতে হয়। তাদের দাবিতে বলা আছে, কোটায় পাওয়া না গেলে মেধা তালিকা থেকে নিয়োগ হবে। আমরা মেধা তালিকা থেকে তো নিয়োগ দিচ্ছি। আর এ নিয়ে ঢাবির কিছু প্রফেসরও তাল মিলিয়েছে। আন্দোলনকারী এবং তাদের সমর্থনকারী বিভিন্ন শিক্ষকের ‘অজ্ঞতার’ বিষয়টি তুলে তিনি বলেন, ‘তাদের যে দাবিনামা, সেটাও স্পষ্ট নয়। তারা কি এটাও জানে না, কোটায় না পাওয়া গেলে মেধা তালিকা থেকে নেয়া হয়। এটা তো নেয়া হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘সকালে ছাত্রলীগের প্রেসিডেন্ট-সেক্রেটারি আমার কাছে আসে। তারা বলে, আমরা ঘুমাতে পারছি না, ছাত্ররা রোদে বসে আছে, তাদের তো অসুখ-বিসুখ হবে। রাস্তা অবরোধের কারণে কেউ অফিস-আদালতে যেতে পারছে না, রোগীরা হাসপাতালে যেতে পারছে না, এভাবে তো চলতে পারে না। এমনিতেই যানজট, তার ওপর রাস্তা অবরোধ করে রাখলে মানুষের দুর্ভোগ আরও বাড়বে।’

এ সময় শেখ হাসিনা বলেন, ‘কোটা নিয়ে যখন এত কথা, এত প্রশ্ন- তাহলে কোটাই থাকবে না, কোটার দরকার নেই, বিসিএস যে পদ্ধতিতে হয় সেভাবেই হবে। কেউ যাতে বঞ্চিত না হয় সে ব্যবস্থা তো আমাদের আছে।’ তিনি বলেন, ‘ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীরা চাকরি পেত না, আগে নারীদের জজ হওয়ার সুযোগ ছিল না। পাকিস্তান আমলে নারীরা জজ হিসেবে তো আদালতে ঢুকতে পারত না। নারীদের চাকরিতে ১০ ভাগ কোটার ব্যবস্থা করা হয়। কিন্তু এখন মেয়েরাও রাস্তায়। তার মানে তারাও কোটা চায় না।’ তিনি বলেন, ‘আমি তো খুশি, আমি নারীর ক্ষমতায়নে সবচেয়ে বেশি কাজ করেছি, মেয়েরা যখন চায় না তা হলে কোটার দরকার নেই’- যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী। তিনি আরও বলেন, ‘ঢাবির ভিসির ভবন যারা ভাংচুর করেছে, লুটপাট করেছে, ছাত্রদেরই সেগুলো খুঁজে বের করে দিতে হবে। আমরা গোয়েন্দা সংস্থা নামিয়েছি তারা খুঁজে বের করবে।’

প্রসঙ্গত, বাংলাদেশে উত্তরাধিকার সূত্রেই কোটা পদ্ধতি চালু হয়। ব্রিটিশ আমলে ভারতীয় সিভিল সার্ভিসে ব্রিটিশদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকতে না পারায় ভারতীয়দের জন্য কোটা সংরক্ষণ করা হয়। পরে সংখ্যালঘু মুসলমানদের জন্যও রাখা হয় কিছু কোটা। পাকিস্তান আমলে পিছিয়ে পড়া পূর্ব পাকিস্তানের (বর্তমানে বাংলাদেশ) দাবির মুখে কেন্দ্রীয় সুপিরিয়র সার্ভিসগুলোর কয়েকটিতে প্রদেশভিত্তিক কিছু কোটা চালু করা হয়। ১৯৭২ সালের ৫ সেপ্টেম্বর তৎকালীন সংস্থাপন (বর্তমানে জনপ্রশাসন) সচিব এমএম জামানের স্বাক্ষরে এক নির্বাহী আদেশে কোটা পদ্ধতি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ পায়। ওই আদেশে সরকারি চাকরিতে মাত্র ২০ ভাগ ছিল মেধা কোটা, ৪০ ভাগ জেলা কোটা, ৩০ ভাগ মুক্তিযোদ্ধা কোটা আর ১০ ভাগ ছিল যুদ্ধবিধ্বস্ত নারী কোটা। ১৯৭৬ সালে এই কোটা ব্যবস্থার পরিবর্তন করে মেধা কোটায় বরাদ্দ হয় ৪০ ভাগ, জেলা কোটায় ২০ ভাগ। মুক্তিযোদ্ধা কোটায় আগের মতোই ৩০ ভাগ রাখা হয়। ১৯৭৭ সালে তৎকালীন পে-সার্ভিস কমিশনের সদস্য এমএম জামান ছাড়া বাকি সবাই সরকারি নিয়োগে কোটা ব্যবস্থার বিরোধিতা করেন। তখন কোটার পক্ষে অবস্থান নেয়া ওই সদস্য প্রচলিত কোটাগুলো প্রথম ১০ বছর বহাল রেখে ১৯৮৭ সাল থেকে পরবর্তী ১০ বছরে ধীরে ধীরে কমিয়ে দশম বছরে তা বিলুপ্ত করার পক্ষে মত দেন। ১৯৮৫ সালে এ ব্যবস্থা আবারও বদলানো হয়। প্রথম ও দ্বিতীয় শ্রেণীর সরকারি চাকরিতে মেধার ভিত্তিতে ৪৫ ভাগ, মুক্তিযোদ্ধা কোটায় ৩০ ভাগ, নারীদের জন্য ১০ ভাগ এবং প্রথমবারের মতো উপজাতি ও ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর জন্য ৫ ভাগ পদ বরাদ্দের সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৭ সালে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের এর আওতাভুক্ত করা হয়। এরপর ২০১১ সালে প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ ভাগ কোটা বরাদ্দ রাখা হয়।

বর্তমানে সরকারি চাকরিতে নিয়োগে ৫৬ শতাংশ পদ বিভিন্ন কোটার জন্য সংরক্ষিত; এর মধ্যে মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের জন্য ৩০ শতাংশ, নারী ১০ শতাংশ, জেলা ১০ শতাংশ, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী ৫ শতাংশ, প্রতিবন্ধী ১ শতাংশ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here