গত ২৪ ঘণ্টায় মৌলভীবাজারের চার উপজেলার বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও সিলেটের ওসমানীনগর ও জকিগঞ্জ উপজেলায় অবনতি ঘটেছে। অপরিবর্তিত রয়েছে সিলেটের কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজারের পরিস্থিতি। তবে জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাট উপজেলার পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হয়েছে। হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ ও বাহুবল উপজেলার বন্যা পরিস্থিতিও কিছুটা উন্নতির দিকে। সিলেট বিভাগের ওই ১২টি উপজেলায় অন্তত পাঁচ লাখ মানুষ বন্যার কবলে পড়েছে।

অবিরাম বর্ষণ ও উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে গত ১৩ জুন থেকে মৌলভীবাজারের মনু ও ধলাই নদের পানি বেড়ে বন্যাকবলিত হয় জেলার সদর, কমলগঞ্জ, কুলাউড়া ও রাজনগর উপজেলার ৩০টি ইউনিয়ন ও দুটি পৌরসভায় প্রায় দুই লাখ মানুষ। মনু নদের পানি ঢুকে সদর উপজেলার চারটি সরকারি খাদ্যগুদামে বিপুল পরিমাণ চাল ভিজে গেছে। বহু ঘরবাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও রাস্তাঘাট এখনো পানিতে তলিয়ে আছে। এ পর্যন্ত জেলায় আটজনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। বন্যার্তদের উদ্ধার তত্পরতায় অংশ নিয়েছে সেনাবাহিনী।

গতকাল সোমবার দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া মৌলভীবাজার পরিদর্শনে এসে সরকারি সব দপ্তর ও ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের নিয়ে বৈঠক করেন। বৈঠক শেষে মন্ত্রী জেলা শহরের বারইকোনার ভাঙন পরিদর্শন ও রাজনগর উপজেলার মনসুরনগরের আশ্রয় কেন্দ্রে ত্রাণসামগ্রী বিতরণ করেন।

পরে মন্ত্রী সাংবাদিকদের বলেন, ‘বন্যার ক্ষয়ক্ষতি নিজ চোখে দেখার জন্য আমি এসেছি। সব জেনেছি এবং দেখেছি। এখন ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের পাশে দাঁড়াতে হবে। যাদের ঘর ভেঙে গেছে তাদের ঘর নির্মাণের জন্য এক হাজার বান্ডিল টিন ও নগদ ৩০ লাখ টাকা এখনই বরাদ্দ দেওয়া হলো। বন্যার্তদের জন্য আরো যা যা লাগবে, সরকারের পক্ষ থেকে তা দেওয়া হবে।’ তিনি আরো বলেন, ‘রাস্তাঘাট, ব্রিজ, কালভার্ট মেরামত ও নির্মাণের জন্য সড়ক ও জনপথ বিভাগ, আর পানি নেমে গেলে ভেঙে যাওয়া বাঁধ মেরামতের জন্য পানি উন্নয়ন বোর্ড যাতে প্রয়োজনীয় বরাদ্দ দ্রুত সময়ে দেয় সেটা নিশ্চিত করা হবে।’

গত বুধবার থেকে মনু ও ধলাই নদের বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধের ১৮টি স্থানে ভাঙনের সৃষ্টি হয়। ওই সব ভাঙন দিয়ে পানি ঢুকে কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর উপজেলার ৪০ হাজার পরিবারের প্রায় দুই লাখ মানুষ বন্যাকবলিত হয়ে পড়ে। গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার দুটি নদেই পানি অস্বাভাবিকভাবে বাড়তে থাকে। জেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বৈঠক করে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা চায়। শুক্রবার রাতেই সেনাবাহিনীর চারটি টিম কমলগঞ্জ, কুলাউড়া, রাজনগর ও মৌলভীবাজার সদর এসে পৌঁছে। শনিবার থেকে সেনাবাহিনী স্পিডবোট দিয়ে পানিবন্দি মানুষকে উদ্ধার শুরু করে।

গত শনিবার রাতে শহরের পশ্চিম এলাকার বরইকোনাতে বন্যা প্রতিরক্ষা বাঁধ ভেঙে মৌলভীবাজার পৌরসভার তিনটি ওয়ার্ড প্লাবিত হয়। মৌলভীবাজার-সিলেট সড়কের প্রায় অর্ধকিলোমিটার স্থান পানিতে ডুবে যাওয়ায় সিলেটের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ হয়ে যায়। গতকালও সড়ক থেকে পানি না নামায় সিলেটের সঙ্গে সড়ক যোগাযোগ বন্ধ ছিল।

