“আজ রাতে রঙিন হবে উপকূলের আকাশ”মিলন কর্মকার রাজু , কলাপাড়া (পটুয়াখালী) প্রতিনিধি :: আজ (বুধবার) সন্ধায় রঙিন হবে উপকূলের আকাশ। আকাশ প্রদীপের আলোয় দূর হবে অন্ধকার ও সকল পাপ। তাই রাতের অন্ধকার আকাশ কে রং বে-রংয়ের আলোয় আলোকিত করতে ব্যস্ত সময় পার করছে কলাপাড়ার রাখাইন পল্লীর যুবক-বৃদ্ধরা। নানান রংয়ের ফানুস (আকাশ প্রদীপ) উড়িয়ে রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রবারনা পূর্নিমা উৎসবকে ঘিরে রাখাইন পল্লীসহ গোটা উপজেলায় চলছে উৎসবের আমেজ।

উপকূলের মানুষের এই উৎসবের প্রস্তুতি কলাপাড়ার প্রতিটি রাখাইন পাড়ায়।

প্রায় চার শতাধিক “ফানুস” (রাখাইন ভাষায় মিম্বু) উড়ানোর প্রস’তি ও বানানোর কৌশল দেখতে প্রতিটি পাড়ায় ভীড় করছে শতশত মানুষ। প্রবারণা উৎসবের দিন সমাপনোত্তর ফানুস উড়িয়ে বৌদ্ধরা বিশ্বের সকলের সুখ,শান্তিও সুখ কামনা করেন।

কলাপাড়া পৌর শহর থেকে প্রায় ২০ কিলোমিটার দূরের গ্রাম বৌলতলীপাড়া। এক যুগ আগেও অর্ধ শতাধিক পরিবার ছিলো এখানে। বর্তমানে মাত্র ১৬ টি পরিবার। রাখাইন এই পাড়া থেকে কার্তিক মাসের প্রবারনা পূর্নিমা তিথিতে শতশত ফানুস উড়ানো হতো। আর্থিক দৈন্যতা ও লোকবলের অভাবে শুধু ধর্মীয় উৎসব পালনের রীতি অনুযায়ী এবার ৩০ টি ফানুস তৈরি করা হয়েছে।

ফানুস তৈরি প্রধান কারিগর রাখাইন যুবক মংমেন(৩৫) জানালেন, প্রায় পাঁচ হাজার টাকা খরচ হয়েছে তাদের। তিনিসহ স্কুল ছাত্র সানলেন ও মংচিংফ্রু তাকে সহায়তা করেছে এই ফানুস তৈরিতে। নানান রংয়ের কাগজ, বাঁশের ছাচানো চেড়া, গুনা দিয়ে একেকটি ফানুস তৈরি করতে ৫/৭ ঘন্টা সময় লাগে। গত ১৩ দিনে তারা তৈরি করেছেন ৩০ টি ফানুস।

রাখাইন অধ্যুষিত হাড়িপাড়া গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, ঘরের নিচের ফ্লোরে বসে ফানুস তৈরি করছে রাখাইন যুবক নেছানচু, মহাংচি ও উবালেন। তাদের এই ফানুস তৈরি দেখছে পাড়ার নারী ও শিশুরা। গত চারদিনে তারা ১৫ টি ফানুস তৈরি করেছেন।

নেছানচু রাখাইন জানালেন, “এ্যাহন কি আর আমাগো হেই দিন আছে। আগে ৩/৪ দিন ধইর‌্যা এই উৎসব চলতো। ৩০/৫০ ফুট সাইজের ফানুস উড়াইতাম। এই উৎসবে পিঠা-পায়েশ খাওয়ার ধুম পড়তো। আমাগো আর হেই অবস্থাও না, আর হেই উৎসবও হয় না। এ্যাহন ধর্মীয় রীতি ধরে রাখতে পোলা মাইয়াগো ধর্মীয় কালচারে ধইর‌্যা রাখতে নাম মাত্র এই আয়োজন।

হাড়িপাড়া গ্রামে ফানুস তৈরি দেখতে আসা স্কুল ছাত্রী নম্রতা মুন জানায়, আকাশে ফানুস উড়তে দেখেছি দূর থেকে। স্কুল বন্ধ তাই আজ ফানুস তৈরি দেখতে এলাম। আকাশে উড়ন্ত ফানুসের সৌন্দর্যে মুগ্ধ নম্রতার কাছে এটা তৈরিতে যে এতো কষ্ট তা জানা ছিলো না।

