উপকূলের শিক্ষামিলন কর্মকার রাজু, কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :: কৃষক সবুজ গাজী। এ বছর প্রথম সন্তান সুমন গাজীকে (৫) ধুলাসার সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রাক প্রাথমিকে ভর্তি করার জন্য মনস্থ্যির করেণ। কিন্তু বিপত্তি বাঁধে তার ছেলের জন্ম নিবন্ধন কার্ড নেই। স্কুলে ভর্তি করতে হলে জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক শিক্ষকদের এই শর্তে বিপাকে পড়ে সে। শিক্ষকদের কাছে অনুরোধ করে বিদ্যালয়ের ভর্তির স্লিপ লিষ্টে ছেলের নাম উঠালেও রেজিষ্টারে নাম উঠবে বিদ্যালয়ে জন্ম নিবন্ধন কপি জমা দেয়ার পরই। কিন্তু কিভাবে করবেন জন্ম নিবন্ধন এ নিয়ে এখন সে চিন্তিত।

এ কৃষক পরিবারের মতো পটুয়াখালীর উপকূলীয় বিদ্যালয়গুলোতে এ বছর সন্তানদের স্কুলে ভর্তি করতে এসে শুধু জন্ম নিবন্ধন না থাকায় বিপাকে পড়েছেন শতশত অভিভাবক। শুধু গ্রামে না, শহরের অনেক পরিবারও সন্তানের জন্ম নিবন্ধন না করার ভুল করে এখন পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদে ঘুরছেন জন্ম নিবন্ধন করার জন্য। কিন্তু শূণ্য থেকে ৪৫ দিন (ফ্রি), ছয় মাস থেকে দুই বছর এবং দুই বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করতে পৃথক নিয়ম থাকায় গ্রামীন অনগ্রসর পরিবারের শিশুর অভিভাবকরা পড়েছেন সবচেয়ে বেশি বিপদে।

কলাপাড়ার দক্ষিন দেবপুর সরকারি বিদ্যালয়ের শিক্ষক মো. সোহেল মিয়া জানান, গত ২৫ দিনে অন্তত ২০-২৫ শিশুকে জন্ম নিবন্ধন ছাড়া স্কুলে ভর্তি করতে এসেছেন অভিভাবকরা। কিন্তু স্কুলে ভর্তি হতে হলে জন্ম নিবন্ধন আবশ্যক বিষয়টি জানালে কিছু অভিভাবক সন্তানদের স্কুলে ভর্তি না করিয়ে চলে যায়। কিন্তু তারপরও অভিভাবকদের অনুরোধে ১০ শিশুকে স্লিপ লিষ্টে নাম উঠতে হয়েছে ১০-১৫ দিনের মধ্যে বিদ্যালয়ে জন্ম নিবন্ধন কার্ড জমা দিবেন এই শর্তে। এ চিত্র উপকূলীয় এলাকার প্রতিটি বিদ্যালয়ে।

১৮ ডিসেম্বর ২০১৭ প্রকাশিত স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রনালয় স্থানীয় সরকার বিভাগ এর বাংলাদেশ গেজেট ( স্মারক নং ৪৬.০০.০০০০.০১৮.২২.০০১.১৭-৭৬০-জন্ম ও মৃত্যু বিধিমালা) সূত্রে জানা যায়, জন্ম নিবন্ধন ফি কমানো হলেও নিয়ম ঠিকই রয়ে গেছে আগের মতো। এ কারণে যে অভিভাবকরা জন্মের ৪৫ দিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন করান নি তারাই এখন সন্তানকে স্কুলে ভর্তি করতে সমস্যায় পড়ছেন।

কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে স্কুল গুলোতে স্কুলে ভর্তি করতে শিক্ষার্থীদের জন্ম নিবন্ধন বাধ্যতামূলক সংক্রান্ত মৌখিক নির্দেশ দিলেও অভিভাবকদের অনুরোধে এ নিয়ম কিছুটা শিথিল করেছেন। সন্তানকে ভর্তির এক সপ্তাহ থেকে এক মাসের মধ্যে এ নিবন্ধন কার্ড স্কুলে পৌছে দিবেন এ শর্তে অনেক বিদ্যালয় স্লিপ লিষ্টে জন্ম নিবন্ধন বিহীন শিক্ষার্থীদের নাম তালিকাভুক্ত করে ভর্তি দেখাতে শুরু করেছেন।

