[author ]মো: আলাউদ্দিন মজুমদার [/author]

durnity-crimeitবর্তমানে বাংলাদেশের সর্বনাশা ব্যাধি হলো দুর্নীতি। রাষ্ট্রীয় প্রশাসন থেকে শুরু করে দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি, শিল্প, শেয়ারবাজার, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ জীবন যাত্রার প্রায় সকল ক্ষেত্রে এক মহাবিপর্যয়কর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে দুর্নীতি। এই দুর্নীতির ফলে দেশের প্রশাসনিক দক্ষতা হ্রাস পেয়েছে, জনগণ তাদের নায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। দুর্নীতি সামাজিক নৈরাজ্য সন্ত্রাস, বিভিন্ন ধরনের অপরাধ ও সন্ত্রাস বৃদ্ধি করে সরকারের প্রতি জনগণের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য হ্রাস করে। ফলে জনগণের বিড়ম্বনা বৃদ্ধি করে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেশের সুনাম মারাত্মকভাবে ক্ষুন্ন হয়েছে। মূলধন গঠন ও উৎপাদনশীল খাতে বিনিয়োগ বাধায় সৃষ্টি করে এবং সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা সৃষ্টি করে। এক কথায় বলা যায়, দুর্নীতি, সামাজিক বৈষম্য, বিচ্ছিন্নতা, স্বার্থপরতা, অবিশ্বাস, ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বৃদ্ধির মাধ্যমে জাতীয়পর্যায়ে ফলাফল হলো একটাই। আর তা হলো দুর্নীতি দেশ ও জাতিকে উন্নয়নের সকল দিক থেকে পিছিয়ে দেয়া। পৃথিবীর সব দেশেই কম-বেশি দুর্নীতি থাকলেও আমাদের দেশে এর প্রসার অত্যন্ত ব্যাপক ও ভয়াবহ।

অবশ্য এর পেছনে বিভিন্ন কারণও রয়েছে। যেমন- ঔপনিবেশিক শাসনামলে বিদেশী শাসকরা তাদের স্বার্থ রক্ষার জন্য এ দেশে এক শ্রেণির দুর্নীতিবাজ আমলা তথা চাটুকার ও মধ্যস্তকারী সৃষ্টি করেছিল। যারা দুর্নীতি, প্রতারণা ও বঞ্চনার মাধ্যমে জনগণকে শোষণ করত। ঔপনিবেশিক বেনিয়াদের সৃষ্ট দুর্নীতির প্রক্রিয়া আজো সমাজে ক্রিয়াশীল রয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দারিদ্রের প্রভাবে এ দেশের বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রমজীবী মানুষ সমাজে স্বাভাবিক উপায়ে মৌল চাহিদা পূরণে ব্যর্থ হয়েছে, অস্বাভাবিক উপায় অবলম্বন করছে। যার প্রভাবে আমাদের সমাজে দুর্নীতির প্রসার ঘটছে। তা ছাড়া রাতারাতি আর্থসামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠা লাভের তীব্র আকাঙ্খা এ দেশে দুর্নীতি বিকাশের অন্যতম প্রধান কারণ। বাংলাদেশের ভয়াবহ বেকারত্বের পার্শ্ব-প্রতিক্রিয়া হিসেবেও সমাজে দুর্নীতি প্রসারিত হচ্ছে। বাংলাদেশে অর্থ হলো সামাজিক মর্যাদা পরিমাপের প্রধান মানদন্ড। আমাদের সমাজে যার যতবেশি অর্থ রয়েছে, সে-ই তত প্রভাব ও মর্যাদার অধিকারী। প্রতিযোগিতা সমাজে দুর্নীতি বিসত্মারে সহযোগিতা সম্পদশালী হওয়া সম্ভব নয় বলে অনেকে বাধ্য হয়ে দুর্নীতির মাধ্যমে রাতারাতি ধনী হওয়ার চেষ্টা করে। বাংলাদেশে দুর্নীতি বিস্তারে বিরাজমান রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্থিরতা বিশেষভাবে দায়ী। সদাজাগ্রত দেশপ্রেম ও মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন সমাজে দুর্নীতি প্রসারের অন্যতম প্রধান কারণগুলো হলো এ দেশের জনগণের মাঝে নীতি, নৈতিকতা ও কোনো সামাজিক মূল্যবোধ নেই। বর্তমানে এ দেশের জনগণের মাঝে নৈতিকতার এমনই অবক্ষয় ঘটেছে যে, তারা দুর্নীতিবাজদের প্রতি সহনশীল মনোভাবাপন্ন হয়ে পড়েছে। দুর্নীতিবাজদের প্রতি সামাজিক ঘৃণা এখন আর জোরালোভাবে লক্ষ্য করা যায় না। বর্তমান সময়ে আমাদের দেশে দুর্নীতির অবস্থান এতটাই শক্তিশালী যে, দেশের সাধারণ মানুষ দুর্নীতির কাছে অসহায় হয়ে একে নিজের ভাগ্য বলে মেনে নিয়েছে।

