ভিয়েনা,অস্ট্রিয়া: আমরা যারা প্রবাসে আছি কেউ কিএকবার ভেবে দেখেছি কোথায় যাচ্ছে আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম ?

জন্মগত ভাবে আমরা বাংলাদেশের নাগরিক, বাঙ্গালী জাতি । আমাদের নিজস্ব একটা দেশ আছে,জাতীয়তা আছে, আছে সাংস্কৃতি, আছে ধর্ম, এবং আছে একটি নিজস্ব ভাষা। সেই ভাষার আবার গৌরব গাঁথা একটা ইতিহাস আছে। অনেক রক্ত ও ত্যাগের বিনিময়ে আজকের আমাদের এ ভাষা বাংলা ভাষা । গৌরবে মাথা উঁচু হয়ে যায়, বুক ফুলে ফেঁপে ঊঠে ,যখন দেখি আমার ভাষা আজ আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত একটি ভাষা। আমার একুশ আজ পালিত হয় সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে,এর চেয়ে বড় পাওয়া একটা জাতির জন্য অর কি হতে পারে । ব্রিটিশের হাত থেকে মুক্ত হয়ে ধর্মের দোহাই দিয়ে ভাই দাবীদার পাকিস্তান আমাদের বুকে টেনে নিয়ে আরেক পরাধীনতার শংঙ্খলে আবদ্ধ করলো। আমাদের মাতৃভাষাকে অবজ্ঞা করে তাদের ভাষাকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেবার ষড়যন্ত্র করলো। ১৯৫২ সালের রক্তাক্ত  ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে সালাম,বরকত,রফিক,শফিক সহ অসংক্ষ বাঙ্গালীর তাঁজা রক্তের বিনিময়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে রক্ষা করলাম,প্রতিষ্ঠিত করলাম । পৃথিবীতে একমাত্র বাঙ্গালী জাতি তার ভাষা রক্ষার জন্য যে রক্ত দিয়েছে,যে ত্যাগ স্বীকার করেছে ,পৃথিবীর অন্য কোন জাতি আজ পর্যত এ’রকম ত্যাগ স্বীকার করেনি ।   অনেক রক্ত,অনেক ত্যাগ তিতিক্ষার বিনিময়ে অর্জিত আজকের আমাদের এ’ বাংলা ভাষা পৃথিবীর একটি স্বীকৃত ভাষা। আমাদের একুশ আজ জাতিসংঘের মাধ্যমে সারা বিশ্বে আন্তর্জাতিক ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হয় । এটা সত্যি জাতি হিসেবে আমাদের বিরাট গর্বের ব্যাপার ।

সারা বিশ্বে আজ যখন আমার ভাষা স্বীকৃত , ভাষা নিয়ে আমরা গৌরাবান্নিত। আমরা যারা প্রবাসে আছি আমাদের আগামী  প্রজন্ম আমাদের সন্তান দের দিকে তাকিয়ে কি একবার কেউ দেখেছেন , আমার গর্বিত বাংলা ভাষার কি হাল-বেহাল  অবস্থা আমাদের সন্তান তথা আমাদের আগামী নতুন প্রজন্ম র কাছে । হাল-বেহাল অবস্থা বলতে আমি বলতে চাচ্ছি ,আমাদের নিজস্ব ভাষা, নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে আমাদের নতুন  প্রজন্ম দিন দিন যে ভাবে দূরে সরে যাচ্ছে আগামী তে র একটা বিরাট প্রভাব যে আমার বাঙ্গালী জাতি সত্তা ,তথা বাংলাদেশে পরবে সেটা কি আমরা কেউ একবার ভেবে দেখেছি । লালনের সেই পরিচিত গানটাই এখন মনে পরছে”সময় গেলে সাধন হবেনা’ । তাই বলি সময় থাকতেই এর একটা  ব্যাবস্থা আমাদের করতে হবে । নতুবা আজীবন আমার এ’জাতিকে এর জন্য চরম মূল্য দিতে হবে,শোধরাবার আর কোন পথ থাকবেনা । আমরা যারা প্রবাসে আছি আমাদের আগামী প্রজন্ম আমাদের সন্তান দের কি আমরা আমাদের ভাষা সìপর্কে সম্যক জ্ঞান দিতে পারছি ? পারছি না , কেন পারছি না ? সেই পরিবেশ ,সেই সুযোগ হয়তো তেমন নেই । কিনতু কেন নেই ?  প্রবাসে আমাদের সন্তানদের আমার নিজস্ব ভাষা শিক্ষার জন্য যে জিনিষ গুলি থাকা প্রয়োজন , তার সব কটা এখানে নেই । বলতে পারেন এটা কেমন কথা !