রাখাইনদের বিশ্বাস, স্বর্গের দেবরাজ ইন্দ্র কতৃক স্থাপিত গৌতম বুদ্ধের চুলামনি জাদীকে এই প্রবারনা তিথিতে দেবতারা এখনো পূজা করেন। তাই তারা প্রবারণা পূর্ণিমার দিন ফানুস উড়িয়ে পূজা করেন। ফানুস উড়ানোর অর্থ ঐ চুলামনি জাদীর প্রদীপ পূজা করা। মন্দিরে বুদ্ধকে প্রদীপ পূজা করা হয় প্রতিদিনই।

কিন্তু স্বর্গের চুলামনি জাদীর উদ্দেশ্যে ফানুস উড়িয়ে আকাশে তুলে পূজা করেন তারা এই পূর্নিমা তিথিতে।

পক্ষিয়াপাড়া রাখাইন পাড়ার বয়োবৃদ্ধ তেনথান মং জানান, প্রবারনার শাব্দিক অর্থ প্রকৃতরুপে বারণ বা নিষেধাজ্ঞা। সেই নিষেধাজ্ঞা হলো আচরণীয় ক্ষেত্রে ত্রুটি নৈতিক স’লন এবং সর্বোপরি চিত্তের মল (লোভ, বিদ্বেষ ও মোহ)। এগুলোর নিরোধমূলক অঙ্গীকারাবদ্ধ থাকলে এগুলো সম্পর্কে সচেতন থাকা যায়।

প্রকৃত অর্থে এগুলোই হলো (লোভ,বিদ্বেষ ও মোহ) মানুষের অভীষ্ট লক্ষ্য অর্জনে মূল অন্তরায়। এই অন্তরায় হতে দুরে থাকার জন্য দরকার চঞ্চল চিত্তের পরিশুদ্ধ অবলম্বন। তাই ‘প্রবারণার’ আর একটি অর্থ হলো ‘বরণ’ অর্থাৎ শুভ, শুদ্ধ, সুন্দর ও সু-আচারকে বরণ। বৌদ্ধ পরিভাষায় বলা যায় অ-কুশলকে বারণ এবং কুশলকে বরণই হলো প্রবারনা।

বৌলতলী পাড়ার অংচংচিং কবিরাজ (৭০) জানান, প্রবারনা পূর্নিমা বৌদ্ধ ধর্মীয় অনুশাসনের অন্যতম এক উৎসব। এটি গৌতম বুদ্ধ তাঁর ভিক্ষু সংঘের জন্য প্রবারনা অনুজ্ঞা প্রদান করেছিলেন। ভিক্ষু তিন মাস বর্ষাবাস ব্রত পালনোত্তর আসে প্রবারনা। শ্রদ্ধা, ধর্মীয় মর্যাদায় ও আন্তরিক অনুশীলনের মাধ্যমে ভিক্ষুসংঘের ধর্মাচারের ধারায় গুরুত্বে সাথে এই উৎসব পালিত হচ্ছে। কলাপাড়া উপজেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা এই উৎসবে উপস্থিত থাকবেন বলে রাখাইন সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরা জানান।

কলাপাড়ার রাখাইন পল্লী তুলাতলী পাড়া, পক্ষিয়াপাড়া, বেতকাটা পাড়া, বৌলতলী পাড়া, মিশ্রিপাড়া, আমখোলা পাড়া, কালাচাঁন পাড়া, কেরানীপাড়া, নয়াপাড়া, নাইয়রী পাড়া, চৈয়াপাড়া ও হাড়িপাড়া থেকে বুধবার সন্ধায় একসাথে উড়ানো হবে চার শতাধিক আকাশ প্রদীপ (ফানুস)।

কলাপাড়া থানার ওসি(তদন্ত) মো. মনিরুজ্জামান জানান, এই ফানুস উড়ানো উৎসবে যাতে কোন অপ্রীতিকর ঘটনা না ঘটে এজন্য প্রতিটি রাখাইন পাড়ায় পুলিশের টহল থাকবে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here