ইতিহাসের সাক্ষী হতে ঘুম ভুলেছে ইডেন। সচিন তেন্ডুলকরের ব্যাট গত আট মাস ধরে চলতে থাকা ‘অপেক্ষার পরীক্ষা’য় কলকাতাতেই যবনিকা টানবে বলে ধরে নিয়ে তৈরি সিএবি কর্তারা। সম্ভাব্য শততম সেঞ্চুরির জন্য ১০০ সোনার গিনি দিয়ে বিশেষ স্মারক তৈরির বরাত চলে গিয়েছে শহরের এক নামী অলঙ্কার প্রস্তুতকারক সংস্থার কাছে। ক্লাবহাউসে কানাঘুষো শোনা গেল, সিএবি-র এক কর্তা নাকি কোটলার দ্বিতীয় ইনিংসে সচিন ৭৬-এ থেমে যেতে কালীঘাটে সেই রাতেই পুজো চড়িয়ে এসেছিলেন। যাতে ইতিহাস ইডেনের দিকে মুখ তুলে চায়। যাতে সোম থেকে শুক্র ভরপুর কাজের পাঁচটা দিনেও গ্যালারি ভরে যায় শততম সেঞ্চুরির গন্ধে! আর তাই সেই ইতিহাসের পথে সামান্যতম বাধাও রাখতে চাইছে না সিএবি। শনিবার ইডেনে ঢুকেই সাইটস্ক্রিনের উচ্চতা নিয়ে সচিন উষ্মা প্রকাশ করায় রাতভর কাজ করে তা আরও উঁচু করা হচ্ছে। তার জন্য প্রায় চোদ্দোশো আসন বাদ দিতে হলেও তাতে আমল দিচ্ছে না সিএবি। খবর : আনন্দবাজার
এমন পাহাড়প্রমাণ আকুতি যাঁকে ঘিরে, তিনি এ দিন প্রায় দেড় ঘণ্টা ইডেনে প্রায় ডুবে রইলেন নিরলস সাধনায়। নেটে মিনিট পনেরো ব্যাটিংয়ের পর তাঁর সাধনা শুরু হল ক্লাবহাউসের দিকে। শুধু নকিং। নিরলস, নিবিড় এবং একমুখী। শুধু সোজা ব্যাটে ‘ভি’-এর মধ্যে খেলে যাওয়া। টানা ৪৫ মিনিট। একা।তৈরি হচ্ছেন ক্রিকেট কিংবদন্তি। তৈরি হচ্ছে বহু ইতিহাস দেখা ইডেন। শততম সেঞ্চুরিটা যদি শেষ পর্যন্ত ঘটেই যায়, সে ক্ষেত্রে ইডেনের আর্কাইভে মুহূর্তটা কতটা জাঁকজমক সহকারে রাখা হবে, তার প্রাথমিক হোমওয়ার্ক কিন্তু শেষ সিএবি-র। তাদের স্বর্ণস্মারক তৈরির কাজ প্রায় শেষের পথে। মুখে অবশ্য সিএবি কর্তারা একেবারে ‘স্পিকটি নটা। প্রেসিডেন্ট জগমোহন ডালমিয়াই হোন বা যুগ্মসচিব বিশ্বরূপ দে, সবারই মুখে একটাই কথা কাটা রেকর্ডের মতো বাজছে। “সচিনের একশোতম সেঞ্চুরিকে বরণ করতে তৈরি সিএবি। ওটা চমকই থাক না।”
সত্যিই চমক আরও থাকছে। শহরের নানা স্কুল থেকে একশো ছাত্র-ছাত্রীকে বিনামূল্যে টিকিট দিচ্ছে সিএবি। পাঁচদিনই তাদের গায়ে থাকবে বিশেষ ভাবে তৈরি টি-শার্ট। যাতে লেখা থাকবে ‘লেটস প্রে ফর সচিনস হান্ড্রেড অ্যাট ইডেন।’ এসো, ইডেনে সচিনের সেঞ্চুরির জন্য প্রার্থনা করি। থাকবে একই বয়ানে লেখা বিশেষ ব্যানার। এত সব প্রস্তুতির অঙ্গ হতে পারে, কিন্তু ইডেনে সচিনের শনিবারের পা রাখা কিছুটা অপ্রস্তুতই করে দেয় সিএবি-কে। সেই ২০০৫ সালে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে টেস্ট ম্যাচ থেকেই ইডেনের সাইটস্ক্রিনের উচ্চতা নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছেন সচিন। গত শুক্রবার সাইটস্ক্রিনের উচ্চতা বাড়িয়েও দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তাতেও ‘ক্রিকেট দেবতা’-র মুখ ভার। দুপুরে মাঠে এসেই সচিন বোর্ডের পর্যবেক্ষক মারফত ডেকে পাঠান যুগ্মসচিব বিশ্বরূপ দে-কে। সরাসরি আপত্তি জানান ক্লাবহাউস ও হাইকোর্ট প্রান্তের সাইটস্ক্রিনের উচ্চতা নিয়ে। এমনিতে ইডেনের সাইটস্ক্রিনের উচ্চতা ১৬ ফুট, সেটা বাড়িয়ে ক্লাবহাউসের লোয়ার টিয়ারের চারটে সারি সাদা কাপড় দিয়ে মুড়ে সাড়ে উনিশ ফুট করা হয়েছিল শুক্রবার। তাতে ক্লাবহাউসের লোয়ার টিয়ারের ১৪৯ আসন কমে গিয়েছিল। কিন্তু তাতেও মন গলেনি একশো সেঞ্চুরির মাহেন্দ্রক্ষণে দাঁড়িয়ে থাকা সচিনের। সিএবি-র যুগ্মসচিবের কাছে দু’দিকের সাইটস্ক্রিনই আরও বাড়ানোর অনুরোধ করেন তিনি।