স্বাধীনতার শতবর্ষ পূর্তিতে ফিনল্যান্ডে স্বপ্নময় উৎসবজামান সরকার, ফিনল্যান্ড থেকে :: ৬ ডিসেম্বর যথাযথ মর্যাদা ও ভাবগাম্ভীর্যের মধ্য দিয়ে ফিনল্যান্ডে উদযাপিত হলো দেশটির ১০০তম স্বাধীনতা দিবস। ১৯১৭ সালের এই দিনে ফিনল্যান্ড প্রজাতন্ত্র পার্শ্ববর্তী দেশ সোভিয়েত ইউনিয়নের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে।

সকাল ৮টায় পতকা উত্তোলন ও ফিনল্যান্ডের বিভিন্ন শহরের ময়দানে সশস্ত্র বাহিনীর কুচকাওয়াজের মাধ্যমে শুরু হয় দেশেটির ১০০তম স্বাধীনতা দিবস উদযাপনের।

দিবসের মূল আকর্ষণ ছিল ফিনিস প্রেসিডেন্টের প্রাসাদের জাঁকজকময় অনুষ্ঠানটি। সারাদেশের আধিকাংশ অর্থাৎ প্রায় ২৭ লক্ষ জনগণ এই  আয়োজনটি সরাসরি টেলিভিশনের পর্দায় উপভোগ করেন।

ফিনিশ প্রেসিডেন্ট সাউলি নিনিস্তো ও মিসেস নিনিস্তোর আমন্ত্রনে প্রায় ২০০০ অতিথি এই অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।  

আমন্ত্রিতদের মধ্যে  ছিলেন ফিনল্যান্ডের প্রাক্তন জীবিত প্রেসিডেন্টগণ, স্পীকার, প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রীপরিষদের সদস্যবর্গ, সকল পার্লামেন্ট মেম্বার, বিভিন্ন দেশের কূটনীতিক ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধান, পদস্থ সামরিক ও বেসামরিক কর্মকর্তাবৃন্দ, রাজনৈতিক ও সূধীজনেরা।

স্বাধীনতা দিবসের এইদিনে ফিনিস প্রেসিডেন্ট প্রাসাদে চলে সাধারণ মানুষের ধরাছোঁয়ার বাইরে অভিনব ও জাঁকজকমপূর্ণ এক উৎসব।

বাৎসিরক এই উৎসবে ঐতিহ্যবাহী রুচিশীল পোশাকে আমন্ত্রিতদের নিয়ে ম্যারাথন আলোচনা চলে সাধারণ আর অভিজাতদের কল্পনার জগতে।

অনুষ্ঠানে অতিথিদের পরিধান করে আসা কোনো কোনো পোশাকের দাম তিন লাখ ইউরো পর্যন্ত হতে পারে। এই অনুষ্ঠানের শানশৌকত দেখে মনে হয় সেই কথাটি মিথ্যে নয়- “জীবন ও উত্তেজনার সৌন্দর্য এমন এক বিষয়, যার জন্য অকাতরে পয়সা খরচ করতে খারাপ লাগে না৷”

আবার অতিথিদের পোশাকে যে শুধু আধুনিকতাতেই তুলে ধরা হয় তাও পুরোপুরি মেনে নেওয়া যায় না।

এতে থাকে অতীত, বর্তমান ও আধুনিক যুগের মিশ্রণ, আবার ভবিষ্যতের ছোঁয়াও থাকে।

এখানে সবাই নিজেকে মনোরম পোশাকে রূপ সজ্জিত করে থাকেন। গোটা ফিনল্যান্ড সেজে ওঠে আলোর রোশনাই আর ফুলের ডালিতে।

অবশ্য সারা বিশ্বেই সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় উৎসবের বিশেষ কদর রয়েছে। তাই দেশীয় ঐতিহ্যের প্রভাবে এটিকে কীভাবে আরও উপভোগ্য করে তোলা যায়, সেটি নিয়ে গবেষণাও চলে।

এদিন ধর্ম,বর্ণ ও সংস্কৃতি নির্বিশেষে সূধীজনের সমাগমে কোলাহলপূর্ণ আর সুস্বাদু খাবারের সুঘ্রাণে ভরপুর থাকে থাকে সমগ্র ফিনিশ আবহ, বদলে যায় উৎসবমুখর ফিনিস প্রেসিডেন্টের স্বপ্নময় অট্টালিকা ভবনটিও।

ফিনল্যান্ডে এদিনটি অন্যান্য দিন থেকে একটু আলাদা মনে হয়। আলোকমালায় উদ্ভাসিত প্রেসিডেন্টের অট্টালিকা দেখে যে কেউ যেন বুঝতে পারে, এখানেই একটি দেশের স্বাধীনতার উৎসব হচ্ছে।

নানা ধরনের খাবার-পানীয়ের পাশাপাশি পরিবেশিত হয় দেশের নামকরা শিল্পীদের নাচ-গান। অতিথিদের কাছে ফিনিস সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য তুলে ধরতেই এ উৎসবের আয়োজন করা হয়।

