এক বংশ, এক রক্ত, তবু কেন আলাদা ?আসাদুজ্জামান সাজু, লালমনিরহাট প্রতিনিধি :: ইচ্ছে করে ছিলো দাদীকে ছুঁয়ে দেখি। কাঁটাতারের বেড়ার ফাঁক দিয়ে অনেক চেষ্টা করছিলাম। কিন্তু ছুঁতে পারি নাই। মনে হচ্ছিল দাদীকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার করে কান্না করি। তাহলে হয়তো দীর্ঘ দিনের জমে থাকা কষ্টগুলো থেকে রেহাই পেতাম। ২ মাস আগে দাদা মারা গেছে, যেতে দেয়নি এই কাঁটাতারের বেড়া। এক রক্ত, এক বংশ, তবু কেন আলাদা ? নিজের মানুষকে দেখবো, তাতে কেনো এতো জটিলতা? এভাবে কথা বলে আমি শান্তি পাই না। ওপারের সীমান্তে আসা দাদীকে দেখতে গিয়ে কান্না জড়িত কণ্ঠে কথা গুলো বলছিলেন নাতনি সুমাইয়া আক্তার। ওপারে দাদী আর এপাড়ে নাতনি সুমাইয়া আক্তার কান্না জড়িত কণ্ঠে দু’জন দু’জনের সঙ্গে কথা বলছেন। একে অপরকে জড়িয়ে ধরার ইচ্ছে থাকলেও পারছেন না, মাঝখানে যেন অলঙ্ঘনীয় কাঁটাতারের বেড়া।

শুধু দাদী জোহারা বেওয়া আর নাতনি সুমাইয়া নন। গত বুধবার হাজার হাজার মানুষ তাদের স্বজনদের এক পলক দেখতে ছুটে যান লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার আলা উদ্দিন নগর নামক সীমান্তে। হিন্দু সম্প্রদায়ের শ্যামা পূজা উপলক্ষ্যে ওই সীমান্তে ধরলা নদীর পাড়ে প্রতি বছরের মতো এবারও বসেছে দুই বংলার মানুষের মিলন মেলা। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এ মেলা।

স্বপন চন্দ্র’র কাকাতো ভাই রবিন চন্দ্র ১৯৪৭ সালে দেশ বিভাগের সময় বাবা পলাশ চন্দ্র’র সাথে শিলিগুড়িতে চলে গেছেন। সেখানে স্কুলের শিক্ষকতা করেন। ছোট ভাই স্বপনের ও তার ছেলে মেয়ের জন্য নতুন শীতের কাপড় নিয়ে কাঁটাতারের বেড়ার কাছে এসেছে রবিন চন্দ্র। সরাসরি কাপড় দিতে পারে নাই। তাই কাঁটা তারের বেড়ার উপর দিয়ে ছুড়ে মেরে কাপড়ের বস্তা। তবুও আনন্দ নিয়ে বিদায় নিলেন তারা।

রংপুর সদর উপজেলা থেকে কমল রায় এসেছেন ভারতের বড়মরিচা গ্রামে থাকা জেঠি মার সঙ্গে দেখা করতে। জেঠি মায়ের সঙ্গে দেখা করার অনুভূতি বলতে গিয়ে কমল রায় বলেন, বাংলাদেশে খালাতো বোনের আমার বিয়ে হয়ে আমি বাংলাদেশেই আছি। প্রতি বছর শ্যামা পুজার সময় বেড়ার কাছে এসে সবাই এক সাথে হয়ে একটু কথা বলি। বাচ্চারা তাদের দাদীকে দেখে খুশিতে আতœহারা। তারা বেড়ার কাছ থেকে দাদীকে ছাড়া আসতেই চায় না।

পাটগ্রাম উপজেলা চেয়ারম্যান রহুল আমিন বাবুল বলেন, দেশ বিভাগের পর আত্মীয় স্বজনরা দুই দেশে ছড়িয়ে পড়ে। তাই সারা বছর এদের সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ করতে পারে না। অপেক্ষা করে থাকে এ দিনটির জন্য। দুই দেশের ভৌগলিক সীমা রেখা আলাদা করা হয়েছে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করে। কিন্তু সে কাঁটাতার আলাদা করতে পারেনি দুই দেশের মানুষের ভালবাসার টানকে। সুযোগ পেলেই তারা ছুটে যায় কাঁটাতারের বেড়ার কাছে, মিশে যান একে অপরের সঙ্গে ভালবাসার দুর্লভ ওমে।

অনেক দিন পর আপন জনের দেখা পেয়ে আবেগে কেঁদে বুকের কষ্টটা হালকা করেন অনেকে। বিনিময় করেন মনের জমানো হাজারো কথা। কিন্তু তারা জানে না ভৌগলিক সীমা রেখাকে কবে হƒদয়ের দাবি দিয়ে ছিন্ন করতে পারবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here