লেখক: পারভেজ আহমেদ পাপেল

‘চাঁপাতলায় শুধুই কান্না’; ‘অনাহারে দিন কাটাচ্ছে পঞ্চাননের পরিবার’; ‘প্রাণ গেল খোকারামের তবু স্বস্তিতে নেই পরিবার’; বাপ ডাইকেও মাইয়াডারে বাঁচাতে পারিনি’  উপরের উক্তিগুলো গত কয়েকদিনের জাতীয় ও অনলাইন পত্রিকার সংবাদ শিরোনাম ছিল।  গতকদিনের প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিস্ক  মিডিয়ার খবরগুলো শুনে মনে হয় আমরা যেন আমাদের সেই চিরচেনা সোনার বাংলাকে খুজে পাচ্ছি না।

এ যেন এক অন্য বাংলাদেশ যেখানে ধর্মের নামে চলছে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার নগ্ন এক খেলা। গত ৫ জানুয়ারী ২০১৪ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পরদিন যশোহরের অভয়নগর থানার চাপাতলা গ্রামে সংখ্যালঘু পরিবারের উপর হামলা চালানো হয়।

এটা অবশ্য কোন নতুন ঘটনা নয়। আমরা প্রতিনিয়ত দেখে আসছি যে, কারণে অকারণে সহিংস নির্যাতনের শিকার হন আমাদের দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষরা। নয়মাস রক্তয়ী সংগ্রামের মধ্য দিয়ে আমরা একটি স্বাধীন ভূখন্ড লাভ করি। আমাদের প্রথমতম স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি হবে একটি অসাম্প্রদায়িক ও শোষণ মুক্ত রাষ্ট্র। কিন্তু স্বাধীনতার এত বছর পরও আমরা কিন্তু আমাদের সেই স্বপ্নের বাংলাদেশকে প্রতিষ্ঠা করতে পারিনি।

তার বড় প্রমাণ হল এই যে, আজও এক শ্রেণীর মানুষ ধর্মের দোহাই দিয়ে নিজের স্বার্থ হাসিলের জন্য নির্যাতন করেছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর। স্বাধীনতার এই দীর্ঘ সময়পর আমাদের সামনে কিন্তু এখন একটি প্রশ্ন স্পষ্ট হয়ে দাড়ায় যে, আসলে এই সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে কি আমরা এই দেশের নাগরিক হিসেবে মেনে নিতে পারছি না?

ধর্মান্ধদের চোখে সংখ্যালঘুরা যেন বাংলা প্রবাদের ভাষায় ‘যতদোষ নন্দ ঘোষ’। চলমান রাজনৈতিক সহিংসতার সূযোগে একটি স্বার্ধন্বেষী চক্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে আসছেন। জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জয় পরাজয় কিংবা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সকল েেত্রই সহিংসতার বলি এই সম্প্রদায়। কিন্তু কেন? মহান মুক্তিযুদ্ধের পর এদেশের হিন্দু সম্প্রদায় মানুষেরা নতুন দেশে সমধিকার নিয়ে বেঁচে থাকার স্বপ্ন দেখেছিলেন। আর এই স্বপ্ন দেখাটাও অযৌক্তিক ছিল না। কারণ দেশ স্বাধীন করতে গিয়ে মূসলিম ধর্মালম্বীদের মতন হিন্দু সম্প্রদায়কে চরম মূল্য দিতে হয়েছে।

১৯৪৭ সালে যখন পূর্ব বাংলার জনগণ পাকিস্তানী শাসক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে সর্বাতক আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পরেন তখন সাম্প্রদায়িক বিষবাষ্প ছড়িয়ে তাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিয়ে নির্বিচারে হত্যা করা হয়। আজও ঠিক স্বাধীনতার দীর্ঘ সময়পর একই ঘটনার পূণরাবৃত্তি ঘটছে। স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবিধানে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মীয় পরিচয় নির্বিশেষে সকলের সমধিকারকে নিশ্চিত করা হয়। কিন্তু খুব বেশিদিন তা দীর্ঘস্থায়ী হয়নি। আমরা যদি একটু পেছনে ফিরে তাকাই তাহলে দেখতে পাব ১৯৯২ সালে ভারতে বাবরী মসজিদ ভাঙ্গাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশী হিন্দু পরিবারগুলোর উপর নেমে আসে নির্যাতনের খরগ হস্ত। এসময় ৩৫২ টি মন্দির আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। শুধু তাই নয় এর পাশাপাশি সংখ্যালঘু পরিবার গুলোর উপর ধর্ষণ ও লুটতরাজের ঘটনাও ঘটে।

