miladunnobiইউনাইটেড নিউজ ডেস্ক :: আজ ১২ রবিউল আউয়াল পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.)। আল্লাহর প্রিয় রসুল মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে (১২ রবিউল আউয়াল) পৃথিবীতে আগমন করেন।  ৬৩ বছর বয়সে ঠিকেএ দিনেই তিনি পরলোক গমন করেন। তাই মুসলিম জাহানের জন্য স্মরণীয় দিন আজ।

 

রবিউল আউয়াল আরবি বছরের প্রথম মাস। এ মাসের ১২ তারিখ আল্লাহ্ তায়ালার সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি, যাকে সৃষ্টি না করলে একটি ধূলিকণাও সৃষ্টি করতেন না, সেই শ্রেষ্ঠ মানুষ, মুক্তির দিশারী মুহাম্মদ (সা.) এর ধরায় আগমনের দিন।

 

আজ থেকে ১ হাজার ৪৪৫ বছর আগে অর্থাৎ ৫৭০ খ্রিস্টাব্দের ১২ রবিউল আউয়াল সোমবার সুবহে সাদিকের মুহূর্তে মক্কার বিখ্যাত কুরাইশ বংশে মা আমিনার গর্ভে তিনি জন্ম গ্রহণ করেন। মুহাম্মাদ (সা.) এর জন্মের আগে তার জন্মদাতা আব্দুল্লাহ মারা যান। জন্মের পর মাত্র ৬ বছরে হারান জন্মদাত্রী মাতাকেও। মাতা-পিতাহীন মুহাম্মাদ (সা.) শিশু ও বাল্যকালে চরম কষ্ট সহ্য করে দাদা আব্দুল মুত্তালিবের গৃহে লালিত-পালিত হন । তার এ আশ্রয়ও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি।

 

দাদা আব্দুল মুত্তালিবের মৃত্যুর পর মুহাম্মাদ (সা.) তার চাচা আবু তালিবের তত্ত্বাবধানে বেড়ে ওঠেন। কুরাইশ বংশ তৎকালীন মক্কার সম্ভ্রান্ত বংশ হলেও মুহাম্মাদ (সা.) এর দাদা কিংবা চাচারা আর্থিকভাবে স্বচ্ছল ছিলেন না। মুহাম্মাদ (সা.) বাল্যকালে চাচার তত্ত্ববধানে থাকাকালীন পারিশ্রমিকের বিনিময়ে অন্যের বকরি-ভেড়া চড়াতেন। রাখাল থাকা অবস্থাতেই মুহাম্মাদ (সা.) এর মাঝে চারিত্রিক দৃঢ়তা, বিশ্বস্ততা ও বিভিন্ন গুণ প্রকাশ পেতে থাকে।

 

হজরত ঈসা (আ.) কে পৃথিবী থেকে তুলে নেওয়ার পর দীর্ঘকাল কোনো নবী বা রাসুল না থাকায় দুনিয়াবাসী পাপের অন্ধকারে চরমভাবে নিমজ্জিত হয়। জঘণ্য অপরাধে লিপ্ত হয় মানুষ। এক প্রতিকূল পরিবেশে মুহাম্মাদ (সা.) এর পৃথিবীতে আগমন। এমন চ্যালেঞ্জের যুগেও মুহাম্মাদ (সা.) উন্নত চরিত্রর জন্য আল-আমিন তথা বিশ্বাসী উপাধিতে ভূষিত হন।

 

যুবক বয়সে আরবের অন্যতম শীর্ষ ব্যবসায়ী হজরত খাদিজা (রা.) এর ব্যবসা দেখাশুনা করেন। মুহাম্মাদ (সা.) এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যে এবং ব্যবসায়িক কৃতকর্মে খুশি হয়ে হজরত খাদিজা (রা.) মুহাম্মাদ (সা.) এর প্রতি আকৃষ্ট হন এবং বৈবাহিক বন্ধনে আবদ্ধ হন। এ সময় মুহাম্মাদ (সা.) এর বয়স ২৫ বছর এবং খাদিজা (রা.) এর বয়স ছিল ৪০ বছর ।

 

মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স যখন ৪০ বছরের কাছাকাছি তখন নবুওয়াত প্রাপ্তির লক্ষণ তার মধ্যে পরিলক্ষিত হতে শুরু করে। তিনি বিচলিত হয়ে পড়েন এবং মুক্তির পথ খুঁজতে থাকেন। এ সময় মুহাম্মাদ (সা.) উঁচু হেরা পর্বতের গুহায় ধ্যান আরম্ভ করেন। অবশেষে আসে সে কাঙ্ক্ষিত দিন, আল্লাহ তায়ালা অবতীর্ণ করতে শুরু করেন মহাগ্রন্থ আল-কুরআন। হজরত মুহাম্মদ (সা.) এর বয়স যখন ঠিক চল্লিশ বছর তখন আল্লাহর পক্ষ থেকে তিনি রেসালাতের দায়িত্ব অর্জন করেন।

