খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র ও প্রশাসনের সাথে বিরোধের জের ধরে সোমবার রাতে বহিরাগত যুবলীগ, ছাত্রলীগ, পুলিশ ও সাধারণ ছাত্রদের সাথে দফায় দফায় ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। প্রায় ৫ ঘন্টাব্যাপী এ সংঘর্ষ চলাকালে গোটা ক্যাম্পাস রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। এসময় পুলিশ, শিক্ষকসহ প্রায় ২৫ জন আহত হয়েছে। এদের মধ্যে আশংকাজনক অবস্থায় ৮ ছাত্রকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনে আনতে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করে সন্ধ্যা ছয়টার মধ্যে সকল ছাত্র/ছাত্রীকে হল ত্যাগের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। বার্ষিক ভোজসভায় নিম্নমানের খাবার পরিবেশনকে কেন্দ্র করে এ সংঘর্ষ হয়েছে বলে জানা গেছে। বর্তমানে ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন রয়েছে।

পুলিশ ও ছাত্ররা ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কমকে জানায়, নগরীর খানজাহান আলী থানার ফুলবাড়ী গেটে অবস্থিত খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (কুয়েট) ৩১ডিসেম্বর ও ১জানুয়ারী অমর একুশে হলে বার্ষিক প্রীতি ভোজের আয়োজন করা হয়। প্রীতিভোজের জন্য মোট সাড়ে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। সেখানে শিক্ষার্থীদের জন্য তিনবেলার খাবারের ব্যবস্থা রাখা হয়। প্রথম দিন থেকেই খাবারের মান ছিল নিম্নমানের। ছাত্ররা জানায়, মাথাপিছু ৮শ’ ৮৬ টাকা বরাদ্দ করলেও খাবারের মান অনুযায়ী তার বরাদ্দ হয় তিন থেকে চারশ’ টাকা। এ খাবার প্রস্তুত ও সরবরাহের দায়িত্বে ছিল ছাত্রলীগ নেতা মুন্না, আবির, কাজল, হিমু, জুবায়ের, সুমন, মুকুল, নীহার, নয়ন, সোহান ও ওয়ারিনসহ ১৫সদস্যের একটি টিম। গত রোববার রাতে শিক্ষার্থীদের সাথে খাবারের মান নিয়ে ছাত্রলীগের নেতাদের সাথে কথা কাটাকাটি হয়। এক পর্যায়ে উত্তপ্ত বাক্য বিনিময় এবং হাসান নামের এক ছাত্রের মাথায় সেভেন আপের বোতল দিয়ে আঘাত করে। এতে তার মাথা ফেটে যায়। রাতে খাবার অবশিষ্ট থাকায় গতকাল সোমবার দুপুরে হলে থাকা ছাত্রদের খাবারের ব্যবস্থার জন্য মোবাইল করে ডেকে আনা হয়। ছাত্ররা খাওয়া দাওয়ার শেষ পর্যায়ে এসে ছাত্রলীগের ওই সব নেতারা বলে ‘তোদের কত খাওয়া লাগে আজ খেয়ে নে’। এর কিছুক্ষন পর ফুলবাড়িগেটসহ আশপাশের এলাকা থেকে যুবলীগ ও ছাত্রলীগের বহিরাগত ক্যাডাররা রামদা, চাপাতি, লোহার রড ও লাঠিসোঠা নিয়ে ক্যাম্পাসে আসে এবং ছাত্রদের ওপর হামলা করে। হামলায় রাসেল, মঞ্জু, সুজাত, রাসেল লেনিন, শুভ, আলাউদ্দিন, কমল, সেতু, শাহাদত, শুভসহ ১৮ জন আহত হয়। এদেরকে খুলনা মেডিকেল কলেজে ভর্তি করা হয়েছে। বাকীদের বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। এসময় শিক্ষকরা এগিয়ে আসলে বহিরাগতরা তাদের উপরও হামলা চালায়। এতে ছাত্রকল্যান পরিচালক প্রফেসর শিবেন্দ্র শেখর সিকদার, ইলেকট্রিক্যালের শিক্ষক ড. রফিকুল ইসলাম ও ইলিয়াস ইনাম কোয়েল, ম্যাকানিক্যালের শিক্ষক ড. মোঃ মাসুদ ও আব্দুর নুর তুষার আহত হন। বিকেল চারটার দিকে ছাত্রলীগের সাথে পুলিশ এক হয়ে সাধারণ ছাত্রদের ওপরে চড়াও হলে উভয় পক্ষের মধ্যে আবারও ধাওয়া পাল্টা ধাওয়া শুরু হয়। এসময় বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি প্রফেসর ড. আলমগীর হোসেনের বাসভবন, গার্ড রুম, ভিসির গাড়ি (ঢাকা মেট্রো গ ১৩-২৮০০), কুয়েটের গাড়ি (খুলনা মেট্রো ঘ ১১-০০৯৫) ভাংচুর করে। ভিসির বাসভবন ভাংচুর করার সময় ভিসির