কেয়া চৌধুরী :: আজ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ৪১তম শাহাদাতবার্ষিকী। জাতি ভারাক্রান্ত মনে জাতীয় শোক দিবস পালনের মধ্য দিয়ে বঙ্গবন্ধুর কালজয়ী আদর্শ আরো দৃঢ়ভাবে ধারণ করে এগিয়ে যাওয়ার শক্তি সঞ্চয় করছে। ছিচল্লিশ বছর পূর্বে যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধু যখন কাজ শুরু করেছিলেন তখন পোড়া মাটি বাদে দেশে আর কিছুই ছিল না।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধু সেদিনই বীজ বপন করেছিলেন সমৃদ্ধ বাংলাদেশের। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক অবস্থান, সামর্থ্য ও জিডিপির অগ্রগতি মালয়েশিয়া, কোরিয়া ও থাইল্যান্ডের সমপর্যায়ে ছিল। কিন্তু তাদের ছিল না বঙ্গবন্ধুর মতো বিশ্বমানের কোনো নেতা, যে কিনা নিজের জীবন ফাঁসির মঞ্চে সঁপে দিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভিত রচনা করেছিলেন।
কিন্তু এমন মহান নেতাকে আমরা বাঁচাতে পারিনি। মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় বঙ্গবন্ধুকে নিহত হতে হয়েছে সপরিবারে। যদি স্বাভাবিক গতিতে দেশ গড়ার কাজে বঙ্গবন্ধু সময় দিতে পারতেন, যদি অসময়ে বঙ্গবন্ধুকে চলে যেতে না হতো তবে মালয়েশিয়া, কোরিয়া, থাইল্যান্ডের মতো দেশ যারা কিনা আজ থেকে বিশ বছর আগে এলডিসিভুক্ত দেশ হিসেবে গণ্য ছিল তারা আজ উন্নত বিশ্বের সোপানে পা রেখেছে কিন্তু আমরা তাদেরকেও ডিঙ্গিয়ে যেতে পারতাম। বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে আজ থাকত।
স্বাধীন বাংলার স্বপ্ন দ্রষ্টা শেখ মুজিবই জানতেন, বাংলাদেশ কীভাবে উন্নত-সমৃদ্ধ হতে পারে। কিন্তু বাস্তবতা হলো পঁচাত্তর-পরবর্তী ইতিহাস যা কিনা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের সৃষ্টি করা একটি অন্ধকার, অনুন্নত, অনগ্রসর বাংলাদেশের ইতিহাস। জাতির পিতাকে সপরিবারে হত্যাই নয়, ষড়যন্ত্র হয়েছিল বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের আদর্শকে কফিনবন্দি করারও। বিকৃত ইতিহাসের ছায়া বিস্তার করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী বঙ্গবন্ধুর খুনিরা বাংলাদেশকে পিছিয়ে রেখেছিল ২৯টি বছর।
বলা দরকার, ২৯ বছর শুধু বাংলাদেশ পেছায়নি, মিথ্যা ইতিহাস দিয়ে একটি প্রজš§কে পিছিয়ে দেয়া হয়েছে সুস্থচিন্তা, সুস্থ রাজনৈতিক দর্শন থেকে। ’৭৫-পরবর্তী রাজনৈতিক-অরাজনৈতিক প্রায় প্রতিটি সরকারের আমলই ছিল আওয়ামী লীগ তথা বঙ্গবন্ধু পরিবারের শেষ চিহ্ন শেখ হাসিনার রাজনীতিকে চিরতরে স্তব্ধ করে দেয়ার চক্রান্ত।
আমরা জাতি হিসেবে আজো পারিনি বঙ্গবন্ধুর অজেয় আদর্শকে, তার আত্মত্যাগকে এক সূত্রে গেঁথে মর্যাদার আসনে স্থান দিতে। বিকৃত রাজনৈতিক দর্শন আমাদের এখনো হানা দেয়। জ্বালাও পোড়াও হরতালের মধ্য দিয়ে জাতিকে পেছনে ঠেলতে চায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী শক্তি। রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে শিক্ষার্থীদের জিম্মি করে বিকলাঙ্গ আরেকটি প্রজন্ম তৈরি করতে উš§ত্ত রয়েছে সাম্প্রদায়িক চেতনার অপশক্তি, যারা বাংলাদেশের মাটিতে থেকে পাকিস্তানের স্বপ্ন দেখে।
জনগণের ভোটের মর্যাদা নষ্ট করে বাংলাদেশকে তারা পাকিস্তানের রূপরেখায় গড়তে চায়। তাদের প্রকৃত চেহারা সচেতন সবার জানা। তারা, রাজনীতির নামে বছরের পহেলা দিন নতুন প্রজন্মের হাতে বিনামূল্যে বই বিতরণের দিন হরতাল ডাকে। গাড়ির চাকা বন্ধ করে ২৭ লাখ এসএসসি ও এইচএসসি শিক্ষার্থীর পরীক্ষা বাতিলের কর্মসূচি দেয়। নতুন প্রজন্মের হাতে শিক্ষার মশাল তুলে না দিয়ে অন্ধকার জগতে ধাক্কা মেরে ফেলতে চায়। তাদের এসব কর্মকাণ্ড আজ থেকে ৪০ বছর আগের ১৫ আগস্টের ট্র্যাজেডিকেই বারবার মনে করিয়ে দেয়।
সব কিছুকে ছাপিয়ে বঙ্গবন্ধুর আদর্শ সদা সূর্যের মতো উদীয়মান। বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আওয়ামী লীগ আজ বাংলাদেশ বিশ্বের মানচিত্রে উন্নয়নের রোল মডেল হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। দীর্ঘ একুশ বছর যে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগকে বিএনপি-জামায়াত জোট রাজনৈতিকভাবে পঙ্গু করে দিতে চেয়েছিল, জননেত্রী শেখ হাসিনা তাঁর সুকঠিন নেতৃত্ব দিয়ে সেখান থেকে মুক্ত করে এনেছেন। বাংলাদেশ আজ ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ নয় বরং টেকসই একটি অর্থনৈতিক ভিতের ওপর দাঁড়ানো মজবুত বাংলাদেশ।
বিশ্বব্যাংক ঘোষিত নি¤œ মধ্যম আয়ের দেশ। জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৬.২ শতাংশ। বাংলাদেশের বৈদেশিক রিজার্ভ এখন ২৫ বিলিয়ন ডলার। বাংলাদেশ এখন নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বিশাল প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে পারে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার জননেত্রী শেখ হাসিনা তথ্যপ্রযুক্তিকে উন্মক্ত করে জনগণের প্রতি দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করে দ্রুত সেবা দেয়ার কাজ করে যাচ্ছেন। আওয়ামী লীগ সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে দীর্ঘদিনের ছিটমহলবাসীর অধিকার আদায় করতে পেরেছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের জীবনমান উন্নয়নের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বাংলাদেশকে গড়ে তোলার লক্ষ্যে নতুন প্রজন্মের হাতে প্রয়োজনীয় সব কিছু তুলে দেয়া হচ্ছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকারের মাধ্যমে। বঙ্গবন্ধুর দল আওয়ামী লীগ অবশ্যই বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলবেই। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এই দেশ-জাতির কাছে (কিছুসংখ্যক স্ববিরোধী ও স্বজাতদ্রোহীর কথা বাদ দিয়ে) ভবিষ্যতেও অনুপ্রেরণা ও আদর্শের প্রতীক হয়েই থাকবেন। চিরঞ্জীব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সব কর্মকাণ্ডই ইতিহাসের আলোকিত অধ্যায়।
লেখক: সংসদ সদস্য