হুমায়ূন আহমেদ?

আরিফ চৌধুরী শুভ :: প্রতিটি ভোরে সূর্য ওঠে স্বপ্ন নিয়ে। প্রতিটি দিনে কিছু প্রাপ্তি যুক্ত হয় বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে। ১৯৪৮ সালের ১৩ নভেম্ভর ভোরে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে যে রক্তিম সূর্যটির উদয় হয়েছে, তার নাম হুমায়ূন আহমেদ। ডাকনাম কাজল। ময়মনসিংহ জেলার অন্তর্গত নেত্রকোণায় হুমায়ূন আহমেদের জন্ম। বাবা শহীদ পুলিশ কর্মকর্তা ফয়জুর রহমান আহমদ এবং মা আয়েশা ফয়েজের ৬ সন্তানের মধ্যে হুমায়ূন আহমেদ ছিলেন সবার বড়। আজ বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তীর ৭০তম জন্মদিন। শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ…।

জন্মদিনে বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তীকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছে তাঁর বক্তরা। হুমায়ূন আহমেদ সম্পূর্ন নিজের ভাষায় লিখেছেন তাঁর সব মৌলিক আশ্চার্য উপন্যাস, গল্প, ছোটগল্প। প্রতিটি বই ই যেন পাঠকের মনের ভাষায় নিখুঁত লেখায় এক একটি বাস্তবিক চরিত্র। পড়তে গিয়ে পাঠক ই যেন হয়ে ওঠেন এক একজন কল্পনার হুমায়ুন আহমেদ।

জীবন্ত প্রকৃতির মাঝে মঞ্চায়িত হয়েছে হুমায়ুন আহমেদের প্রতিটি নাটক ও চলচিত্র। তাঁর লেখা বদলে দিয়েছে সমাকালীন রূঢ়তা আর রুক্ষতার, সৃষ্টি করেছে নম্রতা আর ভদ্রতার। বাংলা সাহিত্যের সমকালীন ধারাকে এতদূরে নিয়ে আসতেই মনে হয় তার জন্ম হয়েছে বাংলা সাহিত্য ভাণ্ডারে। আমি সাহিত্যিক নই, কিন্তু তাঁর বইগুলো  আমাকে ভাবায়। আমি পরিচালক নই, কিন্তু তাঁর নির্মিত চলচিত্রগুলো আমাকে আন্দোলিত করে। আমি ভালোবাসার শৃঙ্খল বুঝি না, কিন্তু তাঁর হিমু চরিত্রটি আমার মতো শতশত তারুণ্যকে রুদ্ধদ্বারের বাহির করে ব্যতিক্রমী চরিত্রে। শঙ্খনীল কারাগার, আগুনের পরশমনি, ঘেটুপুত্র কমলার মত চলচিত্রগুলো কি সত্যি নয় এ সমাজের লুকিয়ে থাকা চরিত্র?

নব্বই এর দশকে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর প্রথম ধারাবাহিক নাটক বহুব্রীহি ছিল এক অনন্য উদাহরণ। সেই ধারাবাহিকের একটি সংলাপ ছিল ‘তুই রাজাকার’। ২০১৩ সালে শাহবাগে যে তারুণ্য ‘তুই রাজাকার’… বলে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চেয়ে রাজপথ দখল করেছে, সেই শব্দটি এই নাটক থেকেই এসেছে। শুধু বহুব্রীহিই নয়, তাঁর কালজয়ী সৃষ্টি ‘কোথাও কেউ নেই’ নাটকে বাকের ভাই এর মুক্তির দাবি কার না ছিল?

বাকের ভাই চরিত্রটি তখন তুমুল দর্শকপ্রিয়তা লাভ করে। বাকের ভাইয়ের ফাঁসি রুখতে সেই রাতে দর্শক ‘বাকের ভাইয়ের কিছু হলে, জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে’ স্লোগানে মিছিল নিয়ে হুমায়ূন আহমেদের এলিফ্যান্ট রোডের বাড়িতে আক্রমণ করেছে। সে সময় তিনি রমনা থানায় একটি জিডিও করেছিলেন সেই ঘটনায়। একজন লেখকের দর্শন কতটা শক্তিশালী তা সেই নাটকেই প্রমাণীত।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র থাকা অবস্থায় ১৯৭২ সালে হুমায়ূন আহমেদের প্রথম উপন্যাস  ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশ হওয়ার পরই বর্ষসেরা উপন্যাসের পুরস্কার লাভ করেছে। যদিও ‘শঙ্খনীল কারাগার’ উপন্যাসটি তাঁর প্রথম লেখা, কিন্তু তিনি তা প্রকাশ করেন ২য় গ্রন্থ হিসেবে। ‘নন্দিত নরকে’ প্রকাশের পরই তাঁর খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে চারদিকে।

হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্টি করা আরেকটি শক্তিশালী চরিত্র ‘মিসির আলি’। যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ডাকোটার ফার্গো শহরে স্ত্রী গুলতেকিনের সাথে গাড়িতে ভ্রমণকালে এই চরিত্রটি আবিষ্কার করেন লেখক। উপন্যাস ও নাটকে তাঁর সৃষ্ট চরিত্রগুলো বিশেষ করে ‘হিমু’, ‘মিসির আলী’, ‘শুভ্র’ তরুণ-তরুণীদের কাছে আজও অনুকরণীয়।

আজকের বাংলাদেশে যে হুমায়ূন আহমেদকে আমরা সাহিত্যের প্রতিটি পৃষ্ঠায় অনুভব করি, বিংশ শতাব্দীতেই সেই হুমায়ূন আহমেদ নিজেই শ্রেষ্ঠ লেখকদের অন্যতম হিসেবে ঠাঁই করে নেন সাহিত্য আঙিণায়। তাঁর প্রকাশিত গ্রন্থের সংখ্যা তিন শতাধিক। তাঁর কলমের প্রতিটি শব্দ, বাক্য, সংলাপ পাঠককে শুধু ভাবাতো না, নম্রতা ভদ্রতা ও বিদ্রোহী করেও তুলতো।

শুধু বাংলা সাহিত্য নয়, আধুনিক বাংলা বৈজ্ঞানিক কল্পকহিনীর পথিকৃৎ হুমায়ূন আহমেদ নাটক ও চলচ্চিত্র পরিচালক হিসাবেও সমাদৃত ছিলেন। তাঁর বেশ কিছু গ্রন্থ পৃথিবীর নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, বেশ কিছু গ্রন্থ স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্যসূচীর অন্তর্ভুক্ত।

নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা পেশা থেকে স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণ করে লেখালেখিতে পুরোপুরি মনোযোগ দেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাসের মধ্যে নন্দিত নরকে, লীলাবতী, কবি, শঙ্খনীল কারাগার, গৌরিপুর জংশন, বহুব্রীহি, এইসব দিনরাত্রি, দারুচীনি দ্বীপ, নক্ষত্রের রাত, কোথাও কেউ নেই, আগুনের পরশমনি, শ্রাবণ মেঘের দিন, জোছনা ও জননীর গল্প ইত্যাদি…। তাঁর পরিচালিত চলচ্চিত্রের মধ্যে আগুনের পরশমনি, শ্যামল ছায়া, শ্রাবন মেঘের দিন, দুই দুয়ারী, চন্দ্রকথা ও নয় নম্বর বিপদ সংকেত উল্লেখযোগ্য। তার সর্বশেষ চলচ্চিত্র ‘ঘেটুপুত্র কমলা’ জয় করেছে দর্শক ও সমালোচকদের মন।

হুমায়ূন আহমেদের প্রশংসা শুধু ইটকাঠে মোড়ানো শহরের মধ্যেই সীমাদ্ধ একথাটা ভাবা যেমন চরম ভুল, তেমিন আজও আমরা তাঁর সমকক্ষ কাউকে পাইনি বাংলা সাহিত্যে। হুমায়ূন শব্দটি নিয়ে পল্লীর প্রতিটি প্রান্তরেও চলছে নানা আয়োজন। আমার মেঠোপথের ‘আলোকিত পাঠাগার’ এর পাঠকরাও হুমায়ূনের বই বেশি খোঁজেন। গ্রাম থেকে পাঠকদের প্রায়ই ফোন আসে, ভাই হুমায়ুন আহমেদের অমুক বইটি ঢাকা থেকে নিয়ে আসবেন। অনেকে প্রিয় লেখকের সাজানো পৃথিবী ‘নুহাশপল্লী’ ঘুরে দেখতে চান। আমার ই প্রতিষ্ঠিত ‘স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটি সাহিত্য ফোরামের’ একঝাঁক হুমায়ূন প্রিয় শিক্ষার্থীরা গতবছরই ছুটে গিয়েছে নুহাশপল্লীতে।