বুধবার সরকারি ছুটির দিনে স্বাধীনতা দিবসে এই দিনে ফিনল্যান্ডে সরকারি ও বেসরকারি ভবনসহ বিভিন্ন স্থানে জাতীয় পতাকা উত্তোলিত হয়। স্বাধীনতা যুদ্ধে শহীদদের শ্রদ্ধা নিবেদনে নির্দিষ্ট সময়ের নীরবতাও পালন করা হয়।

ফিনল্যান্ড উত্তর-পশ্চিম ইউরোপে বাল্টিক সাগরের উপকূলে অবস্থিত একটি রাষ্ট্র। ফিনল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে উত্তরে অবস্থিত দেশগুলির একটি। এর এক-তৃতীয়াংশ এলাকা সুমেরুবৃত্তের উত্তরে অবস্থিত। এখানে ঘন সবুজ অরণ্য ও প্রচুর হ্রদ রয়েছে। প্রাচীরঘেরা প্রাসাদের পাশাপাশি আছে অত্যধুনিক দালানকোঠা। দেশটির বনভূমি এর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্রাকৃতিক সম্পদ; এগুলিকে প্রায়ই ফিনল্যান্ডের “সবুজ সোনা” নামে ডাকা হয়। হেলসিঙ্কি ফিনল্যান্ডের রাজধানী ও বৃহত্তম শহর।

ফিনল্যান্ড একটি নিম্নভূমি অঞ্চল। কয়েক হাজার বছর আগেও এটি বরফে ঢাকা ছিল। বরফের চাপে এখানকার ভূমি স্থানে স্থানে দেবে গিয়ে হাজার হাজার হ্রদের সৃষ্টি করেছে। দেশটির সরকারি নাম ফিনল্যান্ড প্রজাতন্ত্র। তবে ফিনীয়রা নিজেদের দেশকে সুওমি বলে ডাকে। সুওমি শব্দের অর্থ হ্রদ ও জলাভূমির দেশ।

ফিনল্যান্ড উত্তর দিকে স্থলবেষ্টিত। উত্তরে নরওয়ে ও পূর্বে রাশিয়ার সাথে এর সীমান্ত আছে। দক্ষিণে ফিনল্যান্ড উপসাগর এবং পশ্চিমে বথনিয়া উপসাগর। ফিনল্যান্ডের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূলে হাজার হাজার ক্ষুদ্র, পাথুরে দ্বীপ আছে। এদের মধ্যে কতগুলিতে মনুষ্য বসতি আছে। এদের মধ্যে বথনিয়া উপসাগরের মুখে অবস্থিত অলান্দ দ্বীপপুঞ্জটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।

ফিনল্যান্ডের মেরু অঞ্চলে মে থেকে জুলাই পর্যন্ত প্রায় সবসময় দিন থাকে। “মধ্যরাতের সূর্যের” এই দিনগুলিতে ফিনল্যান্ডের নয়নাভিরাম উপকূলীয় এলাকাগুলিতে হাজার হাজার লোক নৌকা নিয়ে বেড়াতে আসে। ফিনল্যান্ডের মধ্যভাগের বনভূমিতে অনেক পর্যটক রোমাঞ্চকর অভিযানের টানে ছুটে আসে।

ফিনল্যান্ডকে সাধারণত স্ক্যান্ডিনেভিয়ার অংশ ধরা হয়, এবং স্ক্যান্ডিনেভিয়ার সাথে এর ঘনিষ্ঠ সম্পর্কও আছে। কিন্তু বহু শতাব্দী যাবৎ ফিনল্যান্ড বিরোধী শক্তি সুইডেন ও রাশিয়ার মধ্যে একটি সীমান্ত দেশ হিসেবেই বিদ্যমান ছিল। ৭০০ বছর সুইডেনের অধীনে শাসিন হবার পর ১৮০৯ সালে এটি রুশদের করায়ত্ত হয়। রুশ বিপ্লবের পর ১৯১৭ সালে এটি একটি স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে জন্ম নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ১৯৪৮ সালে ফিনল্যান্ড ও রাশিয়া বন্ধুত্ব ও সহযোগিতার একটি চুক্তি সম্পাদন করে এবং ১৯৯১ সাল পর্যন্ত দেশ দুইটির মধ্যে দৃঢ় অর্থনৈতিক বন্ধন ছিল। ১৯৯১ সালের পরে ফিনল্যান্ড ইউরোপমুখী হয় এবং ১৯৯৫ সালে ইউরোপীয় ইউনিয়নের পূর্ণ সদস্যপদ লাভ করে।

ফিনল্যান্ড ইউরোপের সবচেয়ে নবীন রাষ্ট্রগুলির একটি হলেও এর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ও স্বাতন্ত্র‌্য সুবিদিত। বিশেষত আধুনিক স্থাপত্যকলা ও শিল্পকারখানা ডিজাইনে ফিনল্যান্ডের সুনাম আছে। সাউনা তথা ফিনীয় ধাঁচের বাষ্পস্নান বিশ্ববিখ্যাত এবং এটি ফিনীয় দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ।

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here