আপনি বা আপনারা বুকে হাত রেখে বলেন তো ,ক’জন আপনারা আপনার সন্তান কে বাংলা ভাষা শিক্ষার জন্য নজর বা কোন গুরুত কখনো দিয়েছেন । হয়তো বলবেন,বাসায় তো আমরা সবাই বাংলা ভাষাতেই কথা বলি । আমার সন্তান নেরা তো বাংলা ভাষাতেই কথা বলে । কিনতু আপনি কি জানেন, ওটা ঐ পর্যন্তই্ । আপনার সন্তান বাংলায় দু’কলম লিখতে পারবে না,বাংলা পত্রিকার এক কলাম পড়তে পারবেনা । যদি ও সেটা কিছু অংশ পড়ে ,সেটা হবে লডর্ ক্লাইভ বা জন এন্ডারসনের বাংলা উচ্চারন । হয়তা দু’এক জন বা দু’একটা প্রবাসী পরিবার কিছুটা ব্যতিক্রম হতে পারে । এর কারন কি ? এর কারন অনেক| একটা ভাষা শিক্ষা জন্য যে সিষ্টেম বা প্রযুক্তি বা সুবিধা থাকা প্রয়োজন সেটা এখানে নেই । আমরা আমাদের সন্তান দের ভাষা শিখার ব্যাপারে যত টুকু দায়িত পালন করা দরকার, যতটুকু সময় দেওয়া প্রয়োজন,আমি নির্দ্বিধায় বলবো ততটুকু সময় আমরা আমাদের সন্তানদের ভাষা শিখার ব্যাপারে দিতে পারছিনা বা দেই না । অনেক পরিবারে স্বামী-ত্রী দু’জনেই কাজ করেন, কর্মক্ষেত্রে দিনেরসিংহ ভাগ সময়টাই চলে যায়,অন্যান্ন সামাজিক পারিবারিক ব্যস্ততা তো আছেই । সন্তানকে মাতৃভাষা শেখানোর সে সময় তাদের নাই । আমি অনেক কেই চিনি,জানি,দেখছি, যারা তাদের  সন্তাননেরা বিদেশী ভাষায় কথা বললে খুব গর্ব বোধ করেন । তাদের দেখেছি বাসায় আগত বাংলাদেশী  মেহমানদের সামনে  সন্তানদের  সাথে বিদেশী ভাষায় কথা বলেন ।   তারা এতে র্গব বোধ করেন ।

আমি এ’রকম কিছু ঘটনার প্রতিবাদ করেছি,তাদের বুঝিয়েছি, কিতু ঐ পর্যন্তই । আমার একবন্ধু লন্ডনে তার এক পরিচিতের বাসায় যান ছুটিতে বেড়াতে । সেখানে তিনি দেখেন,ঐ বাঙ্গালী পরিবারের দু’টি বাচ্চা,আমাদের ভবিষ্যত প্রজম অনর্গল ইংরেজীতে কথা বলতে । আমার বন্ধু লন্ডন থেকে  অষ্ট্রিয়া  ফিরে এসে কথা প্রসঙ্গে  আমাকে লন্ডনে তার পরিচিতের বাসার বাচ্চাদের ব্যাপারে খুব গর্বের সাথে আলাপ করছিলো জানেন,বাচ্চারা কত সুন্দর ভাবে বাসায় ইংরেজীতে কথাবার্তা বলে, বাংলায় তারা কথাই বলেনা । আমি তাকে ধিক্কার দিলাম , এটা কোন গর্বের ব্যাপার হতে পারেনা । এটা আমার কাছে একটা লজ্জার ব্যাপার । ধিক আমার সেই সন্তানদের  মা-বাবা কে । প্রবাসে থাকার প্রয়োজনে হয়তো সেই দেশের ভাষা আমাকে শিখতে হবে , সন্তানদের শিখাতে হবে, কিতু তাই বলে আমার মাতৃভাষাকে বিসর্জন দিয়ে নয় ।