কোটি ভক্তদের মাঝে হুমায়ূন আহমেদ ফিরে আসেন সাহিত্যের ব্যতিক্রমী অনুভূতি ও দাবি নিয়ে। তিনি আক্ষরিক ও বাস্তবিক অর্থে আমাদের চোখের আড়াল, কিন্তু মনের আড়াল কি হতে পেরেছেন? সাহিত্য আর ভালোবাসার ফ্রেমে মোড়ানো হুমায়ূন আহমেদ যেভাবে পাঠক হৃদয়ে স্থান করেছেন, তা হাজার  বছরেও ঘুনে ধরার নয়। আমাদের চারপাশে আজ যে হিমু, চৈতি, অপু চরিত্র দেখছি আমরা, এসবের সষ্ট্রা হুমায়ূন আহমদ নিজেই। নুহাশপল্লী থেকে বইমেলা, মেঠেপথ থেকে শহরের অলিগলি সব জায়গায় পালিত হচ্ছে তাঁর জন্মদিন। সবাই যেন হুমায়ূন আহমেদের আত্মার আত্মীয়।

আমরা হেরে যাই হুমায়ূন আহমেদের লেখার কাছে। হেরে যাই তাঁর দর্শন ও ভালোবাসার কাছে। জীবনের ধ্যার্থহীন প্রতিটি কাজে যে হুমায়ূন সফল, তাঁর কখনো হার নাই। মাত্র ৬৪ বছরেই হাজার বছরের বন্ধন তৈরি করে গেলেন তিঁনি।

বাংলা সাহিত্যে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ লাভ করেন হুমায়ন আহমেদ। এ ছাড়াও তিনি বাংলা একাডেমী পুরস্কার (১৯৮১), হুমায়ূন কাদিও স্মৃতি পুরস্কার (১৯৯০), লেখক শিবির পুরস্কার (১৯৭৩), জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার (১৯৯৩ ও ১৯৯৪), বাচসাস পুরস্কার (১৯৮৮) লাভ করেন। দেশের বাইরেও তাকে নিয়ে তথ্যচিত্র নির্মাণ করেছে ‘হু ইজ হু ইন এশিয়া’।

স্বাল্পিক বৈশিষ্ঠে পাঠক হুমায়ূন আহমেদকে দেখতেন রসিক ভণিতাবিহীন হিসেবে। স্বল্পবাক, কিছুটা লাজুক প্রকৃতির মানুষ এবং বিপুল জনপ্রিয়তা সত্ত্বেও অন্তরাল জীবন-যাপনে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন তিনি। নীরবে মানুষের স্বভাব-প্রকৃতি ও আচার-আচরণ পর্যবেক্ষণ করাই ছিল তার শখ।

আরিফ চৌধুরী শুভ
লেখক- আরিফ চৌধুরী শুভ

জীবনের শেষভাগে ঢাকা শহরের ধানমন্ডিতে একটি ফ্লাটে তিনি বসবাস করতেন। ২০১১-এর সেপ্টেম্বরে তাঁর দেহে ক্যান্সার ধরা পড়ে। দীর্ঘ নয় মাস ধরে ১২ দফায় তাঁকে কেমোথেরাপি দেওয়া হয়েছিল। কৃত্রিমভাবে লাইভ সাপোর্টে রাখার পর ২০১২ সালের ১৯শে জুলাই নিউ ইয়র্কের বেলেভ্যু হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন। নুহাশ পল্লীর লিচু তলায় যে হুমায়ূন আহমেদ চিরশায়িত, ৭০ জন্মদিনেও তিনিপাঠক হৃদয়ে জীবিত এবং অভিনন্দিত। যতটা অতীত তিনি তার চেয়ে বেশি বর্তমান আমাদের হৃদয়ে। আবারো শুভ জন্মদিন প্রিয় হুমায়ূন আহমেদ।

 

 

লেখক: প্রতিষ্ঠাতা, জাতীয় পাঠাগার আন্দোলন। উদ্যোক্তা ও সংগঠক, নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলন।  শিক্ষার্থী, (মাস্টার্স), আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ডিপার্টমেন্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। jatiyapathagerandolon@gmail.com

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here