Kabi Farid Ahmed Dulal1

আত্মস্খলনের দায় : ২
– ফরিদ আহমদ দুলাল

চিকিৎসকের কসাই হবার কাহিনি না-ই বা বললাম, শিক্ষকের পাঠবিপনী খোলার গল্প না-ই শোনালাম, রাজনীতিকের দস্যুতার ইতিহাস-ব্যবসায়ীচক্রের লুণ্ঠন-সাংবাদিক সাংঘাতিক হবার ভয়াবহতা-আইনজীবীদের অনৈতিকতার কথা থাকুক অনুচ্চারিত; কিন্তু যেখানে আমার শ্রম-ঘাম যেখানে খনন অবিরাম, যেখানে আমার প্রেম নিবেদন; যার স্বপ্ন ছুঁয়ে নিদ্রা-জাগরণ, যার সৃষ্টিতে বিভোর-যার জন্যে বাঁচনমরণ; যার সাথে নিত্য বসবাস; তার বেদনার কথা বঞ্চনার কথা কে আমার আগে উচ্চারণ করে, কেনই করবে?
আমাদের স্খলনগুলোকে উন্মোচন করে দিতে চাই। মুখোশগুলো খুলে নিতে চাই। আমাদের প্রতারণা, ভণ্ডামীগুলো জনসমক্ষে তুলে ধরা চাই; আমাদের আত্মপ্রবঞ্চনাগুলো চিহ্নিত করতে চাই। জনসমক্ষে না হোক নিজের আয়নাতে যদি দেখে নিতে পারি নিজের কদর্য অবয়ব ক্ষতি নেই। আর্শিতে তাকিয়ে যদি পড়ে নিতে পারি প্রতারণার কৌশল কত আছে গোপন প্রকোষ্ঠে রাখা; শ্মশ্রুধারী সুবেশ নামাজি হয়ে এক একজন কতটা অশ্লিল সেই কথাটিই উচ্চারণ করতে চাই অকপট; হয়তো আমি এবং আমরা অনেকেই সত্যের আলোয় প্রকাশিত হয়ে যাবো জনসমক্ষে। আমাদের গোপন কথারা থলে থেকে বেরিয়ে প্রকাশ্য হবে! হয়তো আমাদের দাঁতের গোপন ফাঁকে যে হারাম মাংশ কিছুটা লুকিয়ে আছে, তাও জানা হয়ে যাবে; নতুন প্রজন্ম জানুক কতটা নড়বড়ে তার আশ্রয়-আবাস। সমকাল জেনে যাক সাম্প্রদায়িকতা-গুম-নৈরাজ্য-সন্ত্রাস-দুঃশাসন-অনাচার-গুপ্তাঘাত-অনৈতিক যৌনাচার-বোমাবাজি আর ধর্ষণের মতো বড় ভিন্ন পাপাচার প্রতারণা এবং স্খলনের অপরাধ।
কবি প্রধানত নিজের আনন্দে লিখেন শুনেছি, অন্যকেও সে-আনন্দে ভাগ দিতে চান, যুক্ত করে নিতে চান জনপদ, কবিতাকে তাই নৈর্ব্যক্তিক করায় তৎপর কবি। সবাইকে যুক্ত করবার আকাঙ্ক্ষা থেকেই প্রকাশনা, ছোটকাগজ-পত্রিকা থেকে গ্রন্থ–প্রকাশক। একদিকে কবির আকুতি, অন্যদিকে প্রকাশকের বাণিজ্যচিন্তা; একদিকে বিপণন এবং মুনাফা, অন্যদিকে কবি-পাঠকের চিন্তার উচ্চতা; প্রকাশকের পসার আর কবির পাঠক স্পর্শাকুতি! হায় বিষয়বিমুখ বোকা কবি হায় বিশ্বব্যাপী বাজার প্রসার!