অন্যদিকে সিলেটের ওসমানীনগর এবং সীমান্তবর্তী জকিগঞ্জ উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। কানাইঘাট ও বিয়ানীবাজারের পরিস্থিতি অপরিবর্তিত থাকলেও উন্নতি হয়েছে জৈন্তাপুর ও গোয়াইনঘাটের পরিস্থিতি। জকিগঞ্জে কুশিয়ারা নদীর পানি বিপত্সীমার ১৯৬ সেন্টিমিটার এবং সুরমা নদীর পানি বিপত্সীমার ১৪৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বন্যায় উপজেলাগুলোর শতাধিক গ্রামে পানি ঢুকেছে। লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। রাস্তা তলিয়ে যাওয়ায় ভেঙে পড়েছে গ্রামীণ যোগাযোগ ব্যবস্থা। নিম্ন আয়ের মানুষ বেকার হয়ে পড়েছে। জেলায় ছয় উপজেলার প্রায় দুই লাখ মানুষ পানিবন্দি।

ওসমানীনগরে কুশিয়ারা নদীর ডাইক দুটি স্থানে ভেঙে ১০টি গ্রাম প্লাবিত হওয়া ছাড়াও উপজেলার সাদীপুর ইউনিয়নের সৈয়দপুর গ্রামের ডাইকের কালভার্ট পানির স্রোতে ভেঙে গেছে। এতে এই এলাকার সঙ্গে সদরের সড়ক যোগাযোগ বন্ধ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানায়, গত শনিবার রাতে ডাইকে ভাঙন দেখা দেয়। মুহূর্তেই তলিয়ে যায় একের পর এক গ্রাম। পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আরো গ্রাম প্লাবিত হবে বলে আশঙ্কা করছে তারা।

জকিগঞ্জ উপজেলার সার্বিক বন্যা পরিস্থিতির অবনতি হয়েছে। পুরো উপজেলা এখন বন্যায় আক্রান্ত। উপজেলার শতাধিক গ্রামের লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি রয়েছে। সুরমা-কুশিয়ারা নদীর ডাইক ভেঙে অন্তত ২৫টি স্থান দিয়ে এবং ডাইক উপচে হু হু করে পানি ঢুুকছে। এতে করে নতুন নতুন এলাকা দ্রুত প্লাবিত হচ্ছে। বন্যায় বসতবাড়ি, ফসলি জমি ছাড়াও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, বাজার ছাড়াও শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পানিবন্দি হয়ে গেছে। জকিগঞ্জ সদর ইউনিয়নের ২৩টি গ্রামের মধ্যে ২১টি গ্রামের মানুষই পানিবন্দি।

অন্যদিকে কুশিয়ারা নদীর পানি বেড়ে প্লাবিত হওয়ায় হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ উপজেলার ইনাতগঞ্জ ও দীঘলবাক ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এ ছাড়া ভারি বর্ষণে উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ি ঢলে বাহুবল উপজেলার ৩০টি গ্রামের হাজার হাজার পরিবার পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। এসব গ্রামের মানুষ মানবেতর জীবনযাপন করছে। দুই উপজেলায় লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় রয়েছে।

গত শনিবার থেকে কুশিয়ারা প্রতিরক্ষা বাঁধের পাহাড়পুর, ঢালারপাড়, হুসেনপুর, জামারগাঁও এলাকায় ভাঙন দিয়ে পানি প্রবেশ করছে। বন্যাকবলিত এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কষ্ট করে নিজেদের ভিটেতে চৌকি বা মাচায় অবস্থান করছে। এখন পর্যন্ত কোনো সরকারি ত্রাণসামগ্রী বিতরণের কোনো খবর পাওয়া যায়নি। সিলেটের সঙ্গে নবীগঞ্জের ভাটি অঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ বিচ্ছন্ন রয়েছে।

বাহুবল উপজেলার অন্তত ৩০টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এসব গ্রামে সদ্য রোপণ করা আউশ ধান, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শতাধিক পুকুরের মাছ পানিতে ভেসে গেছে। লোকজনের বসতঘরে হাঁটুপানি থাকায় চুলায় আগুন দেওয়ার সুযোগ নেই। ফলে মানবেতর জীবন যাপন করছে হাজার হাজার পরিবারের লোকজন। এসব এলাকায় এখনো কোনো ত্রাণ পৌঁছেনি।

হবিগঞ্জ শহরের পাশ দিয়ে প্রবাহিত খোয়াই নদীর পানি বিপত্সীমার ২৬০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হওয়ায় জনমনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here