 

রেসালাত ও নবুওয়াতের দায়িত্ব প্রাপ্তির পর হযরত মুহাম্মাদ (সা.) মানুষকে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে আশ্রয় নেওয়ার জন্য আহবান করতে শুরু করেন। মহানবীর দাওয়াতে সাড়া না দিয়ে উল্টো হজরত মুহাম্মাদ (সা.)কে তার পথ থেকে সরে আসার প্রস্তাব দেয়। শুরু হয় মুহাম্মাদ (সা.) এর ওপর নির্যাতন। এমনকি হত্যা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত হয়। আল্লাহ কাফেরদের ষড়যন্ত্রের কথা তার প্রিয় বন্ধুকে অবহিত করে তাকে মক্কা ছেড়ে মদিনায় হিজরত করার আদেশ দেন ।

 

নবুওয়াতপ্রাপ্তির মাত্র ১২ বছর অতিবাহিত হতে না হতেই একান্ত অনুচর বন্ধুবর আবু বকরকে (রা.) কে নিয়ে মক্কা ছেড়ে মদিনা অভিমুখে যাত্রা করেন। পবিত্র মদিনা শরিফকে একটি কল্যাণ রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা করেন এবং তিনি এ রাষ্ট্রের রাষ্ট্রপ্রধানের দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে ধীরে ধীরে ইসলাম ধর্মের বিস্তৃতি হতে থাকে। দলে দলে মানুষেরা শান্তির স্পর্শ পেতে ইসলামের সুশীতল ছায়াতলে প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে মুসলমানদের শক্তি বৃদ্ধি পেতে থাকে ।

 

৬৩০ খ্রিষ্টাব্দ মোতাবেক ৮ হিজরিতে আল্লাহর নির্দেশে মুহাম্মাদ (সা.) দশ সহস্রাধিক সৈন্য নিয়ে মক্কা বিজয় করেন। যে সকল মানুষগুলো মুহাম্মাদ (সা.)এর উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছিল তাদেরও তিনি সাধারণ ক্ষমা ঘোষণা করেন। মক্কা বিজয়ের পরে মুহাম্মাদ (সা.) আবারো মদিনায় ফিরে যান। ৬৩২ খ্রিষ্টাব্দে হজ্জ পালনের উদ্দেশ্যে পুনরায় মুহাম্মাদ (সাঃ) মদিনায় গমন করেন। মদিনায় হজ্জ কালীন সফরের মধ্যেই আল্লাহ তাআলা তার প্রতি নাজিল করেন- ‘আজ আমি তোমাদের দ্বীনকে তোমাদের জন্য পূর্ণ করে দিলাম, এবং আমার নেয়ামতকে তোমাদের ওপর পরিপূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্য ধর্ম হিসেবে মনোনীত করে দিলাম’। এ আয়াত অবতীর্ণ হওয়ার পর সাহাবীরা অঝোর ধারায় কাঁদতে শুরু করলেন। তখন রাসুল (সা.) তাদের জিজ্ঞাসা করলেন, তোমরা কাঁদো কেন ? সাহাবীরা বললেন আমরা বুঝতে পারছি, অচিরেই আল্লাহ আপনাকে তার মেহমান করে নিবেন। কেননা কোনো জিনিস পূর্ণতা পাওয়ার পর সেটা কমতে শুরু করে । যেহেতু ইসলাম পূর্ণতা পেয়েছে তাই আপনাকে আর আমাদের মধ্যে রাখা হবে না । হজ পালন শেষে হযরত মুহাম্মাদ (সা.) তার সঙ্গীদের নিয়ে মদিনায় চলে আসেন ।

 

অবশেষে আসে দুঃখের দিন, শোকের দিন । শিরঃপীড়ায় আক্রান্ত হয়ে ৬৩২ খ্রিস্টাব্দ তথা ১০ হিজরি সনের ১২ রবিউল আউয়াল মাসের সোমবার পৃথিবীর মানুষকে দুঃখের সাগরে ভাসিয়ে ইহলোক ত্যাগ করেন।

 

যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশসহ গোটা মুসলিম বিশ্বে যথাযথ মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে উদযাপন করা হবে এই পবিত্র দিনটি। আজকের দিনটি ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা রোজা পালন, নফল নামাজ আদায়, মিলাদ মাহফিল, পবিত্র কোরআন তিলাওয়াত ও ফাতেহা পাঠের মধ্য দিয়ে মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কে স্মরণ করবেন।

বাংলাদেশেও বিভিন্ন সংগঠন যথাযোগ্য মর্যাদা ও ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে এই দিনটি পালনে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে।

 

কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে মহানবীর (সা.) জীবন নিয়ে আলোচনা, দোয়া মাহফিল,  কোরআনখানি, মিলাদ মাহফিল এবং ধর্মীয় শোভাযাত্রা।