স্ত্রী মেহেরুন নেসা লতা ও তার একমাত্র ৫ বছরের শিশু পুত্র অনয় আহত হয়। তাদেরকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়ের সূত্র জানায়, গত ৩১ ডিসেম্বর ও ১ জানুয়ারী অমর একুশে হলে বার্ষিক প্রীতিভোজের আয়োজন করা হয়। সাড়ে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দর পরও নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হলে সাধারন ছাত্ররা প্রতিবাদ করে ডাইনিং হল ভাংচুর করে। হলের দায়িত্বে থাকা  ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ সাধারন ছাত্রদের উপর ক্ষিপ্ত হয় এবং তাদের হলের মধ্যে আটকিয়ে রাখে। রাতেই পুলিশ ক্যাম্পাসে অবস্থান নিলেও কোন এ্যাকশনে না যাওয়ায় এত বড় ঘটনা ঘটেছে। সূত্র জানায়, ঘটনার সময় দায়ের কোপ এবং মারপিটে আহত আটজন ছাত্রকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। যার মধ্যে একজনের অবস্থা আশংকাজনক। এ ঘটনার পর উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করতে বিকেল ৪টার দিকে কুয়েট কর্তৃপক্ষ বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষণা করে। একই সাথে সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সকল শিক্ষার্থীকে হল ত্যাগ করার নির্দেশ দেয়। এই নির্দেশ পাওয়ার পর বিকাল থেকেই শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাস ত্যাগ করতে শুরু করে। তবে সন্ধ্যা সাড়ে ৫টা পর্যন্ত অনেক ছাত্রকে ইট পাটকেল ও লাঠিসোঠা নিয়ে বিভিন্ন ছাত্রহলের ছাদে অবস্থান করছিল। কুয়েটের উপাচার্য প্রফেসর ড. মোঃ আলমগীর হোসেন জানান, কতিপয় ছাত্র উদ্দেশ্যমূলকভাবে একুশে হলের ডাইনিং রুমে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হয়েছে এই অজুহাতে গোলযোগের সৃষ্টি করে। তারই জের ধরে সোমবার ক্যাম্পাসে সন্ত্রাসী কর্মকান্ড ঘটেছে। এই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রনের বাইরে চলে যাওয়ার আশংকায় কুয়েট অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা ছাড়া কোন উপায় ছিল না। খানজাহান আলী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা মোঃ হুমায়ূন কবীর জানান, দুপুর একটার দিকে কুয়েটে শিক্ষার্থীদের প্রশাসনের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়। এতে বেশ কয়েকজনজন আহত হয়েছেন। আহতদের হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তিনি জানান, ঘটনার সময় ডিসি নর্থ মোস্তফা কামাল ইটের আঘাতে আহত হয়েছে। তাকে প্রাথমিক চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। এ ঘটনার পর বিশ্ববিদ্যালয়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়েছে। ক্যাম্পাসে উত্তেজনা ও থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (কুয়েট) অনিদিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হয়েছে। কুয়েট ছাত্রলীগের বেপরোয়া আচরণ, ছাত্র বিরোধ, সাধারণ ছাত্রদের অবরম্নদ্ধ করে রাখা, ছাত্র সংঘর্ষ ও ভাঙচুরের প্রেক্ষিতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে সিন্ডিকেট জরুরী সভা ডেকে গতকাল সোমবার দুপুরে এ সিদ্ধানত্ম ঘোষনা করে। সিদ্ধানত্ম অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সকল ছাত্র/ছাত্রী হল ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। তবে ক্যম্পাস বন্ধ ঘোষনা করায় সাধারন ছাত্ররা বিক্ষোভ করে উপাচার্ষের বাংলো ভাংচুর করেছে। এর আগে রবিবার রাত থেকে সোমবার সন্ধ্যা পর্যন্ত ছাত্রলীগের দফায় দফায় হামলায় শিড়্গক সমিতির সভাপতি