বাসায় বাচ্চাদের ইংরেজী বা জার্মান ভাষায় কথা বলাতে যারা উল্লসিত,উৎফুল্ল হন তাদের জন্য আমার দূ:খ হয় । তাদের জন্য করুনা করা ছাড়া আমার করনীয় আর কিছু নেই । প্রবাসে থাকার তাগিদে অবশ্যই বিদেশী  ভাষা শিখার প্রয়োজন  আছে ,অবশ্যই শিখবে । পাশাপাশি আমাদের সন্তানেরা যেন তাঁদের মাতৃভাষা ভুলে না যায় , সে দিকটা গুরুতের সাথে মা-বাবা কে লক্ষ্য রাখতে হবে ।  যে সন্তানদের জন্ম প্রবাসে হ য়েছে, অ আ ক খ অবশ্যই তাদের বোধগম্য নয়, এটাই স্বাভাবিক ।  আমাদের নিজ দায়িতে আমাদের ভবিষ্যত প্রজন্মকে আমাদের ভাষা জ্ঞান দিতে হবে ।  অসংক্ষ বাঙ্গালীর তাঁজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমার এ’ বাংলা ভাষাকে তার গৌরব মহিমায় টিকিয়ে রাখতে  হবে ।   বাংলা সাংস্কৃতিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে ।   অনেক বাঙ্গালীর ঘড়ে  বিদেশী গানের , ছবির ক্যাসেট, সিডি’র ছড়াছরি, যার ভিতর আমার নাড়ির টান নাই,নাই কোন শিকড় মাটির গন্ধ । বাংলা নাটক,গানের সাথে তারা অতটা পরিচিত নয়, যতটা না পরিচিত প্রাশ্চাত্য  সাংস্কৃতির সাথে । আমাদের আগামী  প্রজন্ম আমাদের সন্তানদের দিকে তাকিয়ে দেখছি তারা  দিন দিন বিদেশী ভাষা, বিদেশী  প্রাশ্চাত্য  সাংস্কৃতির  দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে । এ’টা খুব ভাল লক্ষন নয় । এ’ প্রজন্মকে অপ-সংস্কৃতির হাত থেকে  বাঁচাতে হবে । আমাদের আগামী প্রজন্ম  আমার ভাষা, সাংস্কৃতিকে ধরে রাখার জন্য  আমাদের উদ্দ্যোগ  নেবার পাশাপাশি  সরকার কে ও এগিয়ে আসতে হবে ।   নতুবা একদিন প্রবাসে হারিয়ে ফেলবে তার ভাষা, ,সাংস্কৃতি এবং তার শিকড়ের সন্ধান । যাযাবর জাতি হিসেবে তাকে বেঁচে থাকতে হবে প্রবাসে । না দিতে পারবে সে তার শিকড়ের সন্ধান ।