ধুলাসার মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষা মো. মিজানুর রহমান জানান, তাদের বিদ্যালয়ে এ বছর প্রাক প্রাথমিকে ২৫ জানুয়ারি পর্যন্ত ২১ জন ভর্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১২ জন শিক্ষার্থীর অভিভাবক জন্ম নিবন্ধন কার্ড দিতে পারে নি। এ সন্তানের অভিভাবকরা আগামী দুই সপ্তাহের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন কার্ড জমা দিবেন এই শর্তে তাদের সন্তানকে স্কুলে ভর্তি দেখিয়েছেন। কিন্তু পরে এ জন্ম নিবন্ধন কার্ড জমা না দিলে তাদের ভর্তি বাতিল হয়ে যাবে বলে জানান।

দক্ষিন দেবপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষিকা মেহেরুন্নেছা জানান, এখন যেসব শিশুর অবিভাবক জন্ম সনদ দিতে পারে নি তাদের ভোটার আইডি কার্ড ও ছবি রেখে শিশুকে ভর্তি করিয়েছেন। এবং প্রত্যেককে সময় দিয়ে দিয়েছেন জন্ম সনদ জমা দেয়ার জন্য।

উপজেলার একাধিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, গ্রামীন জনপদে শতকারা ৬০ থেকে ৭০ ভাগ শিশুর অভিভাবক কৃষক, জেলে, শ্রমিক ও নি¤œ আয়ের। এদের মধ্যে বেশিরভাগই শিক্ষার আলো থেকে বঞ্চিত। এ কারনে সন্তানের জন্মের পর অসচেতনতায় কারনে তাদের জন্ম নিবন্ধন করান নি কিংবা গুরুত্ব বোজেন নি। এখন সন্তাদের স্কুলে ভর্তি করাতে এসে বুজতে পারছেন জন্ম নিবন্ধন না করে তারা কি ভুল করেছেন। এজন্য এখন ইউনিয়ন পরিষদ থেকে পৌরসভা সেখান থেকে উকিলদের কাছে ছুটছেন। তবে বেশিরভাগ স্কুলেই গড়ে ১০-১৫ জন শিশুকে আপাতত ভর্তি করিয়েছেন কিছুদিনের মধ্যে জন্ম নিবন্ধন জমা দিবেন এই শর্তে। এই সংখ্যাটাও কয়েক হাজার বলে তাঁরা জানান।

কলাপাড়ার মংগলসুখ মডেল সরকারি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. আবুল হোসেন জানান, শহর কেন্দ্রীক স্কুল হওয়ায় অভিভাবকরা অনেক সচেতন। এ কারনে যারা ভর্তি হয়েছে সবাই জন্ম নিবন্ধন কার্ড জমা দিয়েছেন। আর জন্ম নিবন্ধন কার্ড ছাড়া স্কুলে ভর্তি নেওয়া হয়না বলে জানান।
কলাপাড়ার কাউয়ার গ্রামের জেলে আকবর মিয়া (২৯) বলেন, “জন্ম নিবন্ধন কি হেইডা তো আগে জানতামই নাম। মোরা মূর্খ মানুষ। স্কুলে যাই নাই। এ্যাহন মাইয়ারে ভর্তি করমু। কিন্তু স্যারেরা কয় কি যানি কার্ড (জন্ম নিবন্ধন)লাগবে। এ্যাহন হেই কার্ড করমু ক্যামনে কন।” তিনি বলেন,“ চেয়ারম্যানে কয় মাইয়ার বয়স ছয় বছর। হ্যারা করতে পারবে না। ঢাকা যাইয়া করতে হইবে। মুইতো জীবনেও ঢাকা যাই নাই। কোন হানে করমু হ্যা জানি না। এ্যাহন এই কার্ডের লইগ্যা কি মোর মাইয়া কি ভর্তি হইতে পরবে না।”