 

ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সংসদে বিরোধীদলীয় নেতা বেগম রওশন এরশাদ, জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া পৃথক বাণী দিয়েছেন।

 

রাষ্ট্রপতি তারা বাণীতে বলেন, ‘মহান আল্লাহ সমগ্র বিশ্বজগতের রহমত হিসেবে হজরত মুহম্মদ (সা.) কে এ জগতে প্রেরণ করেন। সর্বশেষ মহাগ্রন্থ পবিত্র কোরআন তার কাছে অবতীর্ণ করে জগতে তাওহিদ প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব অর্পণ করেন।’

 

প্রধানমন্ত্রী তার বাণীতে বলেন, ‘বিশ্বনবী হজরত মুহম্মদ (স.) এর অনুপম শিক্ষা অনুসরণের মাধ্যমেই বিশ্বের শান্তি ও কল্যাণ নিশ্চিত হতে পারে।’

 

ঈদে মিলাদুন্নবী উপলক্ষে  আজ রোববার সরকারি ছুটি। বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক এ উপলক্ষে বিশেষ ক্রোড়পত্র প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন, বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেল ও রেডিও এ উপলক্ষে বিশেষ অনুষ্ঠানমালা প্রচার করবে।

 

কর্মসূচি

জশনে জলুস : আশেকানে মাইজভাণ্ডারী অ্যাসোসিয়েশন ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আনন্দ মিছিলের আয়োজন করেছে। রাজধানীর শাহজাহানপুর রেলওয়ে ময়দান থেকে বেলা সাড়ে ১১টায় মাওলানা সৈয়দ মুজিবুল বশর মাইজভাণ্ডারীর নেতৃত্বে আনন্দ মিছিল শুরু হবে। এর আগে সকাল ৯টায় এখানে আলোচনাসভা হবে। আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাত ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে জশনে জলুস করবে। এর আগে শাহজাহানপুর রেলওয়ে ময়দানে ঈদে মিলাদুন্নবীর (সা.) বিভিন্ন কর্মসূচির উদ্বোধন করা হবে। এতে উপস্থিত থাকবেন শিল্পমন্ত্রী আমির হোসেন আমু, বিমান ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সাবেক মন্ত্রী ড. আবদুল মঈন খান। আশেকান গাউছিয়া মাইজভাণ্ডারীয়ার উদ্যোগে মিলাদ ও দোয়া মাহফিল এবং জশনে জলুস বের হবে।

 

ইসলামিক ফাউন্ডেশন : বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদের পূর্ব চত্বরে শনিবার পক্ষকালব্যাপী অনুষ্ঠানমালার উদ্বোধন করেন ধর্মবিষয়ক মন্ত্রী অধ্যক্ষ মতিউর রহমান। অনুষ্ঠানমালার মধ্যে রয়েছে প্রতিদিন ওয়াজ মাহফিল, সেমিনার, ইসলামি ক্যালিগ্রাফি, মহানবীর (সা.) জীবনভিত্তিক পোস্টার ও গ্রন্থ প্রদর্শনী, ইসলামি বইমেলা, ইসলামি সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা, বুদ্ধিপ্রতিবন্ধী ও অটিস্টিক ছেলেমেয়েদের জন্য বিশেষ অনুষ্ঠান, কিরাত ও হামদ-নাত প্রতিযোগিতা, রসুল (সা.) এর শানে কবিতা পাঠের আসর ইত্যাদি।

 

সুপ্রিমকোর্ট মাজার জামে মসজিদ : হজরত শাহ খাজা শরফুদ্দিন চিশতি (রহ.) এর দরবারে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে শনিবার থেকে শুরু হয়েছে দুই দিনব্যাপী কর্মসূচি। এর মধ্যে মধ্যে রয়েছে কোরআন তিলাওয়াত, হামদ-নাত ও বাদ মাগরিব ওয়াজ মাহফিল। এ ছাড়া আজ রোববার মাজার মসজিদের নতুন ভবনের উদ্বোধন করবেন প্রধান বিচারপতি মো. মোজাম্মেল হোসেন।

 

এ ছাড়া জাতীয় প্রেসক্লাবের উদ্যোগে পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে আলোচনাসভা ও দোয়া মাহফিল নিজস্ব মিলনায়তনে আজ বাদ আসর অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগ এ উপলক্ষে মিলাদ মাহফিল ও দোয়া অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে। জাতীয়তাবাদী ওলামা দলের পরিচালনায় বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের নিচ তলায় দোয়া ও মিলাদ মাহফিল অনুষ্ঠিত হবে। এ ছাড়া পবিত্র ঈদে মিলাদুন্নবী (সা.) উপলক্ষে ঢাকা মহানগরীসহ সারা দেশে বিভিন্ন মসজিদে ওয়াজ ও দোয়া মাহফিলের আয়োজন করা হয়েছে।

 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here