সচিন বলে কথা, বলা মাত্র তৎপরতা শুরু সিএবি-র। শনিবার সন্ধেয় ফের নতুন করে ক্লাবহাউসের পাশের ব্লকে শুরু হয়েছে সাইটস্ক্রিন বাড়ানোর কাজ। আজ রবিবার সকাল সাড়ে ন’টায় প্র্যাক্টিস শুরুর আগে ফের সচিন বৈঠক করবেন বিশ্বরূপের সঙ্গে। তার আগেই সারা রাত জেগে সাইটস্ক্রিনের
উচ্চতা দু’ফুট বাড়ানোর কাজ শেষ করতে হবে। দুটো প্রান্তেই। এর জন্য শুধু ক্লাবহাউসেই কমছে ৩৪০ আসন আর হাইকোর্ট প্রান্তে এফ ব্লকে ১০৫৭ আসন। মোট চোদ্দোশো আসন কমে যাওয়া নিয়ে সিএবি অবশ্য আদৌ বিচলিত নয়। উল্টে যুগ্মসচিব বলছেন, “ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী হতে পারি আমরা। তার জন্য কোনও ত্রুটি সিএবি রাখতে চাইছে না। চোদ্দোশো কেন, প্রয়োজনে চার হাজার আসন কমানো যেতে পারে।” বারবার সচিন অভিযোগ করা সত্ত্বেও কেন সাইটস্ক্রিন সমস্যার স্থায়ী সমাধান হয় না? উত্তরে সিএবি-র সাফাই, সে ক্ষেত্রে ক্লাবহাউস ভাঙতে হবে, যা সময়সাপেক্ষ। ভবিষ্যতে হাইকোর্ট প্রান্তে নতুন ক্লাবহাউস তৈরির পরিকল্পনা আছে এবং সেটা তৈরির সময়ই এই সমস্যার সমাধান হতে পারে।
সে যা-ই হোক, ইডেনে সচিনের পা পড়া মাত্র শুরু হয়েছে ঐতিহাসিক মুহূর্তের সাক্ষী থাকার আর্তি। জনৈক ওঝা নাকি ইডেনের পিচে গিয়ে মন্ত্রঃপূত হাড় ছুঁইয়ে এসেছেন এবং দাবি করছেন, ইডেনেই আসছে সেই বহু প্রতীক্ষিত মুহূর্ত। আর স্বয়ং সচিন? সাইটস্ক্রিন-পর্বের পরে নেট, তার পর দীর্ঘ সময় ধরে নকিংয়ে ডুবিয়ে রাখলেন নিজেকে। গ্যারি কার্স্টেন জমানায় ম্যাচের আগে সচিনকে রোজ গড়ে শ’পাঁচেক বল ছোঁড়ার দায়িত্বটা স্বয়ং গ্যারিই নিতেন। এখন ডানকান ফ্লেচার জমানায় তা হাতবদল হয়ে ফিল্ডিং কোচ ট্রেভর পেনির কাছে।
তিনি ইডেন ছাড়ার সময় ক্রমশ বাড়ছিল গগনভেদী ‘স-চি-ন, স-চি-ন’ আওয়াজটা। যা সোমবার থেকে ইডেনে গর্জনে বদলে গেলে অবাক হবেন না। টিকিটের চাহিদা বাড়ার এখনও তেমন লক্ষণ নেই। সচিন স্বয়ং শহরে ঢুকে পড়া সত্ত্বেও নেই। সিএবি কর্তারা অবশ্য ঘাবড়াচ্ছেন না, জানেন, ‘নেই’ তা নিমেষে ‘আছে’-তে বদলে যেতে পারে সোম থেকে শুক্রর যে কোনও দু’টো দিন। দিনের মাঝামাঝি সময় ব্যাট হাতে নেমে মহানায়ক ৪৮ নটআউট, এমন একটা স্ক্রিপ্টের নিরুচ্চার প্রার্থনা এখন সিএবি-র ‘খিড়কি থেকে সিংহদুয়ার’-এর সর্বত্র। যাতে পরের সকালের ইডেন উপচে পড়ে সম্ভাব্য ইতি হাসের শরিক হতে। হবে, না হবে না? মিলবে, না মিলবে না?
মেলাবেন, তিনি মেলাবেন?

ইউনাইটেড নিউজ ২৪ ডট কম/স্পোর্টস নিউজ

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here