শাহরিয়ার মিল্টন, শেরপুর প্রতিনিধি: “মরবার আগে আমার স্বামী ও পুলারে যারা মারছে সেই তাগোরে ফাঁসি দেইখ্যা মরবার বড় আশা মনে আছিল। আইজ কামরুজ্জামানের ফাঁসির সাজার কতা হুইন্না বুহের ভিতর থাইক্কা একটা চাপা দেওয়া পাত্তর হইরা (সরে) গেলো।” কাঁদতে কাঁদতে কথাগুলো বলেন সোহাগপুর গণহত্যায় শহীদ খেজুর আলীর স্ত্রী জরিতন বেওয়া। একাত্তরে তার স্বামী, সন্তান-স্বজনসহ পরিবারের ৮ সদস্যকে গুলি করে হত্যা করা হয়।
তিনি বলেন, “আমার স্বামীরে ঘর থেইক্যা টাইন্যা লইয়্যা আইয়্যা উঠানে ফালাইয়্যা পরথমে ছয়ডা গুলি করে। গুলি খাইয়্যা পানি চাইলে আরেকটা গুলি করে। ওই গুলিতে উডানেই তার জীবন যায়। পরে আমার সোনা মানিক বুকের ধন হাশেমরে ধইর্যা নিয়্যা বাপের লাশের উফরে ফালাইয়্যা গুলি করে। এরপর আমার দেওররে ধইর্যা নিয়্যা বন্দুকের নল দিয়্যা কেচাইতে থাহে, পরে মুহের ভিতরে বন্দুক দিয়্যা গুলি করে। তহনি তার পরান বাইরইয়্যা যায়।”
আজ ৩ নভেম্বর সোমবার সকালে মুক্তিযুদ্ধাকালীন মানবতা বিরোধী অপরাধে মৃত্যুদন্ডাদেশ পাওয়া জামায়াতের সহকারি সেক্রেটারী জেনারেল ও শেরপুরের আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগে দায়ের করা আপিলের রায়ে মৃত্যুদন্ডাদেশ বহাল থাকায় শত কষ্টের মাঝেও নালিতাবাড়ী উপজেলার সোহাগপুর গ্রামের বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের বিধবা ও শহীদ স্বজনদের চোখে এখন আনন্দাশ্রু বইছে।
শহীদ ফজর আলীর স্ত্রী জবেদা বেওয়া বলেন, “যারা আংগর বেডাইনরে (পুরুষ মানুষ) মারছে, ওগর নেতা কামরুজ্জামানের ফাঁসির সাজা অইছে, হুইন্না আংগর কইলজাডা তাও ইট্টু জুড়াইছে।”
সেদিনের সেই হৃদয়বিদারক হত্যাকাণ্ডের কথা জানতে চাইলে বুক চাপড়াতে চাপড়াতে কান্নায় ভেঙে পড়েন শহীদ জসিমুদ্দিনের স্ত্রী বিধবা নুরে মান বেওয়া, বিধবা সমলা বেওয়া ও করফুলি বেওয়া। তারা বলেন, “পাক বাহিনীরাতো আর আমগর এলাকা চিনতো না।
রেজাকার-আলবদররাইতো তাগরে পথ দেহাইয়া এই গেরামে মুক্তি আছে কইয়া আনছে, ম্যাছাকার করছে। আমগরে বিদুফা (বিধবা) করছে, স্বামী-সন্তান হারা করছে। কামরুজ্জামান আছিল ওগরে নিডার (নেতা)। অহন অক্তের (রক্তের) বদলে কামরুজ্জামানের অক্ত (রক্ত) নেওয়ার ফাঁসির সাজা অইছে, আমরা খুশি অইছি।”
তবে শহীদ ছফির উদ্দিনের দুই ছেলে জালাল উদ্দিন ও আলাল উদ্দিন বলেন, “কামরুজ্জামানের ফাঁসির রায়ে আমরা খুশি। বিধবাপল্লীর শহীদ পরিবারের স্বজনরা সবাই খুশি। তবে আমরা এহন কিছুডা ডরের (আতঙ্কের) মধ্যে আছি। কামরুজ্জামানের পক্ষের লোকেরা নানাভাবে আমাদেরকে শায়েস্তা করা হবে, ক্ষমতা পরিবর্তন হলে দেখে নেওয়া হবে বলে নানাভাবে হুমকি ছড়িয়ে আসছে।”
