আ হ ম ফয়সল :: সংবাদ লেখার পূর্বে জানতে হবে কোনটি সংবাদ আর, কোনটি সংবাদ নয়। এ ধারনা দিতে তিনি প্রথমে একটি উদাহরণ দেন। ‘কুকুর মানষকে কামড়ালে সংবাদ হবে না, যদি মানুষ কুকুরকে কামড়ায় তাহলে এটি সংবাদ হবে’। যাকে আমরা বলি ‘নিউজ সেন্স’। নিউজ সেন্স থাকা সত্যি গুত্বপূর্ণ। হাতে-কলমে সংবাদ লেখার কৌশল শেখাতেন আমাকে। প্রতিদিন বিকেলের অপেক্ষায় থাকতাম। প্রতি দিনই তার কাছে যেতাম। প্রতিদিনই নতুন-নতুন কিছু শিখে বাড়ি ফিরতাম।
বলছি একজন সাংবাদিকতার প্রতিকৃত আহসান উল্যাহ মজুমদার’র কথা। একাধারে তিনি ছিলেন একজন সাংবাদিক, শিক্ষক ও চিকিৎসক। খুব অল্প সময়ের জন্য তাকে পেলেও যার ভালোবাসা পেয়েছি অনেক। হাতে কলেমে শিক্ষা পেয়েছি সাংবাদিকতা বিষয়ে। যেটুকু সময় তার পাশে কাটিয়েছি, সেটুকু সময়ই মনে হয়েছে শিক্ষা গ্রহণ করেছি। মফস্বলের একজন নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে আহসান উল্যাহ মজুমদারের বেশ সু-খ্যাতি ছিল। কোন অফিসের ধারে-ধারে ঘুড়ে বেড়াতে দেখা যায়নি তাকে।
লক্ষ্মীপুর জেলার রামগতি উপজেলার প্রবীণ সাংবাদিক ও রামগতি প্রেস ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ছিলেন আহসান উল্যাহ মজুমদার। আহসান উল্যাহ মজুমদার বিভিন্ন পত্রিকায় নিয়মিত লিখতেন। দৈনিক রূপালী, দৈনিক সংগ্রাম ও জেলা সদর লক্ষ্মীপুর থেকে বহুল প্রচারিত ‘সাপ্তাহিক এলান’ পত্রিকায় সংবাদ, কখনো কলাম লেখক, কখনো সম্পাদনা সহকারীর দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। অসাধারণ এই প্রতিভাবান ব্যক্তি বাংলা একাডেমির আজীবন সদস্যও ছিলেন। জনাব আহসান উল্যাহ মজুমদার সাংবাদিকতার পাশাপাশি রামগতি উপজেলার চর কোলাকোপা কারামতিয়া কামিল মাদ্রাসার শিক্ষকতা (বাংলা) করতেন। এ ছাড়া তিনি বিকেলে স্থানীয় জমিদার হাট বাজারের একটি দোকানে হোমিও ডাক্তারি করে এলাকায় বেশ সুনাম অর্জন করেছিলেন।
তার পরামর্শে তখন ভিন্ন কয়েকটি পত্রিকায় লিখতে শুরু করি। আহসান উল্যাহ মজুমদারের মাধ্যমে স্থানীয় সাংবাদিক রেজাউল হকসহ কয়েক জনের সাথে পরিচয় হয়। সবার সাথে পরিচয় ও সাংবাদিকতা কাজের প্রতি একনিষ্ঠতা দেখে তিন মাসের মাথায় আমাকে রামগতি প্রেস ক্লাবের কোষাধক্ষের দায়িত্ব দেন তিনি। তখন তিনি (আহসান উল্যাহ মজুমদার) সভাপতি, রেজাউল হক সাধারন সম্পাদক এর দায়িত্ব পালন করেন। অকৃপণ এই মহতী মানুষটির কাছে যতই যেতাম, ততই যেন কিছুনা কিছু শিখতাম। নতুন-নতুন বিষয়, নতুন-নতুন কথোপকথন/আলোচনায় শিখতাম তার কাছ থেকে।