লোন্দা গ্রামের বাবুল মিয়া বলেন, তার দুই বছর বয়সী ছেলের জন্ম নিবন্ধন করেছেন কয়েকদিন আগে। এ্যাডভোকেটের মাধ্যমে এফিডেভিট করে বয়স প্রমান করে তারপর জন্ম নিবন্ধন কার্ড করিয়েছেন। এখন জন্ম নিবন্ধন করতে টাকা বেশি না দরকার হলেও যে ভোগান্তি তা সত্যিই দূর্বিসহ। অনেক সময় আট-দশদিনও লেগে যায় অনেকের ক্ষেত্রে। তবে জন্মের পরই যদি এটা সবাই করে তাহলে এই দূর্ভোগ হতো না। এ জন্য সবারর সচেতনতা দরকার।

কলাপাড়ার ডালবুগঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদ এর সচিব মো. ওয়াহেদ মাসুদ জানান, এই জানুয়ারি মাসে অন্তত ১৫০-২০০ অভিভাবক এসেছেন তাদের সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করানোর জন্য। কিন্তু ইউনিয়ন পরিষদের হাতে ক্ষমতা জন্মের ৪৫ দিন পর্যন্ত ফ্রি করার। এরপর ছয় মাস পর্যন্ত ফি দিয়ে। ছয় মাস থেকে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করতে হবে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার মাধ্যমে। দুই বছর থেকে পাঁচন বছর বয়সী শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করতে হবে জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে। ছয় বছরের বেশি বয়সের শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করতে হবে ঢাকা স্থানীয় সরকার মন্ত্রনালয়ের অতিরিক্ত সচিব এ মাধ্যমে। কিন্তু এখন যে অভিভাবকরা জন্ম নিবন্ধনের আসছে তাদের সন্তানের বয়স পাঁচ বছর থেকে সাত বছর। পরিষদ থেকে যাদের জন্ম নিবন্ধন করা অসম্ভব।

ইউপি চেয়ারম্যান আঃ সালাম সিকদার বলেন, এখন তাঁদের একটা বড় সমস্যা এই জন্ম নিবন্ধন। গ্রামের মানুষ জন্মের পর সন্তানের জন্ম নিবন্ধন না করায় এখন পরিষদে ভীড় করছে। কিন্তু তাদের বোঝাতে পারছেন না এটা পরিষদের হাতে নেই। তাঁর মতে, সরকার জন্ম নিবন্ধন করার খরচ কমানোর মতো এর নিয়ম কিছুটা পরিবর্তন করলে গ্রামের মানুষের উপকার হতে। তিনি বলেন, অন্তত ছয় বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করার ক্ষমতা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান, পৌরসভার মেয়রদের হাতে দিলে এই সমস্যা থাকতো না।

কলাপাড়া পৌর সভার সচিব মো. মাসুম বিল্লাহ জানান, পৌর এলাকায় আগের চেয়ে অভিভাবকদের মধ্যে সচেতনতা বাড়লেও অনেক অভিভাবক সন্তানের জন্ম নিবন্ধন করান নি। এখন স্কুলে ভর্তি করাতে গিয়ে জন্ম নিবন্ধনের আবশ্যকতা জেনে এখন পৌরসভায় ভীড় করছেন। কিন্তু পাঁচ বছরের বেশি বয়সের শিশুদের এ জন্ম সনদ দেয়ার ক্ষমতা পৌরসভার নেই।

কলাপাড়া উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. তানভীর রহমান জানান, তাঁর ক্ষমতা আছে দুই বছর বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্ম নিবন্ধন করার অনুমতি দেয়ায়।

কলাপাড়া উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মনি লাল সিকদার জানান, শিক্ষকদের কাছে অনেক শিক্ষার্থীর“জন্ম নিবন্ধন” না থাকার সমস্যার কথা শুনেছেন। তিনি সকল শিশুকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে অন্তত এক মাসের মধ্যে অভিভাবকদের জন্ম নিবন্ধন সনদ জমা দেয়ার সময় দিয়ে বিদ্যালয় প্রধানদের বলেছেন। এখন সেই অনুযায়ী ভর্তি চলছে। তবে কেউ যদি নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে জন্ম সনদ দিতে না পারে সেটা তাদের বিষয়।(চলবে)

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here