সাতক্ষীরায় স্বাধীনতার ৪০ বছর পেরোলেও অনেক গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা হয়নি। অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে সেগুলো। অনেকে জানেন না সেই গণকবর ও বধ্যভূমির ইতিকথা। এ ব্যাপারে তেমন কোন উদ্যোগ নেই সংশ্লিষ্ট কারো। প্রতি বছর মার্চ আসলেই শহীদদের বীরত্বগাঁথা তুলে ধরেন বিভিন্ন বক্তারা। স্মৃতিচারণ করে করা হয় নানা অনুষ্ঠান। স্বজনেরা তাঁদের কথা স্মরণ করেন। বোঁধ করেন স্বজনের অভাব। নীরবে ফেলেন চোখের জল। শুধু এ পর্যন্তই। এরপর প্রায় অনুচ্চারিতই থেকে যায় শহীদ বীর সন্তানদের কথা।
সূত্র জানায়, জেলার বর্তমান সরকারি উচ্চ বিদ্যালয়ের পিছনে, বাকাল ব্রিজ সংলগ্নসহ বিভিন্ন এলাকায় গণকবর রয়েছে। যুদ্ধকালীন সময়ে এখানে ৮/১০ টি সম্মুখ যুদ্ধ ও পাক বাহিনীর এলোপাতাড়ি হামলায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিকামী মানুষ শহীদ হন। সূত্র মতে, কলারোয়া উপজেলায় ৯টি গণকবরের অস্তিত্ব মোটামুটি খুঁজে পাওয়া যায়। সেগুলো হলোঃ উত্তর মুরারীকাটি পাল পাড়ায় (৯ জন), কলারোয়া ফুটবল ময়দানের দক্ষিণে (৫ জন), বালিয়াডাঙ্গা বাজারে (৭ জন), ভাদিয়ালিতে (৪ জন), গয়ড়া বাজারে (২ জন) সোনাবাড়িয়া মোড়ে (৩ জন) , সোনাবাড়িয়া মঠমন্দির এলাকায় (৩ জন), বামনখালি ঘোষ পাড়ায় (৩ জন) এবং কলারোয়ার পার্র্শ্ববতী জামতলায় (৫ জন)। ‘৭১ এর ৩০ এপ্রিল কলারোয়ার উত্তর মুরারীকাটি পাল পাড়ায় প্রথম গণ হত্যা চালানো হয়।
পাক সেনারা ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে বৈদ্যনাথ পাল, রঞ্জন পাল, বিমল পালসহ ৯ জনকে। তাদেরকে একই গর্তে ফেলে মাটি চাপা দিয়ে যায় পাক সেনারা। বধ্যভূমিটি আজও সংরক্ষণ করা হয়নি। কলারোয়ার বালিয়াডাঙ্গা বাজারের গণকবরে হাফিজ, জাকারিয়া, ইমাদুলসহ ৭ জন শহীদ চিরনিদ্রায় শায়িত রয়েছেন। ভাদিয়ালি গ্রামের সীমান্ত নদী সোনাই এর তীরে সমাহিত করা হয় ইউসাসহ ৪ শহীদকে। লতা-পাতা ও আগাছায় ঢাকা পড়ে থাকা এই সব গণকবরের খবরও রাখে না স’ানীয় অনেক লোকজন। সোনাবাড়িয়া মোড়ের গণকবরে শায়িত শহীদদের পরিচয় অনেকেই জানেন না। বামনখালি ঘোষ পাড়ার গণকবরে রাজেন্দ্র ঘোষ, খগেন্দ্র ঘোষসহ ৩ শহীদকে মাটি চাপা দেয়া হয়। এই কবরটির তেমন কেউ খোঁজ রাখে না।
একই ভাবে মাটি চাপা দেয়া হয় সোনাবাড়িয়া মঠমন্দির সংলগ্ন গণকবরে হাজরা গাঙ্গুলিসহ ৩ জনকে। কলারোয়া পাঁচনল গ্রামের মতিয়ার ও রশিদকে পাক বাহিনী বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে শার্শার জামতলায় ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। অন্য ৫ শহীদের সাথে জামতলা গণকবরে তাদের সমাহিত করা হয়। বটগাছসহ বিভিন্ন গাছপালায় ঢাকা এই গণকবরটির অনেকে খোঁজ রাখে না। গয়ড়া বাজারের শহীদ মিনারের পিছনে চির নিদ্রায় শায়িত রয়েছেন শহীদ নূর মোহাম্মদ ও এলাহী বক্স। এই দুই মুক্তিযোদ্ধার কবরটি স’ানীয় উদ্যোগে মোটামুটি সংরক্ষণ করা হয়েছে। জানা যায়, কলারোয়ার মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিতে খুলনা থেকে আসা ৫ ছা্ত্রকে হামিদপুর থেকে আটক করে থানার পিছনে লাইনে দাঁড় করিয়ে পাক বাহিনী ব্রাশ ফায়ারে হত্যা করে। সেখানেই মাটির গর্তে তাদের পুঁতে ফেলে পাক বাহিনী।
এই গণকবরটি সংরক্ষণ করা হলেও তা অবহেলিত ও অপরিচ্ছন্ন অবস’ায় থাকতে দেখা যায়। পরিতাপের বিষয় হলো, স্বাধীনতা ও বিজয় দিবসেও অনেক গণকবরে জোটেনা ফুলের মাল্য সম্বলিত শ্রদ্ধাঞ্জলি। এছাড়া কলারোয়া উপজেলা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে অনেক শহীদ মুক্তিযোদ্ধার কবর। কলারোয়ার কপোতাক্ষ তীরবর্তী খোরদো-পাকুড়িয়া গ্রামে শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সোহরাব হোসেনের কবর রয়েছে। ওই এলাকায় লোকজনের কাছে খোঁজ নিয়েও অনেকে জানাতে পারেনি কবরটির সন্ধান।
মুক্তিযুদ্ধকালীন কমান্ডার মোসলেম উদ্দিন ও বর্তমান কমান্ডার গোলাম মোস্তফা, মুক্তিযোদ্ধা যুব কমান্ড’র মশিউর রহমান, ক.পা.ই সম্পাদক এ্যাড. শেখ কামাল রেজা ও কবি মন্ময় মনিরের মতে. আগামী প্রজন্মকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত করতে এখানকার সকল গণকবর ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ করা জরুরি ভিত্তিতে প্রয়োজন।
নাজমুল হক, সাতক্ষীরা