প্রাচীন ভারত থেকে বিতারত হয়ে বহু পরিবার  ইউরোপে এসে আশ্রয় নিয়েছিলো ।   যুগোলাভিয়া,রুমানিয়া,হাঙ্গেরী ও বুলগারিয়াতে তারা বসতি গড়ে তোলেছিলো । তাদের পরবর্তী  প্রজন্ম তাদের পূর্ব পূরুষ দের ভারতীয় ভাষা ,সাংস্কৃতি ভূলে গেছে । তারা বর্তমানে ইউরোপে সিগুইনা, রোমা বা যাযাবর জাতি হিসেবে পরিচিত ।   তারা বলতে পারেনা তার শিকড়ের সন্ধান । তারা শুধু এতটুকু বলতে পারে , আমাদের পূর্ব পূরুষেরা ভারত থেকে এসেছিলো । কামনা করি আমাদের পরবতী প্রজন্মকে যেন এ’ পরিনতি বরন করতে না হয় । আমাদের  ভাষা, সাংস্কৃতিকে নিয়ে আজ আমাদের ভাবতে হয় । আমাদের পাঠানো রেমিট্যান্সের টাকা দিয়ে দূতাবাস গুলিতে কতগুলো লোক পোষা হচ্ছে, প্রবাসী কল্ল্যান মন্ত্রনালয় গঠন করা হয়েছে আমাদের সমস্যা গুলো দেখাশোনার জন্য । তারা কি একবার এই দিকটা নিয়ে একবার ভেবে দেখেছেন কখনো ? অবশ্যই না । আমাদের আগামী প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য ,আমাদের ভাষা, সাংস্কৃতিকে প্রজন্মকে রক্ষা করার জন্য এখনই উদ্দ্যোগ গ্রহন করতে হবে ।   তাঁজা রক্তের বিনিময়ে অর্জিত আমার এ’ বাংলা ভাষাকে, সাংস্কৃতিকে  ধরে রাখতে হবে,টিকিয়ে রাখতে হবে, রক্ষা করতে হবে । গনপ্রজাতëত্রী বাংলাদেশ  সরকার , প্রবাসী কল্ল্যান মন্ত্রনালয় ও প্রবাসের বাংলাদেশ দুতাবাস গুলির প্রতি  আবেদন রইলো , প্রবাসে আমার কষ্টার্জিত ভাষা এবং সাংস্কৃতি কে বাঁচিয়ে রাখার জন্য আমাদের আগামী প্রজন্ম কে রক্ষা করার জন্য সরকারী উদ্দ্যোগে প্রবাসে বাঙ্গালী অধুষ্যিত দেশ গুলিতে দূতাবাস গুলির ততবধায়নে,প্রবাসের স্থানীয় বাংলাদেশ কমিউনিটি  নেতৃবৃন্দের সহযোগীতায় বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠার উদ্দ্যোগ গ্রহন করা হোক । প্রবাসে বাঙ্গালী অধুষ্যিত দেশ গুলিতে  বাংলা স্কুল প্রতিষ্ঠা  এখন জরুরী হয়ে দেখা দিয়েছে, এটা এখন সময়ের দাবী । এটা না হলে প্রবাসে আমার কষ্টার্জিত ভাষা এবং সাংস্কৃতি কে বাঁচিয়ে রাখা,  আমাদের আগামী প্রজন্ম কে রক্ষা করা দূ:সাধ্য হয়ে যাবে । প্রবাসে আমার কষ্টার্জিত ভাষা এবং সাংস্কৃতিকে, আমাদের আগামী প্রজন্ম মের মাধ্যমে  রক্ষা করা না গেলে  , বাংলা ভাষা আëর্তজাতিক স্বীকৃতি পাওয়া, আর একুশ সারা বিশ্বে আëর্তজাতিক ভাষা দিবস হিসেবে পালিত হলেও  সেটার কোন মূল্য থাকবেনা, সেটা হবে  মূল্যহীন ।   ব্যাপারটা নিয়ে আশা করি কর্তৃপক্ষ  গুরুতð সহকারে বিবেচনা করবেন ।   নতুবা আগামীতে প্রবাসে আমাদের নতুন প্রজন্ম হারাবে  আমার কষ্টার্জিত ভাষা এবং সাংস্কৃতিকে ।   আমার দেশ ও জাতি হারাবে আমাদের  আগামী প্রজন্ম কে ।   তাই পরিশেষে লালনের কন্ঠে সূর মিলিয়ে আবারো বলি “সময় গেলে সাধন হবেনা’ ।

আহমেদ ফিরোজ/

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here