নির্ভীক এই সাংবাদিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে স্বার্থহানীর রোষানলে পড়ে এরশাদ সরকারের আমলে বেশ কিছুদিন কারা জীবনও অতিবাহিত করেছেন। আহসান উল্যাহ মজুমদারের লেখা বহু নাটক, গল্প, প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে শীর্ষস্থানীয় দৈনিকে। বাংলা একাডেমির মাসিক সাময়িকি ‘বই’ নামক সংকলনে লিখতেন নিয়মিত। খুব স্বভাবিক জীবন-যাপনকারী এই সাংবাদিককে প্রতিষ্ঠিত হবার জন্য সবসময় পরামর্শ দিতেন আরেক গুনধর সাংবাদিক ও রামগতির সন্তান সানাউল্লাহ নূরী। আহসান উল্যাহ মজুমদারকে তিনি (সানাউল্যাহ নূরী) বলতেন, ‘গ্রমে পড়ে থেকে যত ভালো সাংবাদিকতা কর না কেন, কোন লাভ নেই। ঢাকায় থাকলে এতদিনে আমার মত তুমিও একটি পত্রিকার সম্পাদক হতে পারতে’। আহসান উল্যাহ মজুমদারকে উৎসাহ দিতেন ঢাকায় যাবার জন্য, থাকার জন্য।
কিন্তু না এলাকার মানুষের কাছে যেন তার ছিল দায়বদ্ধতা। শেকড়ের টান তিনি ছিড়তে পারেন নি। তার জন্য মনে কোন আক্ষেপ ছিল না অহসান উল্যাহ মজুমদারের। ব্যক্তি, সংসার, শিক্ষকতা, তৃনমূলে থেকে সাংবাদিকতা করা, চিকিৎসা সেবাকে কখনোই ছোট করে দেখেননি আহসান উল্যাহ মজুমদার। মানসিক প্রশান্তি অনুভব করতেন প্রাত্যহিক কাজ নিয়ে। চিকিৎসা শাস্ত্র হোমিও ডাক্তারি করে তিনি মানুষকে সেবাই দেন নি, হোমিও শাস্ত্রকে নিয়ে তিনি গবেষণা করতেন সবসময়। হোমিও শাস্ত্রের ওপর গভেষনা ধর্মী একটি বই প্রকাশের আগ্রহ নিয়ে কয়েক বছর ধরে নিয়মিত লিখে যাচ্ছিলেন। শেষ পর্যন্ত অসমাপ্ত দীর্ঘ গবেষণার ফসলটি অপ্রকাশিতই থেকে গেল।
হঠাৎ খবর পেলাম আহসান উল্যাহ মজুমদারকে লক্ষ্মীপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। ছুটে গেলাম সেখানে। গিয়ে দেখি হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছেন তিনি। উচ্চ রক্ত চাপে ব্রেনে তার রক্ত জমাট বেঁধে গেছে। ছট-ফট করছেন হাসপাতালের বিছানায়। এমন দৃশ্য সহ্য করতে পারছিলাম না। মনে অনেক কষ্ট নিয়ে বাড়ি ফিরে আসি। পরবর্তীতে হাসপাতালে ৪/৫ দিন চিকিৎসাধিন অবস্থায় ১২ জুলাই ১৯৯৬ পৃথিবীর সমস্ত ভালোবাসা ত্যাগ করেন আহসান উল্যাহ মজুমদার।
অনন্য প্রতিভার এই মানুষটি অনন্য সাদা মনের অনন্য মানুষ ছিলেন তিনি। তাকে হারানোর স্মৃতি, তার কাছ থেকে সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ, মানুষের প্রতি তার ভালোবাসা, আজও আমাকে প্রতিটি মুহুর্তে স্মরণ করিয়ে দেয় অমর সাংবাদিক আহসান উল্যাহ মজুমদারকে। আজ তার মৃত্যুদিনে তারপ্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা।
লেখক: সাংবাদিক ও উন্নয়ন কর্মী, ইমেইল: ahmfoysoul@yahoo.com