২০০১ সালে আবারও নির্বাচন উত্তর সহিংসতার শিকার হন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়। স্বাধীনতা উত্তরকালে এটি ছিল সবচেয়ে ভয়ানক। গণহত্যা, অপহরণ, ধর্ষণ, জোড় করে বিয়ে, ধর্মান্তরিত করা, চাঁদা আদায় ও সম্পত্তি দখল কোন কিছুই যেন বাদ ছিল না সেময়ে। সেই সময়ে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত ঘটনা গুলো থেকে জানা যায় এক হিন্দু বিধবাকে জোর করে তারা গরু নিজ হাতে জবাই করার পরে মূসলমানদের রান্না করে খাওয়াতে বাধ্য করা হয়। ভোলার চরফ্যাশনে এক রাতে ২০০ হিন্দু মহিলাকে গণধর্ষণ করা হয়। শিশুদের সামনে এক বিছানায় মা-মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়। একের পর এক নারকীয় ঘটনা ঘটাতে থাকে এক শ্রেণীর নরপশুরা। এযেন স্বাধীন বাংলাদেশে পাকিস্তানী হায়েনাদের নতুন রুপে উত্থান।

২০০১ সালের পরিসংখ্যান অনুসারে এদেশে হিন্দুদের সংখ্যা ছিল ১৬.৮৩ মিলিয়ন। ২০১১ সালে এই সংখ্যা বেড়ে দাড়ানোর কথা ছিল ১৮.২ মিলিয়ন। কিন্তু ২০১১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা যায় এই সংখ্যা ১২.৩ মিলিয়নে এসে দাড়ায়। গত বছর ফেব্র“য়ারী মাসে কুখ্যাত রাজাকার দেলওয়ার হুসাইন সাইদীর ফাঁসির রায় হওয়ার পর দেশব্যাপী যে সাম্প্রদায়িক হামলা চালানো হয় এটা কিন্তু কোন বিচ্ছিণœ ঘটনা নয়। ১৯৪৭, ১৯৫০, ১৯৬৪, ১৯৯০, ১৯৯২ ও ২০০১, সালের সংখ্যালঘু নির্যাতনের ধারাাহিকতায় ঘটেছে।

বিগত সরকার নির্বাচনী প্রতিশ্র“তির অংশ হিসেবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেন। ইতমধ্যে বেশ কজন যুদ্ধাপরাধীর শাস্তিও ঘোষণা করা হয়। ২০১৩ সালের ফেব্র“য়ারী মাসে কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী দেলওয়ার হোসেন সাইদীর রায় ঘোষণার পর সংখ্যালঘু পরিবারের উপর নেমে নির্যাতনের খরগ হস্ত। পুরো বিষয় দেখে মনে হয় যেন সাইদীর ফাসির হওয়ার জন্য শুধু মাত্র সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ই দায়ী। ঠিক একই ভাবে এবারের জাতীয় নির্বাচনের পর সংখ্যালঘু নির্যাতনের নতুন মাত্রা পায়। ঠিক যে ভাবে মুক্তিযুদ্ধের সময় গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল, বাবার সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করা হয়েছিল ঠিক একই কায়দায় নির্বাচনের পরদিন থেকে শুরু হয় সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন।

যশোহরের ঋষিপাড়া, হাজরাইল, হরিদাসকাঠি, মনিরামপুর যেন এক অজনা আতঙ্কের জনপদে পরিণত হয়েছে। হাজরাইলের ঋষিপাড়ায় স্বামী ও শ্বশুড়কে বেধে রেখে নির্যাতন চালানো হয় গৃহবধূর উপর। শ্বাশুড়ি ধর্মের বাপ ডেকেও বাঁচাতে পারেনি ছেলে বউকে। অপরদিকে বাবা-ছেলেকে বেধে রেখে তাদের চোখের সামনেই শ্বাশুড়ী ও বোয়ের উপর চালানো হয়েছে পাশবিক নির্যাতন। শূধু যশোহর নয় ঠাকুরগাঁও’র গারেয়া ইউনিয়নের গোপালপুর গ্রামের ঝাকুয়াপাড়া বাজারে ভেঙ্গে দেওয়া হয় পঞ্চানের খাবারের হোটেল। অনাহারে-অর্ধাহারে এখন দিন কাটাচ্ছে পঞ্চাননের পরিবার। অপরদিকে গাইবান্ধার কূপাতলা ইউনিয়নে ান্যায়ের প্রতিবাদ করায় জীবন দিতে হয়েছে খোকারামকে।

ভোটের আগের দির স্থানীয় বিএনপি’র লোকজন এসে ঘোষণা দেন ‘হিন্দুপাড়া এক ঘন্টার মধ্যে পুড়িয়ে দেব, সবশালাকে উচ্ছেদ করব’। একথার প্রতিবাদ করায় খোকারামের পরিবারের উপর নেমে আসে নির্মম নির্যাতন। খোকারামকে গাছের সঙ্গে বেধে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। এইক ভাবে দিনাজপুর, জয়পুরহাট, নাটোর, চারঘাট, ময়মনসিংহনেত্রকোকাণা ও পিরোজপুরে সংখ্যালঘু নির্যতনের ঘটনা ঘটেছে।