আমাদের প্রকাশনাশিল্প যখন বেপথুমান-প্রশ্নবিদ্ধ, যখন প্রতারণার বাণিজ্যলেভেল আঁটা, সে বিষয়ে প্রতিবাদী হয়ে কেউ কেউ দরিদ্র লেখককুলে রীতিমতো হিরো, তাদেরই ভিন্নরূপ দেখি পর্দার আড়ালে! নিজেই সে খুলেছে কৌশলী প্রকাশবাণিজ্য-মেলা, নিজেই সে তসরুপে তৎপর! হা-ঈশ্বর! হা-ঈশ্বর! কোথায় কবিরা পায় সৎ কবিসংঘ, ‘যে-ই যায় লঙ্কা সে-ই হয় রাবণ-রাক্ষস।’ অবশ্য আমরা কেউ কেউ শিখেছি কৌশল শিখেছি কায়দাকানুন সংঘের ভাঙিয়ে নাম বরাদ্দ নিয়েছি আবাসিক সুরক্ষা অঞ্চল! কাগুজে সংঘের নামে চলে চাঁদাবাজি, ফুসলিয়ে-পটলিয়ে খায় চা-সিঙারা স্বতন্ত্র প্রাঙ্গণে। এখানেও লোকপ্রবাদের সূক্ষ্ম বাস্তবায়ন দেখেছে বিশ্ব ‘ঘোলাজলে মাছ ধরা’ চলে অবিরাম। আর প্রকাশক স্বচ্ছ জলে ছিপ ফেলে মাছ ধরে রুই-কাৎলা-মৃগেল-মাগুর-পুঁটি। শিকারের জন্য তারা ব্যবহার করে মনোলোভা টোপ। বাণিজ্যের প্রয়োজনে তারা যা-খুশি করুক দোষ নেই! শিকার ধরতে শিকারীকে কৌশল নিতেই হয়। মাছ ধরার প্রস্তুতিপর্বে নিকারী যেমন চারা করে; কিন্তু ডিজিটাল বিশ্বের কবিরা কেন ছলনায় ভোলে, কেনো আজো উগারের ধান-সরিষা-কলাই-মরিচ বাজারে বেচে-জমি বেচে, সঞ্চয়ের খুঁটি কেটে টাকা তুলে দেয় প্রকাশক-বণিকের হাতে! এইসব অনাচার থেকে মুক্তি চায় কবিরা সবাই। কাব্য-মোড়লেরাও দেখেছি প্রায়স সোচ্চার।
আমাদের ম্যাগা কবিরা, যাদের প্রকরণে অগাধ পাণ্ডিত্য তারাই কাব্যমোড়ল। তারা বাণিজ্যমনষ্ক হয়ে খোলে প্রকাশনার দপ্তর, নিপুন বিপনী। সেঁটে দিচ্ছে মোড়ে মোড়ে বাহারী পোস্টার! নবীন কবিরা কাঁচা হাতের আনাড়ি লেখা নিয়ে পৌঁছে যায় বাবার খানকায়, বাবা তার নামমোহর খোদাই করে দিচ্ছে প্রচ্ছদের ফ্ল্যাপে। ঘরে ঘরে পৌঁছে যায় বাণিজ্যসাম্পান। ‘এই দেশ মৎস্যভোগীর এখানে সারাবছর মাছ ধরা চলে/ যদি বিনোদবিহারী চলে যায় কাতলের লাশ হাতে/ শের মামুদ সেখানে এসে ছিপ ফেলে বসে’! আমাদের লোকপ্রবাদে জেনেছি, ‘কিল খাইয়া যাই দাদার ঘর, দাদা কিলায় বেইলের আড়াই প’র’! সাধারণ কবিতাকর্মীর ভাগ্য বদলায় না, প্রকাশকের লালসা থেকে মুক্তি পায় আটকে যায় দুর্বৃত্ত কবির জালে। সে মহান কবি আমাদের নাগরিক কবিসংঘেরই কেউ–কেউকেটা মড়ল কবি একজন, একজন থেকে বহু!

 

(চলবে……)

 

লেখকের ই-মেইলঃ swatantro@yahoo.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here