ড. মো. আরিফ, ডেপুটি কমিশনার (ডিসি নর্থ) মোস্তফা কামালসহ ৩০ ছাত্র আহত হয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন সূত্র হতে জানা গেছে, রবিবার রাতে কুয়েটের অমর একুশে হলে বার্ষিক প্রীতিভোজ ছিল। প্রীতিভোজের জন্য কর্তৃপড়্গ সাড়ে ৮ লাখ টাকা বরাদ্দ করে। কিন্তু বার্ষিক ভোজে নিম্নমানের খাবার পরিবেশন করা হলে সাধারন ছাত্ররা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে এবং এর প্রতিবাদ করে ডাইনিং রুমে ভাংচুর চালায়। এ ঘটনায় হলের ছাত্রলীগ নেতারা সাধারন ছাত্রদের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। তারা সাধারণ ছাত্রদের কয়েকজনকে মারপিট করে এবং আটকিয়ে রাখে। রাত ভর সাধারণ ছাত্রদের সাথে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের সংঘর্ষ ও ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। রাতেই পুলিশ ক্যাম্পাসে অবস্থান নিলেও কোন এ্যাকশনে যায়নি।  সোমবার দুপুরে বহিরাগত ক্যাডারদের সাথে নিয়ে ছাত্রলীগ নেতৃবৃন্দ আবারো অমর একুশে হলে হামলা চালায়। এই সময় দায়ের কোপ এবং বেধড়ক মারপিটে কমপড়্গে ৩০জন ছাত্র আহত হয়। তাদের মধ্যে ৮জন ছাত্রকে খুলনা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং অন্যান্যদের বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। আহতদের মধ্যে দুইজনের অবস্থা আশংকাজনক বলে জানা গেছে। বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন উদভুত পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে সোমবার দুপুরে সিন্ডিকেট জরুরী সভা আহবান করা হয়। সভা শেষে বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষনা করা হয়। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী সন্ধ্যা ৬টার মধ্যে সকল ছাত্র-ছাত্রীকে হল ত্যাগ করতে বলা হয়। তবে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ ঘোষনার প্রতিবাদ জানিয়ে ক্যাম্পাসে মিছিল বের করে সাধারন ছাত্ররা। মিছিলটি উপাচার্ষের বাংলোতে গিয়ে ভাংচুর চালায়। এ ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা সন্ধ্যায় বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. মো. আরিফ এর অপর হামলা চালায়। মাথাসহ কানে গুরুতর ও রক্তাক্ত জখম অবস্থায় তাকে স্থানীয় পেশেন্ট ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। খুলনা মেডিকেল কলেজ সূত্র জানিয়েছে, উপাচার্যের বাংলোতে হামলার ঘটনায় সাধারণ ছাত্রদের বিরুদ্ধে থানায় মামলা দায়ের করা হচ্ছে জানতে পেরে সোমবার রাতেই হাসপাতাল ছেড়ে পালিয়েছে ভর্তিকৃত আহত ছাত্ররা। তাদের কয়েকজনকে খুলনা মহানগরীর বিভিন্ন ক্লিনিকে ভর্তি করা হয়েছে। বাকিরা রাতেই জেলার বাইরে চলে গেছে বলে জানা গেছে।

এদিকে, সোমবার রাত সাড়ে ১০টার দিকে কমিশনারসহ খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের উর্দ্ধতন কর্মকর্তারা কুয়েট পরিস্থিতি পরিদর্শন করেছেন। এ সময় ক্যাম্পাসের আইন-শৃংখলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হওয়ার কারণ দেখিয়ে খানজাহান আলী থানার ওসি হুমায়ুন কবিরকে প্রত্যাহার করে নেয়া হয়েছে বলে জোর গুজব ওঠে। কিন্তু বারবার চেষ্টা করলেও পুলিশ কমিশনার বা থানার ওসি মোবাইল ফোন রিসিভ না করায় এর সত্যতা নিশ্চিত করা যায়নি। ক্যাম্পাসে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা রয়েছে।

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/শিমুল খান/খুলনা

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here