এভাবে সারা বাংলাদেশেই চলছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতনের ঘটনা। কিন্তু কেন, এই অনাচার, অবিচার, হামলা, লুট, ধর্ষণ? একটি স্বাধীন দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার দায়িত্ব সরকারের। কিন্তু বর্তমান সরকার এখানে নিরাপত্তা বিধান করতে চরম ভাবে ব্যর্থ হয়েছেন। একদিকে বিরোধীদল মতায় যাবার লোভে অন্ধ হয়ে একর পর এক পেট্রোল বোমা মেরে মানুষ হত্যা করছেন। অন্যদিকে সরকারী দল গদি রায় ব্যস্ত। আর আমরা আম জনতা ফুটবলে পরিণত হয়েছি এক দলের লাথি খেয়ে অপর দলের কাছে যাচ্ছি। বিএনপির সঙ্গে উগ্র ধর্মভিত্তিক রাজনৈতিক সংগঠন জামাতের গভীর সর্ম্পক রয়েছে বিধায় আমাদের দেশের হিন্দুধর্মালম্বীরা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য বিএনপির উপর তেমন একটা ভরসা করতে পারে না।

অপরদিকে আওয়ামীলীগের সাথে ভারতের ভাল সম্পর্কের কারণে এই সম্প্রদায় বারবারই আওয়ামীলীগের উপর বেশী ভরসা করে থাকেন। কিন্তু সেই অওয়ামীলীগ কি দিতে পেরেছে সংখ্যালঘুদের নিরাপত্তা। যে ভাবে ১৯৭১ সালে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্যাতন চালিয়েছিলেন ঠিক একই কায়দায় ২০১৪ সালেও নির্যাতন চালানো হচ্ছে পার্থক্য শুধু একটি জায়গায় যে এখন রাষ্ট্র মতায়  অধিষ্ঠিত রয়েছেন মুক্তিযুদ্ধের স্বপরে একক দাবীদার আওয়ামীলীগ। যারা নিজেদের আ¯প্রদায়িক রাজনৈতিক দল হিসেবে দাবী করে থাকেন।

আওয়ামীলীগ যে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের জন্য নিরাপদ নয় তার বড় প্রমাণ সাম্প্রতিক এই ঘটনাগুলো।। বেশ কিছুদিন আগের ঘটনা রামুর বৌদ্ধ মন্দিরগুলো আগুনে পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এই ঘটনার গভীর গিয়ে দেখা যায় যে, বিএনপি, জামাত, আওয়ামীলীগ সবাই এতে ইন্ধন যুগয়েছিলেন। হয়তবা আওয়ামীলীগ নেতাদের সংশ্লিষ্ঠতা থাকার কারণেই এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত করা হয়নি।

এখানে উল্লেখ্য যে, গত ৫ জানুয়ারী সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর যে, নারকীয় ধবংস যজ্ঞ চালানো হয় তা আসলে অতীতে বিভিন্ন সময়ে তাদের উপর যে হামলার ঘটনাগুলো ঘটেছে তার সুষ্ঠু বিচার না করার ফল। এখানে একটি কথা যদি দাবী করা হয় যে, প্রশাসনের মদদে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর নির্বিচারে নির্যাতন চালানো হয়েছে সেটাকে পুরোপুরি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না কারণ পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য থেকে জানা যায় গত ৫ জানুয়ারী নির্বাচনত্তোর যে সহিংসতার সময় নিপীড়িতরা বারবার প্রশাসন ও সরকারী দলের নেতা-কর্মীদের নিকট সাহায়্যের আবেদন করেও কোন সাড়া পায়নি।

এ থেকেই কি বোঝা যায় না আওয়ামীলীগ মুখে যতই বলুক তারা সংখ্যালঘুদের প্রতি সংবেদনশীল কিন্তু প্রকৃত অর্থে তা নয়। বিএনপি-জামাত-আওয়ামীলীগের সংখ্যালঘুদের বিষয়ে একটি জায়গায় চিন্তার মিল পাওয়া যায় যে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়রা দেশে থাকলে নির্বাচনে তাদের ভোট আওয়ামীলীগ পাবে আর দেশ থেকে তাদের বিতাড়িত করতে পারলে খুব সহজেই এই ডানপন্থী দলগুলো তাদের সম্পত্তি দখল করতে পারবে।

আমাদের এই স্বাধীন বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপর হামলার ব্যাপারে ইন্ধন দান এবং হামলার সাথে প্রত্য ও পরো ভাবে জড়িত থাকার েেত্র যদি বিএনপি-জামাতকে দায়ী করা যায়। তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে নিরাপত্তা প্রদানে ব্যর্থতা, মতায় থেকেও নির্যাতনের ঘটনাগুলোর বিচার বিভাগীয় তদন্ত না করা এবং সাম্প্রদায়িকতাকে পূজি করে মতায় ঠিকে থাকার নোংরা রাজনীতির জন্য আওয়ামীলীগও সমান দায়ী।

তাই আজকে সময় এসেছে সকলকে ঐক্যবদ্ধ ভাবে লড়াইয়ে নামতে হবে। আসুন আমরা শপথ গ্রহণ করি আর কোন সংখ্যালঘুকে আমরা এদেশের মাটিতে নির্যাতিত হতে দিব না।

 

লেখক: মানবাধিকার কর্মী

ইমেইল: parvez_ahamd@yahoo.com

Print Friendly, PDF & Email

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here