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই বর্বর পাকিস্তানি বাহিনী গণহত্যা চালায় জেলা শহর শেরপুর থেকে ৩৬ কি. মি. দূরে নালিতাবাড়ী উপজেলার সীমান-বর্তী কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রামে।
সেদিন পাক বাহিনী ও তাদের দোসর রাজাকার, আলবদরদের ৬ ঘণ্টার তাণ্ডবে ওই গ্রামের ১৮৭ জন পুরুষ শহীদ হন। এদিন ভোরে পাক বাহিনী সোহাগপুর গ্রামের ক্ষেতে-খামারে ও ঘরে ঘরে ঢুকে নির্মমভাবে হত্যা করে নিরীহ কৃষক, শ্রমিক ও মেহনতি মানুষদের। সেই থেকে গ্রামটির নাম পাল্টে হয়ে যায় ‘বিধবাপল্লী’। তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসংঘের নেতা আলবদর সংগঠক কামারুজ্জামানের নির্দেশে সোহাগপুর গ্রামে এ গণহত্যা সংগঠিত হয়।
শহীদ পরিবারের বিধবারা বলেন, “আলবদর কমান্ডার কামারুজ্জামানের নির্দেশে স’ানীয় রাজাকার কাদির ডাক্তারের নেতৃত্বে গ্রামের প্রফুল দিঘী থেকে সাধুর আশ্রম পর্যন- এলাকা ঘিরে ফেলে। এ সময় তারা গ্রামের ছেলে, বুড়ো, শিশু যাকে যেখানে পেয়েছে সেখানেই পাখির মতো গুলি করে হত্যা করে। অনেককেই বেয়নেট চার্জ করে হত্যা করে। মধ্যযুগীয় কায়দায় নরঘাতকের দল স্ত্রীর সামনে স্বামীকে, মায়ের সামনে সন্তানকে বাড়ির উঠোনে ফেলে ব্রাশফায়ার করে হত্যা করে। প্রায় ৬ ঘণ্টা তাণ্ডবের পর হায়েনার দল সোহাগপুর গ্রাম ত্যাগ করে চলে যায়। স্বজনদের লাশ দেখে শুরু হয় শোকের মাতম। তাদের গগণবিদারী চিৎকারে আকাশ বাতাস কেঁপে উঠে।
আবার হানাদার পাক বাহিনী আসবে বাড়িঘর জ্বালাতে- এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে প্রিয় স্বজনের লাশ কেউ কলপাতা, কেউ শাড়ি, গামছা, আবার অনেকেই ঘরের মশারি দিয়ে পেঁচিয়ে কোনোমতে গর্ত করে এক কবরে ৫-৭ জনকে মাটিচাপা দিয়ে গ্রাম ছেড়ে পালিয়ে যায়।
এক সময় দেশ স্বাধীন হয়। স্বামীহারা ওইসব পরিবারের শুরু হয় কঠিন জীবন সংগাম। পুরুষ শূন্য এ গ্রামটির নাম করন করা হয় ‘বিধবা পল্ল্লী’। বর্তমানে এ বিধবা পল্লীতেই কালের সাক্ষী হয়ে বেচেঁ আছেন ৩৪ জন বিধবা। এরা কেউ বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা এবং ট্রাষ্ট ব্যাংক ও ব্র্যাকের যৎসামান্য মাসিক ভাতার ওপর নির্ভর করে কোনোমতে দিনাতিপাত করছেন। তারা কামারুজ্জামানের পাশাপাশি স্থানীয় রাজাকারদেরও বিচার ও শাসি-র দাবি জানিয়েছেন।