সুপেয় পানি এবং সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনামোহাম্মদ যোবায়ের হাসান:: বাংলাদেশের উন্নয়ন, কল্যাণ ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় ধনী-গরিব বৈষম্য হ্রাস এবং সমাজের সবার অংশগ্রহণকে প্রাধান্য দিয়ে দেশ আজ নিম্নমধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। উন্নয়নের সঙ্গে সঙ্গে দেশ সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। সংবিধানের ১৯(১) অনুচ্ছেদে সব নাগরিকের জন্য সুযোগের সমতা বিধানের কথা বলা হয়েছে এবং এ ক্ষেত্রে বিভিন্ন সেবা প্রদানের মধ্যে পানি একটি অন্যতম সেবা খাত। কিন্তু এ খাতের উন্নয়নে যথেষ্ট গুরুত্বারোপ করা সত্ত্বেও অগ্রগতির মাপকাঠি একেক প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে একেক রকম।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর ‘বহুবিধ সূচক গুচ্ছ জরিপ’ (MICS) ২০১২-১৩-এর তথ্য অনুযায়ী, গ্রামের ৯৮ শতাংশ মানুষ পানি-সুবিধার আওতায় রয়েছে, যদিও দেশের প্রায় ১২ দশমিক ৪ শতাংশ মানুষ এখনো আর্সেনিকযুক্ত টিউবওয়েলের পানি পান করছে। অর্থাৎ পরিসংখ্যান হিসাবে এখনো ২ কোটি ৪ লাখ মানুষ নিরাপদ ও সুপেয় পানি থেকে বঞ্চিত। অন্যদিকে যৌথ পরিবীক্ষণ কর্মসূচি বা JMP ২০১৫ তথ্য অনুযায়ী, ৮৭ শতাংশ মানুষ নিরাপদ পানি-সুবিধার আওতায় রয়েছে। নিরাপদ পানির আওতাধীন জনসংখ্যার ক্ষেত্রে নানা ধরনের তথ্য-উপাত্ত থাকলেও পানির প্রয়োজনীয়তা মানুষের মৌলিক অধিকারের সমতুল্য।

পানি মানুষের মৌলিক অধিকারের বিষয় না হওয়ায় এটাকে কীভাবে জনগুরুত্বপূর্ণ খাত হিসেবে সবার নজরে নিয়ে আসা যায়, সে বিষয়ে বহু আলোচনা, সভা, সেমিনার ও জরিপ করার চেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এ খাতের মান উন্নয়নসহ সেবা কার্যক্রমের জন্য বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধির ক্ষেত্রেও অনেক সংস্থা ও প্রতিষ্ঠান ভূমিকা রাখছে।

বিশ্বের ৩০ শতাংশ স্থল ও ৭০ শতাংশ পানি। এর মাত্র ৩ শতাংশ মিষ্টি পানি (খাবার, পারিবারিক বিভিন্ন কাজ, কৃষিকাজ ও শিল্প খাতে উপযোগী) এবং বাকি ৯৭ শতাংশ লোনা পানি। সুপেয় ও নিরাপদ পানির জন্য সারা বিশ্বেই হাহাকার এবং সম্ভবত সে কারণেই বলা হয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ পানির কারণেই হবে। এ রকম পরিস্থিতিতে পানির অধিকার সংরক্ষণে আজ বিশ্বব্যাপী সবাই সোচ্চার। এই নদীমাতৃক দেশে আমরা সত্তরের দশক থেকেই ভূগর্ভস্থ পানির ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছি। টিউবওয়েল হচ্ছে আমাদের একমাত্র উৎস। এই বাস্তবতার পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ভূগর্ভস্থ পানির ওপর চাপ কমানোর লক্ষ্যে এবং পানি সংকটাপন্ন এলাকায় পানির প্রাপ্যতাসাপেক্ষে পানি আইন, ২০১৩-এ সুপেয় পানির উৎস হিসেবে দিঘি, পুকুর বা অনুরূপ জলাধার সংরক্ষণে বিশেষ জোর দিয়েছে।

পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশ পানি আইন, ২০১৩-এর অধীনে প্রণীত হয় খসড়া বাংলাদেশ পানি বিধিমালা-২০১৭। চতুর্দশ (১৪) অধ্যায়-সংবলিত এ খসড়া বিধিমালাটি শিগগিরই চূড়ান্ত হওয়ার পর্যায়ে আছে। এ আইন ও বিধিমালার মাধ্যমে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যবস্থাপনায় শৃঙ্খলা ফিরে আসার সম্ভাবনা থাকলেও ভূ-উপরস্থ পানি; বিশেষ করে পুকুর, জলাশয় ও নদী বা খালের পানিকে খাবারের পানি হিসেবে ব্যবহারের বিষয়ে বিস্তারিত আলোকপাত করা হয়নি। গভীর নলকূপ, সাবমারসিবল পাম্প ব্যবহারের মাধ্যমে অগভীর নলকূপের লাইসেন্স অথবা ছাড়পত্রের বিষয়ে নানা উদ্যোগ ও নিয়মের কথা বলা হয়েছে। যদিও পান করা বা গৃহস্থালি কাজের জন্য হস্তচালিত পাম্প অথবা হস্তচালিত গভীর নলকূপের মাধ্যমে পানি উত্তোলনের ক্ষেত্রে; লাইসেন্সের প্রয়োজনীয়তাকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এই পানি আইনের যথাযথ বাস্তবায়নের জন্য খসড়া বিধিমালা প্রণয়ন করা হয়, যা জনগণের দলিল। এখন প্রয়োজন সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরের মাধ্যমে যথাযথ বাস্তবায়ন ও তার জন্য প্রয়োজনীয় বাজেট বরাদ্দ রাখা। সম্প্রতি আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সংস্থা ওয়াটারএইডের গবেষণায় দেখা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে পানি, স্যানিটেশন ও হাইজিন খাতে মোট উন্নয়ন বাজেট ৪ হাজার ৮৪৮ কোটি টাকা; যা জাতীয় উন্নয়ন বাজেটের মাত্র ৪ দশমিক ৩১ শতাংশ এবং এই বরাদ্দের ৮৬ শতাংশ বাজেট বরাদ্দ রাখা হয়েছে শহরের জন্য এবং অন্যান্য এলাকার, বিশেষ করে গ্রামে মাত্র ১৪ শতাংশ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

বাজেট ২০১৭-১৮: সুপেয় পানি উন্নয়নে মানুষকেন্দ্রিক বা জনপ্রতি বরাদ্দ রাখার দাবি অনেক দিনের। এ বিবেচনায় বরাদ্দের পরিমাণ গ্রামেই বেশি হওয়া উচিত, যেহেতু জনসংখ্যার সিংহভাগ (৬৪ দশমিক ৪ শতাংশ) মানুষ এখনো গ্রামে বাস করে। আসলে জনপ্রতি বরাদ্দ বিবেচনায় বাজেট প্রণয়ন না হলে কার জন্য বরাদ্দ, কোথায় বরাদ্দ, কী উদ্দেশ্যে বরাদ্দ এবং জনগণ কীভাবে এ থেকে সুবিধা পাবে, তা নির্ধারণ করে সঠিক ও সময়োপযোগী পরিকল্পনা প্রণয়ন কষ্টসাধ্য বা টেকসই নাও হতে পারে।

এ ছাড়া এবারের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার (২০১৫-২০৩০) ১৭টি অভিষ্ট লক্ষ্যের প্রায় সব ক’টিতেই END এবং Ensure-এর কথা দৃঢ়তার সঙ্গে বলা হয়েছে। অর্থাৎ আগামী ১৫ বছরের মধ্যে অনেক বিষয়ের অর্জন নিশ্চিত করতে হবে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রার একটি লক্ষ্য (লক্ষ্য-৬) নির্ধারণ করা হয়েছে ‘সকলের জন্য পানি ও স্যানিটেশনের প্রাপ্যতা ও টেকসই ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা’ অর্থাৎ সর্বজনীন।

আশা করি, এ রকম অঙ্গীকার বাস্তবায়নে সরকার বদ্ধপরিকর এবং পানিসংক্রান্ত জাতিসংঘের উচ্চপর্যায়ের প্যানেলে প্রধানমন্ত্রী ১০ রাষ্ট্রপ্রধানের মধ্যে একজন অন্যতম সদস্য নির্বাচিত হওয়াটা তারই অনন্য একটি উদাহরণ। সুতরাং জাতীয় পর্যায়ে এবং বিশ্বদরবারে আমাদের অঙ্গীকার বাস্তবায়নের যথেষ্ট গুরুত্ব বহন করছে এবং সেই দায়িত্ব ও ইচ্ছা থেকেই অতিসত্বর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের প্রাক্কলিত ব্যয় নির্ধারণ করা প্রয়োজন। ব্যয় নির্ধারিত হলে আয় নির্ধারণ করা যাবে এবং সামগ্রিকভাবে বাজেট প্রণয়ন সম্ভব হবে।

টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের এক বছর (২০১৬) পেরিয়ে আমরা এখন দ্বিতীয় বছরে পদার্পণ করেছি এবং সময়োপযোগী পদক্ষেপ হিসেবে আগামী অর্থবছরের ২০১৭-১৮ বাজেটে এ লক্ষ্যমাত্রা সামনে রেখে কিছু পদক্ষেপ আশু প্রয়োজনীয়। উপকূলীয় অঞ্চল, বিশেষ করে নদীভাঙন এলাকা, লবণাক্তপ্রবণ, ঘূর্ণিঝড়প্রবণ এলাকাসহ হাওর ও বরেন্দ্র অঞ্চলের জন্য পানি ও সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার প্রয়োজনীয় ন্যায্যতাভিত্তিক বাজেট বরাদ্দ প্রয়োজন। উন্নয়ন বাজেটে গ্রামের জন্য উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে সুপেয় পানি এবং এর ব্যবস্থাপনা বরাদ্দ এখন সময়ের দাবি।

গ্রামীণ অর্থনীতিকে চাঙ্গা করতে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমিয়ে সুপেয় পানির প্রাপ্যতা, প্রবেশগম্যতা ও গুণাগুণ যেমন বাড়ানো প্রয়োজন, তেমনি সমন্বিত পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনাকে ফলপ্রসূ করতে টেকসই বিনিয়োগও দরকার। পানি প্রাপ্যতা ও প্রবেশগম্যতায় আমাদের অবস্থান ভালো থাকলেও পানির গুণগত মান বা বিশুদ্ধতায় আমরা ঝুঁকিতে রয়েছি। ইউনিসেফ ও বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাবে, সুপেয় পানির সুযোগবঞ্চিত জনসংখ্যার দিক দিয়ে আমাদের অবস্থান বিশ্বে সপ্তম। সে ক্ষেত্রে আমাদের এখনো অনেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে হবে এবং যার জন্য প্রয়োজন বিনিয়োগ ও পর্যাপ্ত বরাদ্দ।

একদিকে পানির অপর নাম জীবন, অন্যদিকে পানিবাহিত রোগের ফলে মৃত্যুর কারণও মানুষকে আজকাল ভাবায়। অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, বন্যা সবকিছুতেই পানি এবং পানিই জীবন। পানিকে জাতীয় উন্নয়ন ও সার্বিক কল্যাণের কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নানা আইন, বিধিমালা, কৌশলপত্র ও নানা পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়েছে এবং প্রয়োজনীয় আরও উদ্যোগ অব্যাহত রয়েছে।। বাংলাদেশ সরকারের দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনায় (২০১০-২১) সবার জন্য নিরাপদ সুপেয় পানি, উন্নত স্যানিটেশন সুবিধা ও স্বাস্থ্যবিধি বা হাইজিন ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতকরণ অগ্রাধিকারভুক্ত।

মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান
লেখক, মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান

বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০১৬-এ বলা হয়েছে, ২০১৫ সালে নিম্নদরিদ্রের হার ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (২০১৬-২০২০) ২০২০ সালের মধ্যে নিম্নদরিদ্রের হার ৮ দশমিক ৯ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়েছে। পানি ব্যবস্থাপনাকে গুরুত্ব না দিয়ে এ লক্ষ্য অর্জন সম্ভব নয়। পানি মানুষের প্রাত্যহিক জীবনযাপনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত এবং দারিদ্র্যতা নিরসনে পানির প্রাপ্যতাও ব্যবহারে ন্যায্যতাভিত্তিক এবং জনপ্রতি বরাদ্দ মানুষের আর্থসামাজিক জীবনের অনেক বিষয়কে প্রভাবিত করে। সুতরাং টেকসই লক্ষ্য বাস্তবায়নে রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রকল্প যেমন সামাজিক নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, প্রাথমিক স্বাস্থ্য ও পরিচর্যা বৃদ্ধি, সুপেয় পানি এবং খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতে পানিসম্পদের যথাযথ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি পদক্ষেপে পর্যাপ্ত বাজেট বরাদ্দ ও বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠা অত্যন্ত জরুরি।

 

লেখক: মোহাম্মদ যোবায়ের হাসান: গবেষণা ও পরিকল্পনা পরিচালক, ডরপ, ইমেইল: research@dorpbd.org 

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here