এমতাবস্থায় বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের স্বার্থে সমাজের সর্বস্তর থেকে দুর্নীতি নির্মূল করার বিষয়টি প্রথমে অগ্রাধিকার পাওয়া উচিত। দুর্নীতি প্রতিরোধ করা রাষ্ট্রের পবিত্র ও সাংবিধানিক দায়িত্ব। আর এ জন্য প্রয়োজন বলিষ্ট রাষ্ট্রীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ, কঠোরভাবে আইন প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে ব্যাপক জনমত গঠন। কারণ নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধসম্পন্ন ব্যক্তি কখনো দুর্নীতির আশ্রয় নিতে পারে না। তাই ছেলে-মেয়েদেরকে সামাজিক ঐতিহ্য, মূল্যবোধনীতি ও আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়ার মানসিকতা সম্পন্ন করে গড়ে তোলার শিক্ষা প্রদান করতে হবে। যাতে করে ছোটবেলা থেকেই তাদের মাঝে দুর্নীতি ও অনিয়মকে ঘৃণা করার মানসিকতা গড়ে ওঠে। এ জন্য পারিবারিকপর্যায় থেকে উচ্চ শিক্ষার সস্তর পর্যন্ত নৈতিক শিক্ষার প্রতি সর্বাধিক গুরম্নত্ব দিতে হবে। জাতীয় উন্নয়নের মাধ্যমে বিশ্বের বুকে একটি সমৃদ্ধশালী ও মর্যাদাবান জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের জন্যে আমাদেরকে দুর্নীতি নামক এই সর্বনাশা ও সর্বগ্রাসী সামাজিক ব্যাধির মূল উৎপাটনে সর্বশক্তি নিয়োগ করতে হবে। কারণ দুর্নীতি আজ পৃথিবীর বিশেষ কোনো এলাকার সমস্যা নয়। উন্নত, উন্নয়নশীল ও স্বল্পোন্নত সব ধরনের দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের ক্ষেত্রেই দুর্নীতি অন্যতম প্রধান সমস্যা হিসেবে স্বীকৃত। বাংলাদেশের স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকারই দুর্নীতির বিরম্নদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন।

কিন্তু বাস্তবে বাংলাদেশ আজ বিশ্বের সর্বাধিক দুর্নীতিগ্রস্ত দেশের কু-খ্যাতি অর্জন করেছে। তবুও আমরা আশাকরি, বাংলাদেশের দুর্নীতির কালোমেঘ একদিন দূরীভূত হবে। কারণ আমরা আশাবাদী। আর তাই আনিসুল হকের কণ্ঠে কণ্ঠে মিলিয়ে বলতে পারি, আশাবাদী হলেন সেই ব্যক্তি, যিনি আইফেল টাওয়ার থেকে পড়ে যেতে যেতে মাঝপথে এসে ভাবেন, আরে, আমি তো এখনো আহত হয়নি। দুর্নীতি প্রতিরোধ করা রাষ্ট্রের সাংবিধানিক দায়িত্ব ও কর্তব্য। তবে আজ সমাজের সর্বসত্মরে দুর্নীতি যেভাবে ঝেঁকে বসেছে, তা স্বল্প ও একটি মাত্র কারণে হয়নি। তাই দুর্নীতি প্রতিরোধে স্বল্পমেয়াদি ও একমুখী সাধনামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ না করে দীর্ঘমেয়াদী বহুমুখী কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। দুর্নীতি প্রতিরোধে ন্যায়পালের পদ সৃষ্টি করা ও ন্যায়পালের কার্যকর অফিস প্রতিষ্ঠা, স্বাধীন বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা, সরকারি নিরীক্ষণ কমিটি গঠন। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সুষ্ঠ প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে। দুর্নীতির মূল উৎপাটনে জনগণের মধ্যে নৈতিক মূল্যবোধ সামাজিক চেতনা সৃষ্টির জন্য কার্যকর কর্মসূচি প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। এ ছাড়া জ্ঞানী-গুণী নিবেদিত ও দক্ষ মানুষের ব্যাপক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার মাধমে রাজনৈতিক ব্যবস্থার গুণগত পরিবর্তন সাধন করতে হবে। এ ছাড়া দুর্নীতির বিরম্নদ্ধে গণসচেতনা সৃষ্টি এবং দুর্নীতিবাজদের সামাজিকভাবে বয়কট করার পদক্ষেপ নিতে হবে। সরকারকেও দুর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে আরো সচেতন হতে হবে। আসুন সকলের মধ্যে সামাজিক, নৈতিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধকে জাগ্রত করি। দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনের সঠিক ও সফল প্রয়োগ করতে হবে। আর তা হলেই দুর্নীতি মুক্ত বাংলাদেশ গড়া সম্ভব।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here